কেমন হবেন ন্যায়বিচারক?
আব্দুল্লাহ আযযাম সানিয়্যাত
প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
দ্বন্দ্ব-সংঘাত, বিবাদ-বিসম্বাদ মানবসমাজে দৈনন্দিন সংঘটিত একটি বিষয়। সমাজের কলহ-বিবাদ নিরসনে এবং আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে পক্ষপাতহীন ইনসাফপূর্ণ বিচার নিশ্চিত করার গুরুত্ব অপরিসীম। কোরআন, হাদিসে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হয়েছে। বিচারকার্য পরিচালনা করা একটি জটিল ও কঠিন কাজ। তাই বিচারকের মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকা আবশ্যক, যার দ্বারা তিনি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সক্ষম হবেন। একজন ন্যায় বিচারক কেমন হবেন? নিম্নে কোরআন-হাদিসের আলোকে তার বিবরণ দেয়া হলো।
ঐশী জ্ঞানের অধিকারী হওয়া : একজন বিচারকের জন্য কোরআন এবং হাদিসের জ্ঞান অর্জন করা অত্যাবশ্যক। একমাত্র ঐশী বিধানেই পারে মানুষের মধ্যে ইনসাফ কায়েম করতে। দুনিয়াবি কোনো মতাদর্শে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। নবীজি মুয়াজ (রা.) কে ইয়ামেনের শাসক ও বিচারক হিসাবে প্রেরণকালে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, হে মুয়াজ! কীসের আলোকে বিচারকার্য পরিচালনা করবে? উত্তরে তিনি বললেন, কোরআনের আলোকে। নবীজি বললেন, যদি কোরআনে না পাও? তিনি বললেন, রাসুলুল্লাহর সুন্নাতের আলোকে (আবু দাউদ : ৩৫৯২)। চার ইমামসহ সব ইসলামিক বিশেষজ্ঞ এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, কোরআন-হাদিসের জ্ঞান ব্যতীত বিচারকের আসনে বসা বৈধ নয়। (আকজিয়াতুর-রাসুল)।
প্রজ্ঞাসম্পন্ন গবেষণা মনস্ক হওয়া : একজন বিচারকের জন্য কোরআন, হাদিসের জ্ঞানের পাশাপাশি প্রজ্ঞাবান, দূরদর্শী এবং গবেষণা প্রয়াসী হওয়া জরুরি। কারণ, বিচারক সত্য ও সঠিক বিচারের জন্য আদিষ্ট। আল্লাহ বলেন, হে দাউদ আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি বানিয়েছি। অতএব, তুমি মানুষের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে বিচার কর এবং খেয়াল-খুশির অনুসরণ কর না (সুরা সোয়াদ : ২৬)। ন্যায়সঙ্গত বিচার তখনি সম্ভব, যখন কোনো ব্যক্তি ঐশী জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রজ্ঞাবান হবেন। দূরদর্শী ও গবেষণা মনস্ক হবেন। কেননা, কোরআন হাদিসের নস-অধ্যাদেশ সীমাবদ্ধ কিন্তু নিত্যনতুন সংঘটিত ঘটনাবলি অনেক। তাই, সব ঘটনার হুকুম সরাসরি কোরআন এবং হাদিসে পাওয়া নাও যেতে পারে। তখন বিজ্ঞ বিচারকের দায়িত্ব হবে নিজ প্রজ্ঞার আলোকে কোরআন, সুন্নাহয় গবেষণা করে তার হুকুম বের করা। যেমন মুয়াজকে যখন নবীজি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, যদি কোরআন হাদিসের কোথাও সেই হুকুম না পাও, তাহলে কী করবে? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আমি নিজের বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা গবেষণা করব। তখন নবীজি বলেছিলেন, সব প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি তার রাসুলের প্রতিনিধিকে এমন প্রজ্ঞা দিয়েছেন যাতে তিনি সন্তুষ্ট (আবু দাউদ : ৩৫৯২)।
