ইসলাম সাম্য মৈত্রী ও শান্তির ধর্ম। হিংস্রতা, উগ্রতা ও নির্মমতার স্থান ইসলামে নেই। ইসলাম স্বীয় অনুসারীদের মানবিক ও সহনশীলতার শিক্ষা দেয়। সম্প্রীতি ও সহবস্থানের উন্মুক্ত পাঠ রয়েছে ইসলামে।
জুলুম-অত্যাচার প্রতিহতকল্পে, ন্যায়ের পতাকা উড্ডীন করার জন্য এবং অশান্ত পৃথিবীকে শান্ত করতে প্রয়োজনমাফিক যুদ্ধেরও অনুমোদন রয়েছে ইসলামে। তবে ইসলামের যুদ্ধনীতি পৃথিবীর অন্যান্য যুদ্ধনীতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ইসলাম এবং অন্যসব ধর্মের প্রভাবে প্রভাবিত যুদ্ধনীতি সম্পর্কে প্রতিটি মুসলমানের স্বচ্ছ ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়। তাহলে সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও জিহাদ বা সমরনীতির অধীন মুসলিমদের ধর্মযুদ্ধ সম্পর্কে ঈষৎ ধারণা পাওয়া যাবে।
ইসলামে যুদ্ধনীতি : ইসলামের যুদ্ধনীতি দুনিয়ার অন্য সব দেশ-ধর্ম আর নেতাদের যুদ্ধনীতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ইসলাম ধর্মে ঠুনকো অজুহাতে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার নিয়ম নেই। ইসলাম যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ শুরুর পূর্ব মুহূর্তেও দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় যুদ্ধ বন্ধে বদ্ধপরিকর থাকে। অযাচিত অপরাধ রোধে যুদ্ধক্ষেত্রেও পরিপূর্ণ সতর্কতা অবলম্বনের আদেশ দেয়।
আল্লাহর প্রতি ভয়-ভরসা ও জবাবদিহি : জবাবদিহি ইসলামে অলঙ্ঘণীয় বিধান। পরিস্থিতি যতই কঠিন ও ভীতিকর হোক, কোনো অবস্থাতেই নিরাশ হওয়া যাবে না। কোরআনের ভাষায়, তোমরা আল্লাহর রহমত-অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না (সুরা ঝুমার : ৫৩) এবং অবস্থা যতই সুখকর ও অনুকূলে হোক, আল্লাহর ভয় ও জবাবদিহিকে কখনো হৃদয়ছাড়া করা যাবে না। নবীজি বলেছেন, হে লোকসব! তোমরা জিহাদে (যুদ্ধে) শত্রুদের মুখোমুখি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা কর না, বরং আল্লাহর নিরাপত্তা কামনা কর। আর যদি মুখোমুখি হয়েই যাও, তাহলে দৃঢ়চিত্তে তাদের সঙ্গে লড়াই কর (বোখারি : ২৯৬৬)। নবীজি কোনো ব্যক্তিকে সেনাবাহিনী প্রধান নির্বাচিত করলে, তাকে তাকওয়া, আল্লাহভীতির পরামর্শ দিতেন (মুসলিম : ১৭৩১)।
যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাবনা : ইসলাম সম্প্রীতি ও সহবাস্থানে বিশ্বাসী। তাই, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এড়াতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করে। যুদ্ধের আগে শত্রুপক্ষকে সন্ধির প্রস্তাব করে। রাসুল (সা.) মুসলিম বাহিনীর নেতাদের যুদ্ধের আগে অমুসলিম বাহিনীর প্রধানকে যুদ্ধে না জড়িয়ে সন্ধির প্রস্তাব রাখার জন্য জোর তাকিদ দিতেন। অমুসলিমরা সন্ধির প্রস্তাব গ্রহণ না করলে তারপর আনুষ্ঠানিক যুদ্ধের ঘোষণা আসত। সঙ্গত কারণ ছাড়া হঠাৎ কোনো জাতির ওপর আক্রমণ করে বসা মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য নয়।
শিশুহত্যা নিষিদ্ধ : প্রিয় নবী মুসলিম যোদ্ধাদের যুদ্ধক্ষেত্রে আল্লা কে স্মরণের উপদেশ দিতেন এবং শিশুহত্যা থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দিতেন। হুনাইনযুেদ্ধর দিন নবীজি একটি ছোট বাহিনী প্রেরণ করেন। যারা যুদ্ধক্ষেত্রে কিছুশিশুকেও হত্যা করে। প্রত্যাবর্তনকালে নবীজি তাদের বললেন, কীসে তোমাদের শিশুহত্যায় উদ্বুদ্ধ করল? তারা বলেন, ওরা তো মুশরেকদেরই সন্তান।
নবীজি বললেন, তোমরা যারা সর্বোত্তম তারাও কি মুশরিকদের সন্তান ছিলে না? কসম আল্লাহর,যার হাতে আমার জীবন! প্রতিটি শিশুই ফিতরাত (ইসলাম) নিয়ে জন্ম নেয়। মুখে ব্যক্ত না করা পর্যন্ত সে তার ওপরেই বহাল থাকে (মুসনাদে আহমাদ : ১৫৬২৬)। সাহাবি সামুরা ইবনে জুনদুব বলেন, নবীজি মুশরেকদের বালক শিশুদের হত্যা করতে নিষেধ করেছেন (তিরমিজি : ১৫৮৩)। বনি কুরাইজার যুেদ্ধর দিন নবীজি তাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের মুক্ত করে দিয়েছিলেন (তিরমিজি : ১৫৮৪)।
বর্তমান যুদ্ধনীতি কতটা অমানবিক ও একপেশে স্বার্থের জালে আবদ্ধ তা ফিলিস্তিনে ইসরাইলের নির্বিচারে নারী ও শিশুহত্যা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। যেখানে প্রতিদিন ইহুদিরা শতশত শিশু হত্যা করছে। মানবতা ও যুদ্ধনীতি লঙ্ঘিত হচ্ছে। অথচ শান্তির ধর্ম ইসলামে যুদ্ধে শিশুহত্যার অনুমোদন নেই।
বৃদ্ধদের হত্যা করা নিষিদ্ধ : নবীজি শিশুদের মতো বৃদ্ধদেরও হত্যা করতে বারণ করেছেন। নবীজি বলেন, তোমরা যুদ্ধ করার সময় আল্লাহতায়ালার নাম নেবে, তার ওপর ভরসা করবে এবং রাসুলের মিল্লাতের ওপর অটল থাকবে। অতিশয় বৃদ্ধদের হত্যা করবে না (আবু দাউদ : ২৬১৪)। সব বৃদ্ধের ক্ষেত্রে এই নীতি প্রযোজ্য, তবে যে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে কিংবা বুদ্ধি পরামর্শ দেয়, তার ক্ষেত্রে এই নীতি কার্যকর হবে না।
নারীদের হত্যা নয় : সুনানে আবু দাউদের বর্ণনায় এসেছে, নবীজি বলেন, তোমরা যুদ্ধ করার সময় নারীদের হত্যা করবে না (আবু দাউদ : ২৬১৪)।
ইবনে ওমর (রা.) বলেন, কোনো এক যুদ্ধে নবীজি একজন মৃত মহিলার লাশ দেখে তার বিরোধিতা করেন এবং নারী ও শিশুদের হত্যা করতে নিষেধ করেন (বোখারি : ২৮৫২)। সাহাবি রবাহ বলেন, এক যুদ্ধে আমি নবীজির সঙ্গে ছিলাম। তিনি দেখলেন, কিছু মানুষ একত্রিত হয়ে কী যেন দেখছে। সেখানে কী হয়েছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, একজন মহিলাকে হত্যা করা হয়েছে। সবাই তাকে দেখছে। নবীজি বললেন, তাকে হত্যা করার প্রয়োজন ছিল না। তিনি দলনেতা খালিদ বিন ওয়ালিদকে বলে পাঠালেন, সে যেন কোনো নারীকে হত্যা না করে (ইবনে মাজাহ : ২৮৪২)।
