স্মরণ

উম্মাহর একজন দরদি অভিভাবক ছিলেন

আল্লামা শামসুদ্দীন কাসেমী (রহ.)

প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী

জন্ম-মৃত্যু সৃষ্টিকর্তার এক অমোঘ বিধান। যার যখন ডাক আসে, তাকে তখনই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়। বিশাল এ পৃথিবীতে এমন কত মানুষই প্রতিদিন মৃত্যুবরণ করে, যাদের অল্প কিছু দিন পরই মানুষ ভুলে যায়। বিপরীতে সংখ্যাটা ওই তুলনায় কম হলেও এমন কিছু গুণিজন-গুরুজন পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন যাদের তাদের ভক্তকুল নিয়মিত স্মরণ করেন এবং তাদের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন নিয়ে প্রতিনিয়ত স্মৃতিচারণ করেন। পরম শ্রদ্ধেয় উস্তাদ মুজাহিদে মিল্লাত আল্লামা শামসুদ্দীন কাসেমী (রহ.) তাদেরই একজন। জ্ঞানের গভীরতা, কর্মদক্ষতা, সাহস, দৃঢ়তা, আত্মমর্যাদাবোধ ও ত্যাগের মনোভাবসহ বহুমাত্রিক গুণের সমন্বিত এক প্রতিচ্ছবি ছিলেন এই মনীষী। স্বাধীনতাপূর্ব ও স্বাধীনতাণ্ডপরবর্তী বাংলাদেশের উভয় সময়ে তার কর্ম ও অবদান চিরস্মরণীয়। এক কথায় তিনি উম্মাহর একজন দরদি অভিভাবক হিসেবে আবির্ভূত হয়ে ইসলাম, দেশ ও জাতির কল্যাণে প্রতিটি ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন-সংগ্রামে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন।

জন্ম ও শিক্ষা : আল্লামা শামসুদ্দীন কাসেমী (রহ.) ১৯৩৫ সালের ৫ মার্চ চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ থানার অন্তর্গত ন্যায়ামস্তি এলাকায় এক শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত ও ধার্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মোহাম্মাদ মোদ্দাসসের। তিনি মরহুম আলী মুন্সী সাহেবের বংশধর, যিনি তৎকালীন সময়ে একজন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ এবং ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ ছিলেন। নিজ গ্রামের মক্তব ও প্রাথমিক বিদ্যালয়েই তিনি শিক্ষা জীবনের সূচনা করেন। এরপর ভর্তি হন স্থানীয় রিয়াজুল উলুম মাদ্রাসায়। এক পর্যায়ে এই মাদ্রাসারই শিক্ষক মোহাম্মাদ মূসা সাহেবের পরামর্শে তিনি ভর্তি হন সন্দ্বীপ হরিশপুর বশীরিয়া আহমদিয়া সিনিয়র মাদ্রাসায় এবং এই প্রতিষ্ঠান থেকেই তিনি দাখিল, আলিম ও ফাজিল পাস করেন এবং প্রতিটি স্তরের পরীক্ষায় ঈর্ষণীয় সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখেন। ১৯৫৫ সালে তিনি বিশ্ববিখ্যাত দ্বীনি বিদ্যাপিঠ দারুল উলুম দেওবন্দে গমন করেন। সেখানে তিনি হাদিস, ফেকাহ, মানতেক ইত্যাদি শাস্ত্রের উপর ব্যুৎপত্তি অর্জন করে শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে দু’বছর পর নিজ এলাকায় ফিরে এসে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া আরাবিয়া ইসলামিয়া জিরি মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৯৫৮ সালে তিনি জামেয়া আশরাফিয়া লাহোরে ভর্তি হন এবং এখান থেকে দাওরায়ে হাদিস ও উচ্চতর তাফসির শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ১৯৬০ সালে তিনি শায়খুত তাফসির হজরত মাওলানা আহমদ আলী লাহোরী (রহ.)-এর তাফসির কোর্সে ভর্তি হন এবং তাফসির শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।

