মহানবী (সা.) এর জন্ম ও আরবসমাজ
মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া
প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। সব নবীদের শেষে পাঠিয়েও আল্লাহ তাকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়েছেন। সর্বশ্রেষ্ঠ ভূমি আরবকে নির্বাচন করেছেন তার আগমনের জন্য। তিনি জন্মেছেন বনু ইসমাইলের অভিজাত গোত্র কুরাইশে। পূর্ববর্তী নবী রাসুলদের অনেকেই স্বীকৃতি দিয়েছেন তার শ্রেষ্ঠত্বের। ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন তার জন্মের। পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবেও সুসংবাদ দেয়া হয়েছে তার আগমনের।
তার জন্য দোয়া করেছেন নবী ইবরাহীম (আ.) পুত্র ইসমাইলকে নিয়ে। ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি আমাদের বংশধরদের মাঝে তাদের ভেতর থেকেই একজন রাসুল প্রেরণ করুন’। (সুরা বাকারা : ১২৯)। আল্লাহতায়ালা তার খলিলের দোয়া কবুল করার কথা জানিয়েছেন- যা উল্লেখ রয়েছে (ওল্ড টেস্টামেন্ট বুক অফ জেনেসিস) আমি ইসমাইলকে বললাম, আমি তোমার দোয়া কবুল করেছি। আমি তাকে অত্যধিক পরিমাণে বরকত দান করব। অতঃপর সে ১২ জন নেতা জন্ম দেবে। আর তাকে আমি একটা বিশাল জাতিতে পরিণত করব। নবীজির পবিত্র জবানেও উচ্চারিত হয়েছে একথা- ‘আমি পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া ও ঈসা (আ.)-এর সুসংবাদের ফসল। (মুসনাদে আহমদ)।
হজরত মুসা (আ.) ও তার শিষ্যদের শুনিয়েছেন আখেরি নবীর আগমনের কথা। বলেছেন, ‘শোনো! ইসরাইলের সন্তানরা।’ তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের এক ভাইকে আমার মতো নবী বানিয়ে প্রেরণ করবেন। তোমরা তার কথা শুনবে। (ওল্ড টেস্টামেন্ট বুক অফ ডিউটেরনমি)।
এছাড়াও নবী ঈসা (আ.) তার হাওয়ারিদের বলেছেন ‘হে বনি ইসরাইল! আমি তোমাদের সুসংবাদ দিচ্ছি। আমার পরে একজন রাসুল আসবেন। যার নাম আহমদ।’ (সুরা সফ : ৬)। তিনি আরো বলেছেন, ‘আমি তোমাদের অনেক কথা বলতে চাই। কিন্তু তোমরা এখন সেটা বুঝবে না। কারণ যখন সত্যের আত্মা আসবেন। তিনি তোমাদের সত্যের পথে নিয়ে যাবেন। তিনি নিজের কথা কিছু বলবেন না। যা শুনবেন তাই বলবেন। তিনি তোমাদের ভবিষ্যতের কথা বলবেন। তিনি আমার সম্মাননাটা বাড়িয়ে দিবেন। (নিউ টেস্টামেন্ট অধ্যায় ১৬, অনুচ্ছেদ ১২ থেকে ১৪)। ইহুদিদের বিশ্বাস ছিল, একমাত্র তারাই আল্লাহর প্রিয় পাত্র। তাদের ধর্মই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য। অধিকাংশ নবী যেহেতু তাদের মধ্য থেকেই আগমন করেছে। তাই শেষ নবী তাদের মধ্যে থেকেই আসবে। কিছু ইহুদি পন্ডিত তো ইয়াসরিবে এসে আবাস গেড়েছিল, শেষ নবী এখানে আগমন করবে বলে। খ্রিষ্টান পাদ্রীরাও অপেক্ষায় ছিল, ঈসা (আ.)