ধর্মগুরুদের হত্যা নয় : হজরত আবুবকর (রা.) উসামা ইবনে যায়েদকে যুদ্ধের জন্য শামে প্রেরণকালে উপদেশাকারে বলেছিলেন, পথিমধ্যে তুমি একদল লোক পাবে, যাদের ধারণা আল্লাহর ইবাদতের জন্য তারা সব ত্যাগ করেছে। এমন লোকদের আপন অবস্থায় ছেড়ে দেবে (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক : ৯৩৭৫)। নবীজি বলেন, ধর্মগুরুদের হত্যা করবে না। নাজরানের খ্রিষ্টানদের সঙ্গে চুক্তিকালে নবীজি বলেছিলেন, কোনো গির্জা ধ্বংস করা হবে না, কোনো পাদ্রীকে হত্যা করা হবে না। (আবু দাউদ : ৩০৪১)।
অথচ আমরা দেখছি, আজ পৃথিবীর বিশ্বমোড়লদের নেতৃত্বে সংঘটিত যুদ্ধগুলোতে সর্বপ্রথম মুসলিম আলেম বা ধর্মগুরুদের হত্যা করার হীনপ্রয়াস অব্যাহত রাখে। আলেমদের জনবিচ্ছিন্ন করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে নানান মিথ্যে অপবাদ আরোপ করে। যা লজ্জাকর একটি বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধে পরিণত হয়েছে এখন সারা বিশ্বে।
আশ্রিতদের ওপর নির্যাতন নয় : সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার। তাদের প্রতি মানবিকতা প্রদর্শনকে তিনি ভালোবাসেন। কাউকে আশ্রয় দিয়ে হত্যা-নির্যাতন করা ঘৃণিত জুলুম। নবীজি আশ্রিতদের প্রতি নির্যাতন করতে নিষেধ করেছেন। রাসুল বলেন, যে ব্যক্তি কোনো লোকের জানের নিরাপত্তা দেয়ার পর তাকে হত্যা করে, সে কেয়ামতের দিন বিশ্বাসঘাতকতার ঝান্ডা বেয়ে বেড়াবে। (ইবনে মাজাহ : ২৬৮৮)।
লুণ্ঠন ও মৃতদেহ বিকৃতি নয় : মৃত ব্যক্তির লাশ বিকৃতি করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। নবীজি বলেছেন, ওয়াদাহ ভঙ্গ কর না। বিশ্বাসঘাতকতা কর না। যুদ্ধলদ্ধ মাল আত্নসাৎ কর না। লাশ বিকৃতি কর না এবং শিশুহত্যা কর না (আবু দাউদ : ২৬১৩)। অন্য হাদিসে এসেছে, নবীজি বলেন, লুণ্ঠন ও লাশ বিকৃত কর না। (বোখারি : ২৩৪২)। নবীজি আরো বলেছেন, অঙ্গ বিকৃতকারী ব্যক্তি কেয়ামতে কঠিনভাবে আজাবগ্রস্ত হবে (মুসনাদে আহমাদ : ৩৭৬৮)।
নির্বিচারে ধ্বংসযজ্ঞ নিষিদ্ধ : যুদ্ধে নির্বিচারে ধ্বংসযজ্ঞ চালান, বাড়িঘর, সম্পদ ধ্বংস করা, প্রাণী হত্যা করা ইসলামে নিষিদ্ধ (সুনানুল-কুবরা লিল-বায়হাকি : ১৭৯০৪)। বর্তমান বিশ্বের যুদ্ধ আগ্রাসী মনোভাব থেকে সৃষ্ট দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার ও নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ ছাড়া আর কিছু নয়। ইসলাম এ ধরনের যুদ্ধকে কখনো সমর্থন করে না। মুসলিম রাষ্ট্র, মা বোনের ইজ্জত কেউ কেড়ে নিতে চাইলে তার বিরুদ্ধে ইসলাম আবশ্যিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
এ যুদ্ধ সন্ত্রাসবাদ নয়, জঙ্গিবাদ নয়, এ যুদ্ধ আত্মরক্ষার সশস্ত্র সংগ্রাম। জালেমের বিপক্ষে নির্যাতিতের রুখে দাঁড়ানো। স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনমরণ যুদ্ধকে যারা সন্ত্রাসবাদ বলে আখ্যায়িত করে তারা নিজেরাই গোটা পৃথিবীতে সন্ত্রাসবাদের জন্ম দেয় নিজেদের স্বার্থে। তাই কোনোটা সন্ত্রাসবাদ আর কোনোটা স্বাধীনতাযুদ্ধ তা উপলব্ধি করতে চলমান ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধই যথেষ্ট।
লেখক : খতিব, বাইতুল আজিম মসজিদ, রংপুর।