স্মরণ
বিশ্ববরেণ্য ভাষাবিজ্ঞানী ড. প্রফেসর ভি আব্দুর রহীম
প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য প্রফেসর ড. ভি আব্দুর রহিম (রহ.)। তিনি একজন ভারতীয়, ভারতের তামিলনাড়ুর
ভানিয়াবাদি। তার শিক্ষকতা জীবন শুরু হয়েছিল ভারতে ইংরেজি সাহিত্যের প্রফেসর হিসেবে, পরে তিনি হয়ে যান মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি সাহিত্যের প্রফেসর। গভীর জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যে তিনি নিজের নাম লিখিয়েছেন বিশর আলহাফি, আল্লামা জামাখশারি, ইমাম নববী, ইমাম ইবনু তাইমিয়া, ইমাম আলজাহিজ এর কাতারে। তিনি ছিলেন জ্ঞান সাধনায় মগ্ন এক চিরকুমার। তার সম্পর্কে লিখেছেন কোরআনিক সাইন্সের গবেষক ড.আবদুস সালাম আজাদী।
১৯ অক্টোবর ২০২৩ ফেইসবুকের মাধ্যমে জানতে পারলাম আমার উস্তাায প্রফেসর ড. ভি আব্দুর রহীম ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহুম্মা আজিরনি ফী মুসিবাতি, ওয়া আখলিফ লি খায়রান মিনহা। আল্লাহ তার সৎ আমলসমূহ কবুল করুন, এবং নাবিয়্যিন সিদ্দীক্বীন শুহাদা ওয়া সালিহীনের সাথে তাকে জান্নাতুল ফেরদাউসের উচ্চ মাক্বামে অভিসিক্ত করুন, আমিন।
তিনি ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের ভানিয়ামাবাদে সাতই মে ১৯৩৩ সালে জন্মগ্রহন করেন। নিজ গ্রামেই তিনি পড়াশুনা করেছেন। পার্শ্ববর্তী গ্রামে পড়েছেন সেকেন্ডারি, সেখান থেকেই তিনি আরবি ঐচ্ছিক বিষয় নিয়ে পড়েন। তিনি সেরা ছাত্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন স্টাডির বিভিন্ন পর্যায়ে। কলেজ লাইফ শেষ করে মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন ইংলিশ ভাষা ও সাহিত্যে। সেখানে ১৯৫৭ সালে তিনি স্মরণ কালের সেরা রেজাল্ট করে খুব অল্প বয়সেই বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষক হন। ছিলেন ইংরেজি ভাষার শিক্ষক, পড়াতেন ভাষা ও সাহিত্যের নানান দিক ও বিভাগ, এইভাবে হয়ত কেটে যেতো তার জীবন। আমাকে তিনি বলেছেন, এই সময়ে তিনি মহানবীকে (সা.) স্বপ্নে দেখেন এবং সেই থেকে তার অন্তর উচাটন হয়ে ওঠে আরবি ভাষা শিখে কোরআন চর্চার জন্য। তার এই চিন্তার পরিবর্তনকে তার পরিবার মেনে নিলেও মানতে পারেনি তার শিক্ষক ও কল্যাণকামিরা। তিনি আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি নিয়ে পড়তে চেয়ে দরখাস্ত করেন এবং ৭ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ত্যাগ করে মিশরে চলে যান। এখানে তিনি আরবি ইনস্টিটিউট থেকে আরবি শিখে আরবি ভাষাতত্বে মাস্টার্সে ভর্তি হন। অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে এমফিল ও পিএইচ ডিও করেন এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তার বিষয় ছিল Philology.