-এর সুসংবাদ প্রাপ্ত আখেরি নবী তাদের মধ্য থেকে আসবে। আর যুক্তির কথা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বর জ্ঞান-বিজ্ঞানের শহর গ্রীসে আগমন করবেন, প্লেটো, সক্রেটিস, এরিস্টটল জন্মেছে যে ভূমিতে। অথবা রোমণ্ডপারস্যের সুরম্য অট্টালিকাময় জাঁকজমকপূর্ণ কোনো এলাকায়। কিন্তু সবার হিসাব-নিকাশ উল্টে দিয়ে আখেরি নবী আগমন করলেন আরবের শুষ্ক মরুতে। যেখানকার অধিবাসীরা তুলনামূলক মূর্খ, দরিদ্র ও গোত্রভিত্তিক সমাজের সাদাসিদা জীবন যাপনে অভ্যস্ত। বিশ্বব্যাপী হেদায়াতের ধারক বাহক আখেরি পয়গম্বরের জন্য, ধনে-জ্ঞানে উন্নত ভূখণ্ডগুলো রেখে, অনুন্নত আরবকে আল্লাহ কেন নির্বাচন করলেন? এটা বুঝতে হলে আমাদের জাজিরাতুল আরবের অবস্থান, এখানকার মানুষগুলোর ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণগুলো একটু পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
জাযিরাতুল আরব : এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার মিলনস্থলের কাছাকাছি-এর অবস্থান। অধিকাংশ দেশের সমান দূরত্বে অবস্থিত। বিশ্বব্যাপী দাওয়াতের প্রচার ও নেতৃত্বের জন্য অত্যন্ত উপযোগী একটি কেন্দ্রভূমি। তিন দিক থেকে পারস্য উপসাগর ও লোহিত সাগরের গভীর জলরাশি। অন্যদিকে বিশাল মরুভূমির বেষ্টন। প্রতিরক্ষার দিক দিয়ে একটি অজেয় দুর্গের মতো। হাজার বছরের ইতিহাসে কেউই এ ভূমি দখল করার দুঃসাহস দেখায়নি। মিশরের ফেরাউন, গ্রিসের আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, বেবিলনের বুখতে নসর, পারস্যের কোরেশের মতো বিজেতারা কেউ এখানে চোখ তুলে তাকায়নি। রোমান সম্রাট অগস্টাসের শখ জেগেছিল এ ভূখণ্ড দখল করার। খ্রিষ্টপূর্ব ২৪ সালে এক বিরাট সেনাবাহিনী পাঠায় আরব অভিমুখে। তপ্ত মরুভূমির ক্রোধ ও পানি শূন্যতা তাদের অভিযান ব্যর্থ করে দেয়। আরবের অধিবাসীরা ছিল স্বাধীনচেতা। কেউ তাদের গোলামের জিনজিরে আবদ্ধ করতে পারেনি কখনো। তাই তারা ছিল সাহসী ও কর্মঠ। এর বিপরীতে শতাব্দী কাল ধরে দাসত্বের কারণে ইহুদিরা হয়ে পড়েছিল ভীরু ও হীনবল। গোপন চক্রান্তে তারা ছিল বেশ পটু। অপরদিকে রোমান পারসিকরা দীর্ঘসময় রাজত্বের সুযোগে অহংকারী হয়ে পড়েছিল। সুতরাং বলা যায়, নতুন এক ঐশী বিপ্লবের জন্য আরব ছিল পূর্ণ উপযোগী।
আরবদের ধর্ম কর্ম ও চরিত্র : এখানকার অধিবাসীরা সবাই ছিল ইবরাহিম (আ.)-এর শরীয়তের পাক্কা অনুসারী। ঐশী ধর্মের প্রতি তাদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের এ ধারা বহাল ছিল বহু শতাব্দীকাল ধরে। তাদের অধঃপতন শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ শতক থেকে। ধীরে ধীরে তারা দ্বীনে হক থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। সর্বশেষ খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে তারা মূর্তিপূজার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। মূর্তি পূজারিদের সঙ্গে সখ্য, ধর্মীয় নেতাদের স্বেচ্ছাচারিতা, বিজাতিদের অন্ধ অনুকরণ তাদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। মূর্তিতে ছেয়ে যায় পুরো আরব। শত শত মূর্তিতে ভরে যায় পবিত্র কাবা।