কর্মজীবন : ১৯৬১ সালে তিনি লাহোর থেকে প্রত্যাবর্তন করে ময়মনসিংহ সোহাগী মাদ্রাসায় এসে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে কর্মজীবনের সূচনা করেন। এরপর ঢাকায় এসে জামেয়া হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম বড় কাটরা মাদ্রাসায় ২ বছর এবং জামেয়া আরাবিয়া এমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ মাদ্রাসায় ৬ থেকে ৭ বছর শিক্ষকতা করেন। বড় কাটরা মাদ্রাসায় তিনি সদরুল মুদাররিস ও মুহাদ্দিস হিসেব দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭০ সালে তিনি জামেয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠায় অংশগ্রহণ করেন এবং ১ বছর অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একই সালে তার পৃষ্ঠপোষকতায় মিরপুরের জামেয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে পাকহানাদার বাহিনী এই প্রতিষ্ঠানটিকে জ্বালিয়ে দিলে তিনি গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়ে চট্টগ্রামের আল জামেয়া আল মাদানিয়ার মুহতামিম ও দামপাড়া বায়তুল আজীজ জামে মসজিদের ইমামণ্ডখতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে মিরপুরের জামেয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৭৬ সালে মুহতামিমের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তখন থেকে আমৃত্যু এই প্রতিষ্ঠানেই তিনি অবর্ণনীয় কোরবানি দিয়ে যান। এ ছাড়াও তিনি সাভার রাজফুলবাড়িয়া মাদ্রাসা ও আমিনবাজার মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাসহ দেশের অসংখ্য মাদ্রাসা-মসজিদের পৃষ্ঠপোষকতায় নিজেকে নিবেদিত রেখেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক জীবন : তিনি তিন তিনবার জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালের ১৬ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তের কমিটি গঠিত হলে হজরত মাওলানা আব্দুল করীম শায়খে কৌড়িয়া (রহ.) সভাপতি এবং তিনি সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ জমিয়তের সহ-সভাপতি এবং ১৯৭৭ ও ১৯৮০ সালে পরপর ২বার মহাসচিব নির্বাচিত হন। তার দূরদর্শী ভূমিকায় তৎকালীন জমিয়ত ১৯৭১ সালের ২২ মার্চ রেজুলেশন করে স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সমর্থন জানায় এবং দেশবাসীকে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি প্রকাশ্যে পাক হানাদার বাহিনীর বিরোধিতা করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে কলম ধরেন। মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন। এমনকি ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কে জনসভার আয়োজন করে উক্ত জনসভায় তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কড়া বক্তব্যও রাখেন। এ কারণে পাক সেনারা তখন তাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করে রাখে।

অদম্য মনোবলের অধিকারী এই প্রবাদ পুরুষ ভোগে নয় বরং ত্যাগেই গোটা জীবন পার করেছেন। মহান আল্লাহর দয়ায় অভাব ও অর্থ সংকট কখনো তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। লোভণ্ডলালসাও কখনো তার পিছু নিতে পারেনি। ঈমানি আকিদা-বিশ্বাসের সুরক্ষায় সকল ভ্রান্ত মতবাদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন একজন লৌহমানব। ভ্রান্ত মতাদর্শসমূহের মূলোৎপাটনে তিনি থাকতেন সদাব্যস্ত। ঈমান বিধ্বংসী সব আকায়েদ সম্পর্কে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সচেতন করতে তিনি নিরন্তর ছুটে চলতেন জেলায় জেলায় ও গ্রামে গ্রামে। সৌভাগ্যক্রমে এ রকম কিছু দ্বীনি সফরে আমিও ছিলাম এই কিংবদন্তির সঙ্গে। টানা এক সপ্তাহের সফরে কাছে থেকে দেখেছি উম্মাহর ঈমান রক্ষায় তার অস্থিরতা ও ব্যাকুলতার দৃশ্যাবলি। আকিদা-বিশ্বাস সংক্রান্ত মুনাজারা বা বিতর্কে তার পারঙ্গমতা ছিল বিস্ময়কর। প্রতিপক্ষকে শক্তিশালী দলিল-প্রমাণে কাবু করে ফেলতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।

বিশেষভাবে উলে¬খ্য যে, দারুল উলুম দেওবন্দ মূলত কোনো বিল্ডিং বা অবকাঠামোর নাম নয়। দারুল উলুম দেওবন্দ হলো একটি নির্দিষ্ট চিন্তা-দর্শনের নাম। বাংলাদেশে হাতে গোনা বড় বড় যে কয়জন এই চিন্তা-দর্শনের ধারক ও বাহক ছিলেন এবং গোটা দেশে এই চিন্তা-চেতনাকে বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা দানে যে কয়জন বিশিষ্ট আলেম দিবানিশি অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন আল্লামা শামসুদ্দীন কাসেমী (রহ.) তাদের মধ্যে অন্যতম শীর্ষ একজন।

রচনাবলি : তার রচিত বইগুলোর মধ্যে অন্যতম কয়েকটি বই হলো, শিয়া কাফের, কাদিয়ানী ধর্মমত, পাকিস্তানে খ্রিষ্টান মিশনারির উৎপাত, ইসলাম বনাম কমিউনিজম, ধর্মনিরপেক্ষতা ও রমজানের সওগাঁত ইত্যাদি।

দ্বীন ও ইসলামের এই অতন্দ্র প্রহরী ১৯৯৬ সালের ১৯ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন। বরেণ্য বুজুর্গ ও জমিয়তের তৎকালীন কাণ্ডারি হজরত মাওলানা আব্দুল করীম শায়খে কৌড়িয়া (রহ.)-এর ইমামতিতে মিরপুর বুদ্ধিজীবী শহিদ মিনার ঈদগাহ ময়দানে তার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয় এবং মিরপুরস্থ শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের পার্শ্ববর্তী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। মহান আল্লাহ ক্ষণজন্মা এই আলেমে দ্বীনকে জান্নাতুল ফেরদাউসের মেহমান হিসেবে কবুল করুন, আমিন।

লেখক : শাইখুল হাদিস ও প্রিন্সিপাল, জামেয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা।