মহানবীকে হত্যার ষড়যন্ত্র
শরিফ আহমাদ
প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের অপরাধে মহানবীর ওপর নেমে আসে অকথ্য জুলুমণ্ডনির্যাতন। চারপাশে তৈরি করা হয় বাধার প্রাচীর। তবুও তিনি ইসলাম প্রচার থেকে বিরত হননি। কারো ভয়ে দমে যাননি। ইসলামের প্রজ্বলিত প্রদীপ নিভাতে কাফেররা সর্বাত্মক চেষ্টা করে। বিভিন্ন সময়ে তারা নবীজিকে হত্যার পরিকল্পনা করে। যতবার হামলা চালায় ততবার ব্যর্থ হয় তাদের মিশন। অক্ষত ও নিরাপদে দীনের কাজ আঞ্জাম দেন রাসুল (সা.)। কাফেরদের মূল টার্গেট ছিল মহানবীকে হত্যা করা এবং এর মধ্যদিয়ে ইসলামকে পৃথিবী থেকে বিদায় জানানো। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা কেয়ামত পর্যন্ত একমাত্র মুহাম্মদণ্ডই (সা.) হবেন উম্মতের পথনির্দেশক। তিনিই হবেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। তাই কাফেরদের মহানবীকে হত্যার প্রচেষ্টা কখনো সফল হয়নি। মহানবীকে হত্যার ষড়যন্ত্রের কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা তুলে ধরা হলো-
উম্মে জামিলের হত্যাচেষ্টা : আবু লাহাবের স্ত্রীর ডাক নাম ছিল উম্মে জামিল। এই মহিলা স্বামীর মতো কঠোর ইসলাম বিদ্বেষী ছিল। সুরা লাহাব নাজিল হওয়ার খবর পেয়ে সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। একটি পাথর হাতে নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসন্ধানে বের হলো। আর মুখ দিয়ে ছাড়ল বিষাক্ত কথার তীর। কাবা প্রাঙ্গণে বসা হজরত আবু বকর (রা.)-এর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! ওই মহিলা তো এদিকে আসছে। তখন রাসুল (সা.) বললেন, হে আবু বকর! নিশ্চিন্ত থাকুন। সে আমাকে দেখতে পাবে না। এরপর তিনি কোরআন তেলাওয়াত শুরু করলেন। তুমি যখন কোরআন পাঠ করো, তখন তোমার ও যারা পরলোকে বিশ্বাস করে না তাদের মধ্যে এক প্রচ্ছন্ন পর্দা টেনে দিই। (সুরা বনী ইসরাইল : ৪৫)। এরই মধ্যে ওই মহিলা এসে বললো, আবু বকর! তোমার সাথী আমাদের বদনামি করে কবিতা বলেছে? তিনি জবাবে বললেন, কাবার রবের শপথ! তিনি কোনো কবিতা বলেননি এবং তার মুখ দিয়ে তা বেরও হয়নি। তখন মহিলা বলল, তুমি সত্য বলেছো। তারপর সে চলে গেলে হজরত আবু বকর (রা.) বললেন, সে কি আপনাকে দেখেনি? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, মহিলা ফিরে যাওয়া পর্যন্ত একজন ফেরেশতা আমাকে আড়াল করে রেখেছিল। (মুসনাদে আবি ইয়ালা : ২৩৫৮, মুসনাদে বাজ্জার : ২৯৪)।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় আবু জাহেল : একবার আবু জাহেল সম্মেলনকেন্দ্রে সবাইকে লক্ষ্য করে বলল- হে সহযোদ্ধারা! মুহাম্মদ কিছুতেই তার নীতি ত্যাগ করতে রাজি নন। তাই আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, আগামীকাল পাথর দিয়ে মুহাম্মদের মাথা গুঁড়িয়ে দেব। এরপর আমার যা হওয়ার হবে। কোনো পরওয়া করি না। যেই ভাবা সেই কাজ। পরের দিন রাসুল (সা.) কাবার সন্নিকটে এসে নামাজে দাঁড়ালেন, সুযোগ সন্ধানী আবু জাহেল সগৌরবে পাথর নিয়ে নবীজির কাছে গেল। হঠাৎ তার হাত কাঁপতে লাগল। পাথর হাত থেকে খসে নিচে পড়ে গেল। রক্ত শুকিয়ে চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। সে দৌড়িয়ে তার বন্ধুদের কাছে ফিরে গেল। ওরা এগিয়ে এসে বলল, হে আবুল হাকাম তোমার কী হলো? কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাচ্ছো কেন? তখন সে বলল, আমি যখন মুহাম্মদের মাথার দিকে হাত বাড়ালাম। তখন একটি আশ্চর্য চেহারার উট মুখ হা করে আমার দিকে ধাবিত হলো এবং আমাকে গিলে খেতে উদ্ধত হলো। এমন ভয়ংকর উট আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। (সীরাতে খাতামুল আম্বিয়া : ৩৭, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৩/৮৪, সিরাত ইবনে হিশাম : ৭৩)। এটা ছিল একটি মুজেজা। নবীজি (সা.) বলেন, তিনি ছিল জিব্রাইল (আ.) আবু জাহেল উগ্র আচরণ করলে উট তাকে আক্রমণ করত।