ন্যায়পরায়ণ হওয়া : আল্লাহতায়ালা নিজে ন্যায়পরায়ণ এবং ন্যায়পরায়ণতাকে ভালোবাসেন। তিনি বান্দাকেও ন্যায়পরায়ণ হওয়ার শিক্ষা দেন। কোরআনে এসেছে- নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ন্যায়পরায়ণতার আদেশ করেন (সুরা নাহল : ৯০)। বিশেষত বিচারিককার্যে নিরপেক্ষ, ন্যায়পরায়ণ হওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সুরা নিসায় বিচারকদের সম্বোধন করে আল্লাহ বলেছেন- আর যখন তোমরা মানুষের মধ্যে বিচারকার্য করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচারকার্য সম্পাদন কর (৫৮)। ইমাম শাফেয়ি বলেন, যার মধ্যে ন্যায়পরায়ণতা নেই, সে বিচারক হওয়ার যোগ্য নয়। এমতাবস্থায়, সে যদি বিচারকার্য করে, তাহলে তা কার্যকর হবে না (আদাবুল-কাজি : ১২৯)।
স্বপক্ষপ্রিত না হওয়া : পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপ্রীতি কিংবা স্বদলপ্রীতি সর্বক্ষেত্রে খারাপ। বিচারিককার্যে পক্ষপ্রীতি ঘোরতর অপরাধ। ন্যায় ও কল্যাণের কাজে গোত্রপ্রীতি, পক্ষপাতিত্ব অন্যায় নয়। তবে অন্যায়-অত্যাচারে স্বদলীয় লোকদের সহযোগিতা করা নিষিদ্ধ সাম্প্রদায়িকতা। হাদিসের পরিভাষায় যাকে আসাবিয়্যাত বলা হয়। একজন বিচারককে অবশ্যই নিষিদ্ধ সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত হতে হবে। নবীজি বলেছেন- যে ব্যক্তি পক্ষপ্রীতি করে বা ডাকে এবং সেই অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, সে আমাদের (মুসলমানদের) দলভুক্ত নয় (আবু দাউদ : ৫১২১০। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, রাষ্ট্রীয় ও সমাজব্যবস্থায় যারা বিচারিক দায়িত্বে আছেন, তাদের অধিকাংশই দলীয়প্রীতি দোষে দোষী। আর একটি দেশ ও জাতি ধ্বংসের জন্য এটাই যথেষ্ট। নবীজি কখনোই অন্যায় পক্ষপাতিত্ব করেননি। দেশ ও জাতি বাঁচাতে। অন্যায়, অবিচারমুক্ত সাম্যের সমাজ গড়তে পক্ষপাতমুক্ত বিচারকের গুরুত্ব অপরিসীম।
আল্লাহভীতু হওয়া : ইমাম মালিক (রহ.) বলেন, বিচারকের জন্য ইলম, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও আল্লাহভীতি অবশ্য প্রয়োজনীয়। বর্তমানে আমি কারো মধ্যেই সবগুলো দেখি না। তবে কারো মধ্যে যদি ইলম ও আল্লাহভীতি থাকে তবে তাকে বিচারক হিসাবে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। আব্দুল মালিক (রহ.) বলেন, বিচারকের জন্য তাকওয়া-আল্লাহভীতি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়, কারণ আল্লাহভীতির মাধ্যমেই সে যাবতীয় অন্যায়-বিচারাচার থেকে বিরত থাকবে (আকজিয়াতুর-রাসুল)। অন্যায় বিচার মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া। অন্যায় করতে সাহায্য করা। অন্যায়ে সাহায্যকারীর পরিণাম বড়ই ভয়াবহ। আল্লাহ বলেন, গোনাহ এবং অবাধ্যতায় (অন্যায় বিচারে) তোমরা পরম্পরকে সাহায্য কর না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চই আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী (সুরা মায়েদা : ২)। যার অন্তর সদা আল্লাহর ভয়ে জাগরুক থাকে, সে কখনো অন্যায় বিচার করতে পারে না।