আমাদের ক্লাসে একবার তার স্মৃতি চারণ করতে যেয়ে বলেছিলেন, এই সময় তার মনে কোরআনের ধ্বনি, তাজবিদ, আরবি ধ্বনিতত্ত্ব¡ এবং বিশ্ব ভাষার ধ্বনিতত্ত্বে¡র ওপর তার পড়াশোনার আগ্রহ জন্মে। তিনি গ্রিক, ল্যাটিন, জর্মন এবং ফ্রেন্স শিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। জার্মান ও ফ্রান্স থেকেও তিনি ডিপ্লোমা নেন। এর পর তিনি সুদানের উম্ম দূরমানে কিছু মাস অধ্যাপনার পর ১৯৬৯ সালে যোগ দেন মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সেখানে তিনি আরবি ভাষা ও সাহিত্য ফ্যাকাল্টির অধ্যাপক হলেও তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় নতুন প্রতিষ্ঠিত অনারব ছাত্রদের আরবি ভাষা শেখানো ইন্সটিটিউট ‘মা’হাদুল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ’র প্রধান করে। এখানে সুদীর্ঘ ৩০ বছর তিনি অনেক দাায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর পৃথিবির বৃহত্তম কোরআন প্রিন্টিং প্রেস মুজাম্মা’ আল-মালিক ফাহাদ লি তিবাআতিল মুসহাফ আল-শারিফের অনুবাদ বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন সুদীর্ঘ বছর। বিভিন্ন ভাষাসমূহের অনুবাদ কাজে তিনি ছিলেন সুপারভাইজার। এমনকি সাহিহ ইন্টারন্যাশনাল নামে কোরআনের যে অনুবাদটা আজ বিশ্ববাসী অত্যন্ত বিশ্বস্ত অনুবাদ হিসেবে গ্রহণ করেছে সেটাও তিনি এডিট করেছেন।
আমি ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম তিনি কতগুলো ভাষা আয়ত্ব করেছিলেন। তিনি বলেছেন, তামিল, আরবি, ইংরেজি, উর্দু, হিন্দি, ফার্সি, জর্মন, ফ্রেঞ্চ, গ্রিক হিব্রু তার কাছে প্রায় মাতৃ ভাষার মত (near native)। আর তুর্কি স্প্রেন্টুসহ আরো কিছু ভাষা তিনি আয়ত্ব করেছেন। একবার আমাদের ক্লাসে ডায়লেক্টের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ নিয়ে পড়াচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ক্বাদ জাআলা রাব্বুচি তাহতাচি সারিয়্যান। মানে ‘কাফ’কে ‘চ’র মতো করে পড়া। আমি থতমত খেলাম। উস্তায, ‘কাফ’ কীভাবে ‘চ’র মতো উচ্চারিত হয়? তিনি হেসে বললেন, কেন তোমার বাংলায় ওটা নেই? আমি বললাম, না, উস্তায। তিনি আবার হাসলেন। বললেন-
‘বাজারে বিকায় ফল তণ্ডুল
সে শুধু মিটায় দেহের ক্ষুধা’
এখানে বিকায় শব্দটা থেকে বেচাকেনা আসে। ক তোমাদের চ হয়েছে। আমি তাকিয়ে রইলাম, ও আল্লাহ, আপনি বাংলাও শিখেছেন এত গভীরে!
তিনি আমাদের ভাষাতত্বের যে সব খুঁটিনাটি বিষয় শিখিয়েছেন, তা অন্য কোনো শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব হতো না। তিনিই আমাদের সর্ব প্রথম ‘ইউনিভার্সাল গ্রামারের’ দিকনির্দেশনা শিখান। কীভাবে এক গ্রামারে দুনিয়ার ভাষা শেখা যায় এর ফর্মূলা শিখান। একবার ভাষাসমূহের আদি মাতা শিখাতে যেয়ে যখন বললেন, indo-european language সমূহের মা হলো সংস্কৃত। আমি বিস্মিত হয়ে রইলাম। তিনি শুরু করলেন মাতৃ ও পিতৃ দিয়ে। কীভাবে সংস্কৃত থেকে আস্তে আস্তে সারা ইউরোপে ফাদার, মাদার পিতা মাতা হলো। কীভাবে ইংরেজির সাফিক্স ও প্রিফিক্স হুবহু সংস্কৃতির মতো ব্যবহার হয়। যেহেতু তিন ইউরোপীয় প্রধান ভাষাগুলো নখদর্পণে আনতে পেরেছিলেন, সেজন্য সেসব ভাষার ভেতরের রূহ টেনে টেনে, তাদের রং রূপ দেখিয়ে, তাদের স্ব স্ব সুবাসের মাঝে সুবাসিত আরবি মাধূর্য তুলে ধরতেন। আমার জীবনে ভাষা ও সাহিত্যের এমন পণ্ডিত আর দেখিনি। আরবি ভাষার শব্দগুলোর বাপ মা তিনি এত চিনতেন যে তার সে জ্ঞানের কাছে আজো তাজ্জব হয়ে থাকি আমি। একবার তিনি ব্রিটেনে আসেন এক সেমিনারে। সেখানে এক আরবের সাথে কথারছলে তিনি বললেন- আপনি মনে হচ্ছে আল-ক্বাসিম এলাকার মানুষ। ওই প্রফেসর ভয়ে পাংশু হয়ে গেলেন। কী করে বুঝলেন আপনি? উস্তায তার শব্দের প্রয়োগ ও অক্ষরের উচ্চারণ ধরিয়ে বলে দিলেন এটা নাজদ এলাকার ভাষা, এবং কাসীমেই এর প্রয়োগ দেখি। তিনি ক্লাসে হাসতে হাসতে বললেন, ডক্টর আমার কাছ থেকে পালালেন, মনে করলেন, আমি সিআইডি’র কেউ হব।