বনু নাজিরের ষড়যন্ত্র : রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করে কয়েকটি গোত্রের সাথে শান্তি চুক্তি করেন। ওই সব গোত্রের মধ্যে বনু নাজির ছিল অন্যতম। হজরত আমর ইবনে উমাইয়া দামেরি (রা.) কর্তৃক বিরে মাউনার প্রতিশোধ বশত ভুলক্রমে বনু আমের গোত্রের দুজনকে হত্যা করে। তখন রাসুল (সা.) চুক্তিবদ্ধ বনু নাজিরের কাছে গেলেন মুক্তিপণের চাঁদা আদায়ের জন্য। তারা প্রকাশ্য চাঁদা আদায়ের সম্মতি জানিয়ে গোপনে মহানবীকে হত্যার পরিকল্পনা করল। আমর ইবনে জাহাশ ইবনে কাব ছাদের ওপর থেকে পাথর ফেলে নবীজিকে হত্যার জন্য ওপরে উঠল। তৎক্ষণাৎ ওহীর মাধ্যমে বিষয়টা অবগত হয়ে নবীজি (সা.) মদিনায় চলে আসেন। পরে হজরত আবু বকর (রা.), হজরত ওমর (রা.) ও অন্য সাহাবিরা মদিনায় ফিরে এসে তাদের হত্যার পরিকল্পনার কথা শোনেন। তখন আল্লাহর রাসুল (সা.) ওদের ওপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে বলেন। তারা অবরুদ্ধ অবস্থায় মুনাফিকদের আস্ফালনে নতুন আলোচনায় বসার বাহানায় আবারও হত্যার পরিকল্পনা করে। বারংবার তাদের বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রের কারণে রাসুলুল্লাহ (সা.) হামলার নির্দেশ দেন। শেষ পর্যন্ত ওই ইহুদিরা হেরে গিয়ে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/১৪৯, সীরাত ইবনে হিশাম : ১/২০২, সীরাতুল মুস্তফা : ২/২৩১) এটা চতুর্থ হিজরিতে সংঘটিত হয়েছিল।
বিষ প্রয়োগে হত্যাচেষ্টা : খায়বার বিজয়ের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) সেখানে কিছুদিন অবস্থান করেন। একদিন সালাম ইবনে মিশকাতের স্ত্রী জয়নব বিনতে হারিস একটি বিষ মেশানো ভুনা বকরি হাদিয়া প্রেরণ করে। নবীজি (সা.) এক টুকরো মুখে দেওয়া মাত্র হাত গুটিয়ে নেন। বলেন, এতে বিষ মেশানো আছে। খানায় অংশগ্রহণকারী সাহাবি বিশর ইবনে বারাকে হাত গুটিয়ে নিতে নির্দেশ করেন। জয়নাবকে ডেকে কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে সে স্পষ্ট বলল- নিঃসন্দেহে খাবারে বিষ মেশানো হয়েছে। আপনি যদি সত্যিকারের নবী হয়ে থাকেন তবে মহান আল্লাহ আপনাকে অবহিত করবেন। আর যদি মিথ্যা নবী হয়ে থাকেন, তাহলে মানুষ আপনার থেকে পরিত্রাণ পাবে। খানায় অংশগ্রহণকারী সাহাবির ইন্তেকালের দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় অথবা প্রকাশ্য ইসলাম গ্রহণ করে সে ক্ষমা পেয়েছে এরকম দুটো বর্ণনা পাওয়া যায়।
(ফাতহুল বারি : ৭/৩৮০, সীরাতুল মুস্তফা : ২/৩৬৭, যাদুল মাআদ : ২/১৩৯)।
কাুফেরদের সম্মিলিত হত্যাচেষ্টা : মক্কার কাফেররা যখন দেখল মদিনায় হিজরত করা সাহাবিদের সংখ্যা বেড়ে চলল, তখন কাফের সমাজ দারুণ নাদওয়ায় পরামর্শসভায় বসল। শয়তান সেখানে শায়খে নজদি পরিচয় দিয়ে অংশগ্রহণ করল। কেউ একজন মুহাম্মকে কোনো বদ্ধ কুঠুরিতে আটক করে রাখার পরামর্শ দিল। আবার কেউ দেশ থেকে বহিষ্কার করার প্রস্তাব পেশ করল। কিন্তু ছদ্মবেশী শাইখে নজদি যুক্তি দেখিয়ে সবগুলোকে নাকচ করে দিল। তখন আবু জাহেল বলল, প্রতিটি গোত্র থেকে একেক জন যুবক নির্বাচন করা হোক, আর সবাই মিলে একযোগে মুহাম্মদকে হত্যা করুক। শাইখে নজদি খুশি হয়ে বলল, আল্লাহর কসম! এটাই তো সঠিক সিদ্ধান্ত। অন্যরাও এটাকে সমর্থন জানাল। ওদের সভা সমাপ্ত হওয়ার আগেই হজরত জিব্রাইল (আ.) আল্লাহর বাণী নিয়ে উপস্থিত হলেন- স্মরণ করো সে সময়কে, যখন কাফেরগণ তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তোমাকে বন্দি করার জন্য, হত্যা করার জন্য অথবা নির্বাসিত করার জন্য এবং তারা ষড়যন্ত্র করে আর আল্লাহ কৌশল করেন। আর আল্লাহ কৌশলকারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। (সুরা আনফাল : ৩০)। নবীজি (সা.) কে ওদের সিদ্ধান্ত সব জানিয়ে দেওয়া হলো। তিনি হজরত আবু বকর (রা.) সাথে নিয়ে রাতের আঁধারে মদিনার পথ ধরলেন। ব্যর্থ হলো কাফেরদের সম্মিলিত মিশন। প্রবাদ বাক্যে এটাকেই বলা হয় রাখে আল্লাহ মারে কে? (সিরাতুল মুস্তফা : ১/৩০৮, আর রাহীকুল মাখতুম : ১৬৭)।