পরামর্শের মানসিকতাসম্পন্ন হওয়া : পরামর্শ সাপেক্ষে কাজ করা রবের আদেশ। আল্লাহ নবীজিকে সম্বোধন করে বলেছেন এবং কাজ-কর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করুণ (সুরা আলে-ইমরান : ১৫৯)। বিচারকার্য যেহুতু জটিল বিষয় সেহেতু জটিল মামলা-মোকাদ্দামায় সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পরামর্শ করা দরকার। ইমাম আহমাদ (রহ.) বলেন, যে মুকাদ্দামার রায় সম্পর্কে কোরআন-হাদিসের ¯পষ্ট অধ্যাদেশ আছে, সে বিষয়ে পরামর্শ করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যে বিষয়ে স্পষ্ট অধ্যাদেশ নেই সেই বিষয়ে পরামর্শ করা চাই (আদাবুল কাজী : ৩৭০)। প্রচলিত আইনের ক্ষেত্রেও ধারায় সবকিছু সুস্পষ্টভাবে বলা থাকে না। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই পরামর্শ করা উচিত।
রাগতাবস্থায় বিচারকার্য না করা : বিচারকের দায়িত্ব মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসনে ঠান্ডা মাথায় বিচারকার্য পরিচালনা করা। ক্রুদ্ধ ও রুষ্ট অবস্থায় সমাধানে উপনীত হওয়া উচিত নয়। কারণ উত্তেজিত ও রাগতাবস্থায় ব্যক্তি সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়। একজন আদর্শ বিচারক বিচারাবস্থায় অবশ্যই রাগকে নিয়ন্ত্রণ করবেন। অথবা রাগাবস্থায় রায় প্রদান থেকে বিরত থাকবেন। নবীজি বলেছেন, বিচারক রাগান্বিত অবস্থায় দুই ব্যক্তির মাঝে ফায়সালা দেবেন না (আদাবুল কাজী ২ : ২)। নবীজির এই বাণীকে মাথায় রেখে চললে বিচারপ্রার্থী কেউ অন্যায়ের স্বীকার হবেন না।
উপঢৌকন গ্রহণে বিরত থাকা : হাদিয়া-উপঢৌকন দেয়া-নেয়া বৈধ। অনেক ক্ষেত্রে সুন্নাতও বটে। তবে সরকারি কর্মচারী বিশেষত বিচারক এবং বিচার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উপঢৌকন গ্রহণ করা উচিত নয়। এতে বিচারকার্যে ন্যায্যতা বিঘ্নিত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে। সাহাবি আবু সাঈদ খুদরি (রা.) নবীজি থেকে বর্নণা করেন, আমিরদের (শাসক, প্রশাসক, বিচারক) উপঢৌকন ধোঁকা মিশ্রিত অতিরঞ্জন (আল মুসনাদ : ৭০৭৩)। নবীজি ইবনে রাওয়াহাকে (শাসক হিসাবে) খায়বারে প্রেরণ করলে, খায়বারবাসী তার কাছে উপঢৌকন পেশ করেন। তিনি তা ফেরত দেন এবং বলেন, এগুলো অবৈধ-হারাম (আদাবুল কাজী) ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রা.) কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আপনি হাদিয়া গ্রহণ করেন না কেন, অথচ নবীজি হাদিয়া গ্রহণ করতেন? উত্তরে তিনি বলেন, নবী যুগে যেগুলো হাদিয়া-উপঢৌকন ছিল বর্তমান সমাজে সেগুলো ঘুস (আদাবুল কাজী ২ : ৪০)। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে একজন বিচারকের জন্য উপঢৌকন গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা জরুরি।
লেখক : খতিব ও মুহাদ্দিস