তিনি নোট করতেন, সেই সব নোট পরবর্তিতে সুন্দর সুন্দর বই হয়ে যেত। এই পর্যন্ত ৩০-এর অধিক তার গবেষণা গ্রন্থ রয়েছে। তার যেসব বই আমি পড়েছি, অথবা সংগ্রহে রেখেছি, সেগুলো হলো-
১. আল-মু’আররাব এটা ইমাম জাওয়ালিক্বির লেখা। ভাষাতত্ত্বে¡র এই বই মূলত অভিধানের মতো। এতে আরবি ভাষায় যেসব বিদেশি ভাষা প্রবিষ্ট হয়েছে তার তাত্ত্বিক আলোচনা করা হয়েছে। তিনি এই বইটার পাঠোদ্ধার ও তাহক্বিক করেন।
২. আল ই’লাম বি উসূলিল আ’লাম এই বইটা নবীদের কাহিনিতে আসা যেসব নামগুলো এসেছে তার ইতিহাস। একটা শব্দ কীভাবে মূল থেকে এসে কত ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়ে বর্তমান আরবি রূপ পরিগ্রহ করেছে, তা এই বইতে তিনি সুন্দর লিখেছেন।
৩. আল-ক্বাওল আল-আসীল এই বইয়ে আজতক আরবি ভাষায় প্রবিষ্ট বিদেশি শব্দগুলোর ওপর আধুনিক স্ট্যাডি।
৪.এ বইয়ে তিনি আরবি ভাষা শিখতে সহজ হাদিসের একটা সংকলন করেছেন এবং ভাষাভিত্তিক বিশ্লেষণ করেছেন।
৫. এই বইটা তিনি লিখেছিলেন যখন মদিনা বিশ্ববিদ্যলয়ে আরবি ভাষা ইনস্টিটিউটের দায়িত্ব পান। আমি আরবি ভাষা শেখানোর সব চেয়ে ভালো প্রতিষ্ঠান পেয়েছি কিং সাউদ বিশ্ববিদ্যালয়ের বইটাকে আরবি ভাষা শেখানোর সব চেয়ে ভালো গ্রন্থ হিসেবে দেখি। কিন্তু আমার এই উস্তাযের আলোচ্য বই ৩ খণ্ড আমার কাছে আল্লাহর কবুলিয়্যাত পেয়েছে মনে হয়েছে।
তিনি এই বইটি লিখতে গিয়ে যেসব মূলনীতি অবলম্বন করেছেন তা হলো-
১. জেনেরেটিভ গ্রামারের মূল কথা নিয়ে এসেছেন। কিছু মৌলিক বিষয়কে আগে শিক্ষার্থীদের মাথায় সেট করতে হবে। তারই আলোকে তারা জেনারেট করতে থাকবে ‘ফুরু’ বা প্রশাখা গত দিক। এটা তিনি মূলত নোয়াম চমেস্কির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে করেছেন। এবং এই পদ্ধতি আধুনিক ভাষা শিক্ষার অত্যন্ত উপাদেয় প্রমাণিত।
২. ভাষাকে আধুনিক কনভার্সেশনে নিয়ে আসা, যাতে একজন শিক্ষার্থী প্রতিদিনই যেন এই ভাষা প্রয়োগের জায়গা খুঁজে পায়।
৩. তিনি বলতেন, আরবি ভাষা শেখ কোরআন ও হাদিসের ভাষার সাথে মিল রেখে। যেন এই ভাষা শিখেই তুমি যেতে পারো সরাসরি কোরআনে অথবা হাদিসে।
আমাদের উস্তায ড. আব্দুর রহিম বিয়ে করেননি, বিয়ে করার সময় পাননি বলে। তার বাসা আমাদের আড্ডাখানা ছিল। তিনি নিজে পাকিয়ে আমাদের খাওয়াতেন। একবার আমার বন্ধু আব্দুর রহমান মাদানি ও আমি তার বাসায় যাই। জিজ্ঞেস করে ছিলাম বিয়ে না করার কারণ।
তিনি একটুখানি হেসে বলেন, পড়াশোনা করতে করতে এত ব্যস্ত ছিলাম যে, বিয়ে করার চিন্তা আসেনি। একবার যখন ভাবলাম এবার করব। ও আল্লাহ, আয়নায় নিজের দাড়ি দেখলাম ভেতরে ভেতরে পেকেছে। চুলেও বেশ ছাই রং দেখাচ্ছে। তখন ভাবলাম, এখন তো কোনো যুবতী মেয়ে আমাকে পছন্দ করবে না। আর বুড়ি বিয়ে করার চেয়ে বই নিয়ে পড়ে থাকলে জ্ঞান ও মনের যথেষ্ট কল্যাণ হবে।
আমরা অনেক জোরে হাসলাম। প্রাজ্ঞ এই মানুষের সাথে ইমাম ইবন তায়মিয়্যাহ, ইমাম বোখারি, ইমাম যামাখশারি ও জাহেযদের জীবন মেলালাম। আসলে জ্ঞান সাধনা আর সুন্দরি বউ এক জায়গায় রাখা যায় না।
আল্লাহতায়ালা আমার উস্তাযকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন। আব্বাকে হারিয়ে যে বেদনার কষ্ট আজো বোধ হয়, তারই আরেক টান যেন অনুভূত হচ্ছে উস্তাযকে হারিয়ে।