নবীজির দুনিয়াবিমুখ জীবন

আবদুল কাইয়ুম শেখ

প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আল্লাহতায়ালা বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই ধরাপৃষ্ঠে প্রেরণ করেন দুনিয়ামুখী মানবজাতিকে আখেরাতমুখী করে গড়ে তোলার জন্য। পথভোলা মানব সম্প্রদায়কে সঠিক পথ প্রদর্শন করে আল্লাহমুখী করার জন্য। তাই আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যে ইহলৌকিক উন্নতি, অগ্রগতি, স্বচ্ছলতা ও সমৃদ্ধি অর্জন করার কোনো চিন্তা ছিল না। তিনি সব সময় পরকাল নিয়ে ভাবতেন। তার উম্মত কীভাবে পরকালে পরিত্রাণ পাবে ও দোজখ থেকে বেঁচে যাবে সেই চিন্তায় ব্যস্ত থাকতেন। তিনি ইচ্ছা করলে পার্থিব সহায়-সম্পত্তি অর্জন করে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনকুবের হতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেই পথে হাঁটেননি। তার চাচা আবু তালিব কাফেরদের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া হতে বিরত থাকার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতে বললে তিনি উত্তর দেন, ‘শ্রদ্ধেয় চাচাজান! আল্লাহর কসম! তারা যদি আমার ডান হাতে সূর্য ও বাম হাতে চন্দ্র এনে রেখে দেয় ও দাবি জানায় আমি আল্লাহর কালিমা মানুষের কাছে পৌঁছানো থেকে বিরত থাকি, তবুও আমি কিছুতেই এর জন্য প্রস্তুত হব না। এমনকি হয়ত আল্লাহর সত্য দ্বীন মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে নয়তো এই কাজে আমার প্রাণ উৎসর্গ করব।’ (সীরাতে খাতিমুল আম্বিয়া)।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ইসলামের দাওয়াত ও প্রচার-প্রসার শুরু করলে কাফেররা তাদের দ্বীন ক্রমেই সংকুচিত হতে দেখে প্রমাদ গুনে। তারা বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাওয়াতি অভিযান ও তার দ্বীনের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাদের পক্ষ থেকে লোভনীয় প্রস্তাব দেওয়ার জন্য উতবা বিন রবিয়াকে প্রেরণ করে। সে এসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলে, ‘ভাতিজা! বংশ মর্যাদার বিবেচনায় তুমি আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম। এরপরও তুমি নিজ গোত্রের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছ। তাদের ও তাদের উপাস্যদের মন্দ বলেছ। তাদের ও তাদের বাপ দাদাদের মূর্খ সাব্যস্ত করেছ। আজ তুমি মনের কথা বলো। এসব কিছুর মাধ্যমে তোমার অভিপ্রায় কী? তোমার উদ্দেশ্য যদি হয় সম্পদ অর্জন, তাহলে শুনো! আমরা তোমাকে এতটা সম্পদ দিতে প্রস্তুত আছি যার মাধ্যমে তুমি মক্কার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হবে। তুমি নেতা হতে চাইলে আমরা তোমাকে পুরো কোরাইশের নেতা মেনে নেব। তোমার নির্দেশ ব্যতীত গাছের পাতাও নড়বে না। তুমি বাদশাহ হতে চাইলে আমরা তোমাকে বাদশাহ বানিয়ে দেব।’ (সীরাতে মুগলতাঈ) কিন্তু আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসব লোভনীয় প্রস্তাব অবজ্ঞা ভরে প্রত্যাখ্যান করে নিজের দায়িত্ব পালনে অটল থাকেন ও দুনিয়াবিমুখ জীবন বেছে নেন।

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইচ্ছা করলে পরিবার-পরিজন নিয়ে আরামণ্ডআয়েশ, ভোগবিলাস ও সুখণ্ডস্বাচ্ছন্দ্যের জীবনযাপন করতে পারতেন। সুখে-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে পারতেন। স্ত্রী-সন্তানদের জীবনমান উন্নত করতে পারতেন।

কিন্তু তিনি সেদিকে না গিয়ে অভাব-অনটন ও অল্পেতুষ্টির জীবন বেছে নিয়েছিলেন। একবার উম্মাহাতুল মুমিনিন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পার্থিব সুযোগ, সুবিধা ও ভোগসামগ্রী চাইলে তিনি রুষ্ট হন। এ সময় আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে আযওয়াজে মুতাহ্হারাতের প্রতি এই প্রস্তাবনা অবতীর্ণ হয়, ‘নবী, আপনার পত্নীগণকে বলুন, তোমরা যদি পার্থিব জীবন ও তার বিলাসিতা কামনা কর, তবে এসো! আমি তোমাদের ভোগের ব্যবস্থা করে দিই এবং উত্তমপন্থায় তোমাদের বিদায় দিই। পক্ষান্তরে যদি তোমরা আল্লাহ, তার রাসুল ও পরকাল কামনা কর, তাহলে তোমাদের সৎকর্মপরায়ণদের জন্য আল্লাহ মহা পুরস্কার প্রস্তুত করে রেখেছেন।’ (সুরা আহজাব : ২৮-২৯)। এই প্রস্তাব শুনে নবী পত্নীদের সকলেই আল্লাহ, তার রাসুল ও পরকালকে ইহকালীন ভোগ-বিলাসের উপর প্রাধান্য দেন।

পৃথিবীর রাজা-বাদশাহগণ আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসের জন্য নানাবিধ উপায় অবলম্বন করে। আর আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও ইহ ও পরজগতের বাদশাহ। এ হিসাবে আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসপূর্ণ স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন বেছে নেওয়ার অবারিত সুযোগ তার ছিল। কিন্তু তিনি পরকালকে ইহকালের উপর প্রাধান্য দিয়েছিলেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুনিয়াবিমুখ জীবনের একটি প্রামাণ্য চিত্র নিম্নোক্ত হাদিসে অঙ্কিত হয়েছে।

হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে প্রবেশ করলাম। তিনি তখন খেজুর পাতার চাটাইয়ের ওপর শোয়া ছিলেন। আমি বসে পড়লাম। তার পরিধানে ছিল একটি লুঙ্গি। এছাড়া আর কোনো বস্ত্র তার পরিধানে ছিল না। তার পাঁজরে চাটাইয়ের দাগ বসে গিয়েছিল।

আমি দেখলাম যে তার ঘরের এককোণে ছিল প্রায় এক সা’গম, বাবলা গাছের কিছু পাতা এবং ঝুলন্ত একটি পানির মশক। এ অবস্থা দেখে আমার দু’চোখে অশ্রু প্রবাহিত হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে খাত্তাবের পুত্র, তুমি কাঁদছ কেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর নবী! আমি কেন কাদব না? এই চাটাই আপনার পাঁজরে দাগ কেটে দিয়েছে! আর এই হচ্ছে আপনার ধনভান্ডার! এতে যা আছে তা তো দেখতেই পাচ্ছি। অথচ পারস্যরাজ ও রোমসম্রাট বিরাট বিরাট উদ্যান ও ঝরনা সমৃদ্ধ অট্টালিকায় বিলাস-ব্যসনে জীবনযাপন করছে। আর আপনি হলেন আল্লাহর নবী ও তার মনোনীত প্রিয় বান্দা। অথচ আপনার ধন-ভান্ডারের অবস্থা এই! তিনি বলেন, হে খাত্তাবের পুত্র, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, আমাদের জন্য রয়েছে পরকালের স্থায়ী সুখ-শান্তি এবং ওদের জন্য রয়েছে ইহকালের ভোগবিলাস? আমি বললাম, হ্যাঁ।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪১৫৩)।

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার সঙ্গে সর্বপ্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। পথিক পথ চলার সময় যেমন খুব বেশি অর্থ-সম্পদ নিজের সঙ্গে রাখে না, ঠিক তেমনিভাবে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও পথচারীর মতো দুনিয়াবিমুখ জীবন বেছে নিয়েছিলেন। তার অভাব অনটনের জীবন চিত্রায়িত করে হজরত আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন এক সময় খেজুর পাতার মাদুরে শুয়েছিলেন। তিনি ঘুম হতে জাগ্রত হয়ে দাঁড়ালে দেখা গেল তার গায়ে মাদুরের দাগ পড়ে গেছে। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা আপনার জন্য যদি একটি নরম বিছানার (তোষক) ব্যবস্থা করতাম। তিনি বললেন, দুনিয়ার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? দুনিয়াতে আমি এমন একজন পথচারী মুসাফির ছাড়া আর কিছুই নই, যে একটি গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিল, তারপর তা ছেড়ে দিয়ে গন্তব্যের দিকে চলে গেল।’ (সুনানে তিরমিজি : ২৩৭৭)।

আহার-বিহার ও বিলাস-ব্যসনের চিন্তা সবাই করে। কিন্তু মহানবী সালাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন একদম ব্যতিক্রম। তিনি শৌখিনতাপূর্ণ আহার-বিহারের চিন্তা কখনো করেননি। সারাটি জীবন এমন দারিদ্র্য ও অভাব-অনটনে অতিবাহিত করেছেন যে, পরিবার-পরিজনকে নিয়ে কখনো দুইবার পরিতৃপ্তি সহকারে আহার করেননি। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকাল করেছেন অথচ দু’বেলা তিনি রুটি ও যাইতুন দ্বারা কখনো পূর্ণতৃপ্ত হননি।’ (মুসলিম : ৭৩৪৩)। অন্য আরেকটি হাদিসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার পরিবার পরিজনের অর্ধাহার ও অনাহারে দিনাতিপাত করার চিত্র ফুটে উঠেছে। আম্মাজান হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পরিবার-পরিজন দু’দিন পূর্ণতৃপ্ত হয়ে গমের রুটি খাননি। দু’দিনের একদিন তিনি খুরমা খেয়েই অতিবাহিত করতেন। (মুসলিম : ৭৩৩৮)।

উভয় জাহানের বাদশাহ হওয়া সত্ত্বেও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার পরিবার-পরিজনের লোকদের জীবন এমনভাবে অতিবাহিত হত যে তাদের চুলায় মাসের পর মাস আগুন জ্বালাবার সুযোগ হত না। খেয়ে না খেয়ে তাদের দিন গুজরান করতে হত। হজরত আয়েশা (রা.) একবার উরওয়া (রা.) কে বললেন, হে বোনের পুত্র! আমরা দু’মাসে তিনটি নতুন চাঁদ দেখতাম। কিন্তু এর মধ্যে আল্লাহর রাসুলের ঘরগুলোতে আগুন জ্বলত না।

আমি বলললাম, আপনারা কীভাবে দিনাতিপাত করতেন? তিনি বললেন, কালো দুটি বস্তু তথা খেজুর ও পানি দ্বারা। অবশ্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কিছু আনসার প্রতিবেশীর কতকগুলো দুধেল প্রাণী ছিল। তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা দিত। আর আমরা তাই পান করতাম।’ (বোখারি : ৬৪৫৯)। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দুনিয়াবিমুখ জীবন থেকে যে কেউ পাঠ গ্রহণ করলে জীবনে সরলতা ও স্বচ্ছতা আসবে। আর ভোগদখলের অশান্ত পৃথিবী হয়ে ওঠবে শান্তিময়। সর্বত্র বয়ে যাবে প্রশান্তির সমীরণ।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা-১২১১