ঐতিহাসিক ইবনে কালবির ভাষায়- ‘মক্কার প্রতিটি ঘরে একটা করে মূর্তি ছিল। মানুষ যার উপাসনা করত। কেউ সফরে বের হলে মূর্তিকে স্পর্শ করে বের হতো। ফিরে এসে সবার আগে মূর্তিটাকে চুমু খেত’ (আল আসনাম পৃষ্ঠা ৩৩)। এভাবে ধীরে ধীরে তারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। কথায় কথায় লড়াই-ঝগড়া, সামান্য মতবিরোধে যুদ্ধ বাঁধানো তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়। এক একটি যুদ্ধ চলতে থাকে যুগ যুগ ধরে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম। মদণ্ডজুয়ার মহামারি ভয়ংকর আকার ধারণ করেছিল। নারীদের কোনো মূল্য ছিল না এ সমাজে। তাদের দেখত ভোগ্যপণ্য হিসেবে। একজন যত ইচ্ছা নারী সঙ্গী রাখত। যেনার সন্তানদের সামাজিকভাবে বৈধতা দেয়া হয়েছিল। ফলে যেনা ব্যভিচার ব্যাপকতা লাভ করেছিল। ঔরশজাত কন্যাকে জীবন্ত কবর দিতে পিতার হাত কাঁপত না। নারী জাতিকে মনে করা হতো সমাজের বোঝা। তাদের চারিত্রিক দুরবস্থার চিত্র এঁকেছেন হজরত জাফর (রা.) বাদশা নাজ্জাশীর সামনে। ‘মহামান্য বাদশা! আমরা ছিলাম মূর্খ জাতি। মূর্তি পূজা করতাম। মৃত প্রাণী খেতাম। সব ধরনের নির্লজ্জতা ও পাপে লিপ্ত থাকতাম। আমাদের শক্তিশালীরা দুর্বলদের ভক্ষণ করত। (মুসনাদ আহমদ, পৃষ্ঠা ২০২ থেকে ২০৩)। এত কিছুর পরেও হজ, ওমরা, খতনার মতো ইবরাহিমি শরীয়াতের মৌলিক কিছু বিষয়ে তারা ছিল অতি যত্নবান। এছাড়াও তাদের মাঝে এমন কিছু গুণ বিদ্যমান ছিল, যা ছিল তখনকার পৃথিবীতে বিরল। আসমানি কিতাবের ধ্বজাধারীরা তা খুইয়ে বসেছিল বহু আগে। এরা ছিল সত্যবাদী নির্ভেজাল প্রকৃতির। সাদাসিধা জীবনযাপন করত। বীরত্ব ছিল তাদের রক্তে মেশানো। সচেতন ও কষ্ট সহিষ্ণু জাতি হিসেবে তাদের সুনাম ছিল। বিলাসিতা, ধোকা, প্রতারণা তাদের স্বভাবে ছিল না।
মক্কার নিরাপত্তায় ইবরাহিম নবীর দোয়া : বনু ইসমাইল বসবাস করতে মক্কায়। যা হজরত ইসমাইল (আ).-এর হাতে আবাদ হয়েছিল। এ শহরের নিরাপত্তা জন্য এবং এর অধিবাসীদের জন্য উত্তম খাবারের প্রার্থনা করেছিলেন হজরত ইবরাহিম (আ.)। ‘হে আমার প্রতিপালক, তুমি এই শহরকে নিরাপদ শহর বানিয়ে দাও।’ ( সুরা ইব্রাহিম : ৩৫ ও ৩৭)।
আরবে মূর্তি পূজার সূচনা : শুরু থেকে বনু ইসমাইলের হাতে ছিল মক্কার নেতৃত্ব। বনু জুরহুম থাকত তাদের অধীনে। এরপর বনু ইসমাইলের দুর্বলতার সুযোগ নেয় বনু জুরহুম। ছলেবলে কৌশলে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয় বনু ইসমাইল থেকে। এরপর সুদীর্ঘকাল তাদের হাতেই ছিল ক্ষমতার বাগডোর। এরপর বনু খোজায়া নামে এক গোত্র যুদ্ধ বিগ্রহ করে মক্কার শাসন ক্ষমতা দখল করে। তারা ৩০০ বছর মক্কার নেতৃত্ব দেয়। তাদের হাত ধরেই আরবে মূর্তিপূজার প্রচলন ঘটে।
নবীর পূর্ব পুরুষ : এই সুদীর্ঘ সময় বনু ইসমাইলে এমন কোনো বীর বাহাদুরের আগমন ঘটেনি, যে পূর্ব-পুরুষের ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করবে। মর্যাদার আসনটির লাজ রক্ষা করবে। অবশেষে তাদের ভাগ্য তারকা ঝলমলিয়ে ওঠে। কুসাই বিন কিলাবের আগমন হয়। রাজনীতিতে অভিজ্ঞ, নেতৃত্বে দক্ষ এই সরদার। বিশৃঙ্খল বনু ইসমাইলকে একত্রিত করেন তিনি। তাদের নিয়ে পূর্ব-পুরুষদের হারানো ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন। সংঘবদ্ধ এই বনু ইসমাইলকে কুরাইশ বলা হয়। আস্তে আস্তে কুরাইশদের সুনাম সুখ্যাতি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে আব্দে মানাফের পুত্র হাশেমের নেতৃত্বে কোরাইশদের সোনালি অধ্যায়ের সূচনা হয়। তিনি কুরাইশদের আঞ্চলিক ব্যবসাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিয়ে যান। রোম সম্রাট কায়সার থেকে অনুমতিনামা নিয়ে আসেন, শাম?- ইয়েমেনে নিরাপদে ব্যবসা করার জন্য। কায়সারের ফরমান দেখে চোর লুটেরাও পথ ছেড়ে দেয় কুরাইশ কাফেলার। শুরু হয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির নতুন যুগ। হাশেমের অসাধারণ নেতৃত্ব কুরাইশকে আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ গোত্রের মর্যাদায় আসীন করে। হাশেমের ঘরে জন্ম নেয় এক বাহাদুর। নাম শাইবা। পৃথিবী তাকে আবদুল মুত্তালিব নামে চিনে। রাহমাতুল্লাহি আলামিনের দাদা তিনি। কুরাইশের শীর্ষ স্থানীয় মর্যাদাবান নেতাদের মাঝে তিনি অন্যতম। তার হাতে পুনরুদ্ধার হয় হারিয়ে যাওয়া বরকতময় জমজমের। এর মাধ্যমে আব্দুল মোত্তালেব লাভ করেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। তার এখন ১০ ছেলে। তাদের মাঝে সবচেয়ে সুন্দর, ভদ্র, লাজুক ছেলেটির নাম আব্দুল্লাহ। আব্দুল মোত্তালেব তাকে সবচেয়ে বেশি স্নেহ করেন। কুরাইশ নেতাদের কাছেও আব্দুল্লাহর রয়েছে আলাদা কদর। তার উজ্জ্বল তারুণ্য ও জাদুময়ী বচনভঙ্গি যে কাউকে আকৃষ্ট করত। মক্কার অভিজাত গোত্রগুলোর বহু সুন্দরী মেয়ে তার জীবন সঙ্গীনি হওয়ার জন্য উতলা ছিল।
আব্দুল মোত্তালেবের হঠাৎ একদিন মনে হলো তার মানতের কথা। তিনি ১০ ছেলের পিতা হলে একজনকে কাবার মালিকের জন্য কোরবানি দেবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। এখন সে সময় এসে গেছে। বিপাকে পড়লেন, কাকে কোরবানি ইশ, অমন মায়াবী ছেলেটা চোখের সামনে কোরবানি হবে! আব্দুল মোত্তালেবের হাত কাঁপছে। তিনি তার সবচেয়ে প্রিয় ছেলেটার গলায় ছুরি চালাবেন! মন মানছে না। কিন্তু তিনি অটল। তাকে মানত পুরা করতেই হবে। বালক আব্দুল্লাহ শুয়ে পড়ল। ছুরি হাতে আব্দুল মুত্তালিব। চারদিকে কান্নার রোল। এমন করুণ দৃশ্য সহ্য হচ্ছে না কুরাইশ সর্দারদেরও। আব্দুল মুত্তালিবকে বাধা দিল তারা। না, তুমি এটা করতে পারো না! চল আমরা বিকল্প দেখি। গণক, পণ্ডিতদের কাছে যাই। জবাই হতে হতেও বেঁচে গেল আব্দুল্লাহ। এ যেন দ্বিতীয় ইসমাইল। তার বিনিময় কোরবানি হলো ১০০ উট। এ ঘটনায় আব্দুল্লার জন্য সবার ভালোবাসা যেন আরো বেড়ে গেল।
মহানবীর বাবা-মা : আব্দুল্লাহর জন্য পাত্রী দেখলেন আব্দুল মুত্তালিব। কুরাইশ বংশেরই বনু জোহরা গোত্রের সরদারের মেয়ে। আমেনা বিনতে ওয়াহহাব। রূপেগুণে অনন্য তিনি। লজ্জা তার স্বভাব। বিনয় তার অলংকার। কুরাইশের অভিজাত মেয়েদের অন্যতম তিনি। মহাআয়োজনে সম্পন্ন হলো বিয়ে। শুরু হলো আব্দুল্লাহ-আমেনার সুখের সংসার। কী সৌভাগ্য তাদের! বিশ্ব নবীর পিতা-মাতা তারা। তাদের ঘরে আগমন করবেন সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। কিন্তু তাদের সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। মাস ছয়েক পর ব্যবসার কাজে শামে যাবে আব্দুল্লাহ। অশ্রু সজল চোখে প্রিয়তম স্বামীকে বিদায় জানালো আমেনা। কিন্তু কে জানত এই দেখাই তার শেষ দেখা হবে! প্রিয়তম স্বামীকে ছেড়ে আমেনার দিন যেন কাটতে চায় না। পথ পানে চেয়ে থাকে সে। স্বামী তার কখন আসে, কখন আসে। সে আর এলো না। এলো তার মৃত্যু সংবাদ। ফেরার পথে অসুস্থ হয়ে ইয়াসরিবে ইন্তেকাল করেছে আব্দুল্লাহ। আমেনার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। শোকে মুষড়ে পড়লেন তিনি। অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিচলিত হলেন। আহ দুনিয়াতে আসার আগেই এতিম হয়ে গেল সন্তানটা। এখন কী হবে? গায়েবি সান্ত¦না পেলেন আমেনা। তিনি তখন গভীর ঘুমে। স্বপ্নে দেখলেন- তার হৃদয় থেকে একটি আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। পূর্ব-পশ্চিমের সবকিছু যে আলোয় আলোকিত। এমন নানান আশ্চর্যজনক স্বপ্ন তার আশা জোগাত। সান্ত¦নার কারণ হতো। রাসুলে আরাবির আগমনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। এক মহাবিপ্লবের জন্য প্রস্তুত পৃথিবী। শুরু হলো আল্লাহর কুদরতের বহিঃপ্রকাশ। অহংকারী বাদশাহ আবরাহা এসেছিল পবিত্র কাবাঘর ধ্বংস করতে। তার সঙ্গে বিশাল শক্তিশালী হস্তিবাহিনী। যেন নিমিষেই ধুলোয় মিশিয়ে দেবে বাইতুল্লাহকে। উল্টো নিজেই কুপোকাত হলো- ক্ষুদ্র পাখির কাছে। পুরো বাহিনী ধ্বংস হলো। দৃষ্টান্তমূলক মৃত্যু হলো আবরাহার। এর ৪০ দিন পর। এলো সেই খুশির দিন। সেই শুভ মুহূর্ত। যার অপেক্ষায় নভোমণ্ডল-ভূমণ্ডলের ক্ষুদ্রকণা পর্যন্ত অধীর ছিল। দিনটি ছিল সোমবার। মায়াবী রাতের আঁধার চিড়ে উদ্ভাসিত হলো এক সুন্দর ভোর। এ মিষ্টি ভোরে ধরায় আগমন করেন মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে উঠল কুল মাখলুকাত। আকাশে বাতাসে তারই আগমনধ্বনি। আমেনার কোল আলোকিত হলো। শোকাতুর আমিনা নবজাতক শিশুকে দেখে দুঃখ ভুলে গেলেন। পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও সুন্দর এমন নাতি পেয়ে বৃদ্ধ আব্দুল মোত্তালেবের খুশি আর কে দেখে! পুত্রশোক ভুলে নাতিকে কোলে নিয়ে প্রবেশ করলেন বাইতুল্লায়। কাকুতি-মিনতিপূর্ণ প্রার্থনা করলেন কাবার মালিকের দরবারে। নাম রাখলেন মুহাম্মাদ। বাতাসের গতিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল এ খুশির সংবাদ। মানুষের ঢল নামলো আমেনার গৃহে।
রাসুলের এশুভ আগমনের চমৎকার ছবি এঁকেছেন কবি আল মাহমুদ তাঁর কবিতায়-
গভীর আঁধার কেটে ভেসে উঠে আলোর গোলক,
সমস্ত পৃথিবী যেন গায়ে মাখে জ্যোতির পরাগ;
তাঁর পদপ্রান্তে লেগে নড়ে ওঠে কালের দোলক,
বিশ্বাসে নরম হয় আমাদের বিশাল ভূভাগ।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইফতা প্রথম বর্ষ, জামিয়া আরাবিয়া এমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ।