ঢাকা ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নবীজির ভালোবাসার আকর্ষণ

আবদুল্লাহ নোমান
নবীজির ভালোবাসার আকর্ষণ

ইতিহাসের স্বর্ণমানব সাহাবায়ে কেরাম (রা.) হলেন ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। আমরা যদি আলোকিত মানুষ হতে চাই, তাহলে আমাদের পাঠ করতে হবে আলোর কাফেলা নবীপ্রেমিক সাহাবিদের ঈমানদীপ্ত জীবনী। যারা নবীজি (সা.)-এর সান্নিধ্য সৌরভে জীবনকে সুরভিত করেছিলেন। পরশ মানিকের অনন্য পরশে ধন্য হয়েছিলেন। এদের সম্পর্কে যখন আমরা জানব, তন্ময় হয়ে এদের পাঠ করব, তখন ঈমানের বীজতলা থেকে আগাছা সরে যেতে থাকবে ধীরে ধীরে, চৈতন্যের ধুতরা ফুল বিষহীন হতে থাকবে ক্রমান্বয়ে, এ বিপদ সংকুল বন্ধুর পথে দৃপ্ত পদভারে হাঁটার সাহস পোক্ত হবে মনের গহীনে। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করলে আমরা শুদ্ধাচারী জীবনে অনুপ্রাণিত হব, শোভাচারী জীবনে প্রণোদিত হব, সফল জীবনের অধিকারী হব, ইনশাআল্লাহ।

যাদের কাছে নবীজি (সা.)-ই সেরা : আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে নিজেকে এগিয়ে রাখার জন্য, তার সান্নিধ্য লাভে পুণ্যের কাজে নিজেকে অধিক সক্রিয় করার জন্য সাহাবায়ে কেরাম (রা.) হলেন আমাদের প্রেরণার বাতিঘর। নবীজি (সা.)-এর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত সেই সোনালি মানুষগুলো তর তর করে এগিয়ে গেছেন প্রতিশ্রুত জান্নাতের আহ্বানে। আন্তরিকতার সবটুকু ঢেলে ছুটে চলেছেন শাশ্বত সুন্দরের আবহে। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ছিলেন পৃথিবীর বিশুদ্ধতম এ ভালোবাসার শীর্ষে। তাই আমাদের পড়তে হবে তাদের নবীপ্রেমের বিস্ময়কর কাহিনি। যেন নবীজি (সা.)-কে ভালোবাসার রসদ নিতে পারি তাদের আচার-আচরণ থেকে; জীবনের বাঁকে বাঁকে তার প্রতিফলন ঘটাতে পারি পরম শ্রদ্ধা ও অনুরাগের সঙ্গে। তারাই ছিলেন প্রকৃত আশেকে নবী। তিনিই ছিলেন তাদের সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি। জাবের (রা.) বলেন, ওহুদ যুদ্ধের সময় রাতে আমার আব্বা আমাকে ডেকে বললেন, ‘আমার প্রবল ধারণা, আমি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গীদের মধ্যে আগেভাগেই শহিদ হব। আর আমি তোমাকেই সবচেয়ে প্রিয় হিসেবে রেখে যাচ্ছি, তবে রাসুল (সা.) ছাড়া (কারণ, তিনিই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়)।’ (বোখারি : ১৩৫১)।

যার সঙ্গে মহব্বত তার সঙ্গে কেয়ামত : নবীপ্রেমে উদ্বেলিত সাহাবিদের জীবনাদর্শ বিশ্বাসী মানব সমাজকে এ মর্মে বার্তা দেয় যে, সুন্নাহময় আচরিত দ্বীনই আমাদের দিনগুলোকে যেমন প্রফুল্ল-ফুলেল করে তুলবে, তেমনি আল্লাহর দেওয়া জীবনশৈলী সর্বান্তকরণের ধারণ করলেই জীবনের শীলনে পরিতোষের মিলন ঘটবে। তা ছাড়া জীবনের উঠোনকে জান্নাতের পুষ্প-সৌরভে শোভিত করার প্রেরণা জোগানোর জন্য, সাধনার প্রাঙ্গণে সুন্নাহর সবুজতা চিনিয়ে দেওয়ার প্রয়াস চালানোর জন্য সাহাবিদের নবীপ্রেম আমাদের জন্য রোল মডেল। নবীপ্রেমে টইটম্বুর ছিল সাহাবা জীবন। যেখানে ঘটেছিল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অপূর্ব সম্মিলন। তাইতো তারা কথায় কথায় নবীজি (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে বলতেন, ‘ফিদাকা আবি ওয়া উম্মি, বি আবি আনতা ওয়া উম্মি ইয়া রাসুলাল্লাহ!’ আমার বাবা-মা উৎসর্গিত হোক আপনার প্রতি! ইত্যাদি মধুময় শব্দমালা নিসৃত হতে থাকত তাদের জবান থেকে। দুনিয়ার জীবনে নবীজি (সা.)-এর সান্নিধ্য যেমন তাদের পরম কাঙ্ক্ষিত ছিল, তেমনি পরকালেও তার সঙ্গ তাদের পরম আরাধ্য ছিল। আনাস ইবনে মালেক (রা.) সূত্রে বর্ণিত; এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করল, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! কেয়ামত কবে?’ তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘কী প্রস্তুতি নিয়েছ কেয়ামতের?’ সে জবাব দিল, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ভালোবাসা।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘নিশ্চয়ই যাকে তুমি ভালোবাস, (কেয়ামতের দিন) তার সঙ্গেই থাকবে।’ আনাস (রা.) বলেন, ইসলাম গ্রহণের পর আমাদের কাছে সবচেয়ে খুশির বিষয় ছিল রাসুল (সা.)-এর এ কথা, ‘নিশ্চয়ই যাকে তুমি ভালোবাস, (কেয়ামতের দিন) তার সঙ্গেই থাকবে।’ আনাস (রা.) বলেন, আর আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসি; আবু বকর (রা.) ও ওমর (রা.)-কেও। তাই আশা রাখি, আখেরাতে আমি তাদের সঙ্গেই থাকব, যদিও তাদের মতো আমল করতে পারিনি।’ (বোখারি : ৩৬৮৮)।

নবীজি (সা.)-এর ভালোবাসায় সব সম্পদবিলীন : নবীজি (সা.)-এর জন্য নিবেদিতপ্রাণ সাহাবিদের উপাদেয় বিস্ময়কর কাহিনিগুলো যতই পড়ি, ততই হৃদয়তটে এক গভীর ভাবের উদ্রেক হয়। অন্তরে বিস্তৃত হতে থাকে শুভ চেতনার অবারিত ডালপালা। ফুলের নির্মল ঘ্রাণ আর পাখিদের নিষ্পাপ গানের মতো তা হৃদয়কে সুবাসিত ও অনুরণিত করে। জুড়িয়ে দেয় চোখ আর ভরিয়ে দেয় বুক। নবীজি (সা.)-এর প্রতি তাদের ছিল আকাশছোঁয়া ভালোবাসা। হৃদয়জুড়ে ছিল অনিঃশেষ ভালোলাগা। তাইতো নবীজি (সা.)-এর একটু প্রণোদনায় নিজেদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিতেও তারা কার্পণ্য করতেন না। আল্লাহর রাস্তায় সব সম্পদ দান করতেও দ্বিধা করতেন না। তদুপরি তারা পরস্পরের প্রতিযোগিতা করতেন পুণ্যের কাজে। অগ্রগামী হওয়ার চেষ্টা করতেন জীবনবাজি রেখে। এমন চাঞ্চল্যকর, চমকপ্রদ ও শিক্ষনীয় অসংখ্য ঘটনা বর্ণিত হয়েছে হাদিস গ্রন্থের বর্ণিল পাতায়। একবার প্রিয় নবীজি (সা.) তার সাহাবিদের দান-সদকার প্রতি উদ্বুদ্ধ করলেন। তখন ওমর (রা.)-এর কাছে বেশ সম্পদ ছিল। তিনি তার অর্ধেক দান করলেন। আর আবু বকর (রা.) ঘরে যা ছিল, সব নিয়ে এলেন। যায়েদ ইবনে আসলাম কর্তৃক তার পিতার সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-কে আমি বলতে শুনেছি। তিনি বলেন, রাসুল (সা.) (তাবুক যুদ্ধের প্রাক্কালে) আমাদের দান করার নির্দেশ দিলেন। সৌভাগ্যক্রমে তখন আমার হাতে বেশ সম্পদও ছিল। আমি (মনে মনে) ভাবলাম, যদি আমি কোনোদিন আবু বকর (রা.)-কে ডিঙিয়ে যেতে পারি, তাহলে আজই সেই সুযোগ। আমি আমার অর্ধেক সম্পদ (নবীজির দরবারে) নিয়ে এলাম। রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছ (হে ওমর)?’ আমি বললাম, ‘অনুরূপ অর্ধেক রেখে এসেছি।’ তারপর আবু বকর (রা.) তার সব সম্পদ নিয়ে হাজির হলেন। রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আবু বকর! পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছ?’ তিনি জবাবে বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে রেখে এসেছি।’ তখন আমি বললাম, ‘আল্লাহর কসম! আমি কখনোই কোনো প্রসঙ্গে তার চেয়ে অগ্রগামী হতে পারব না।’ (তিরমিজি : ৩৬৭৫)।

তুচ্ছ সব বিপদ নবীজি (সা.) যখন নিরাপদ : নবীপ্রেমে দিওয়ানা এক নারী সাহাবির কাহিনি তো আরো বিস্ময়কর। ওহুদ যুদ্ধেরই ঘটনা। যিনি নবীজি (সা.)-এর ডাকে জিহাদে শরিক হতে পাঠিয়ে দিয়েছেন নিজের প্রিয়তম স্বামী, শ্রদ্ধেয় পিতা এবং কলিজার টুকরো ভাইকে। যুদ্ধ শেষে বনু দীনারের আনসারি সেই সাহাবিয়াকে যখন একে একে পিতা, ভাই ও স্বামীর শাহাদতের সংবাদ দেওয়া হলো, তিনি সব মেনে নিলেন প্রশান্ত মনে। বিচলিত ও অস্থির হলেন না তাদের বিরহে। হতাশায় ভেঙে পড়লেন না কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে। চিন্তা শুধু একটাই, আমার প্রিয় নবী (সা.)-এর কী অবস্থা? তিনি কেমন আছেন? আশ্চর্যের বিষয় হলো, একজন সম্ভ্রান্ত মুসলিম নারী, যিনি একইসঙ্গে তিন তিনজন প্রিয়জনকে চিরতরে হারালেন! একই দিনে পিতা, স্বামী ও ভাই তাকে নিঃসঙ্গ করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন! মাথার ওপর আশ্রয়ের ছায়া বলতে আর কী বাকি থাকে তার? কিন্তু তাতে কোনো পরোয়া নেই। কারণ, আমার নবী (সা.)-এর ছায়া আমার ওপর বিদ্যমান থাকলেই সব তুচ্ছ। তাই নবীজি (সা.)-এর নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি খুবই চিন্তিত। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) তাকে আশ্বস্ত করলেন, ‘ওগো মা, আপনি যেমনটি কামনা করছেন, প্রিয়নবী (সা.) তেমনই আছেন। আমরা নবীজী (সা.)-কে এখনও হারাইনি। তিনি সুস্থ ও নিরাপদ আছেন। আলহামদুলিল্লাহ।’ কিন্তু এতেও তার অশান্ত মন শান্ত হলো না। অস্থির হৃদয় স্থির হলো না। মিনতি করলেন, একনজর নবীজি (সা.)-কে দেখিয়ে দাও না! যখন এ দিওয়ানাকে নবীজি (সা.)-এর জ্যোতির্ময় চেহারা মোবারক দেখিয়ে দেওয়া হলো, তখন তিনি নবীজি (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন পরমানন্দে, ‘আপনি বেঁচে আছেন! তাহলে তো আর কোনো মসিবত মসিবতই নয়! সব তুচ্ছ।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম : ২/৯৯)।

নবীজি (সা.)-এর শরীরে কাঁটা ফোটাও মানতে নারাজ : প্রতিটি মোমিন-হৃদয়ে গচ্ছিত থাকে নবীপ্রেমের ফুলেল বীজ। তবে কখনও পাপাচারের ঝড়ঝাপটায় এতে আস্তরণ পড়ে যায়। যখন শুভ্রতার এক পশলা বৃষ্টিতে সিক্ত হয় হৃদয়-কানন, তখন আবার প্রস্ফুটিত হয় নবীপ্রেমের পুষ্প। তাইতো নবীজি (সা.)-এর সম্মানে কখনও আঘাত এলে, তার পবিত্র সিরাত নিয়ে কোনো নরাধম ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করলে মুসলিম উম্মাহ নিশ্চুপ থাকতে পারে না। সাধ্যের সবটুকু দিয়ে প্রতিবাদ করতে কার্পণ্য করে না। নবীপ্রেম শরিয়ত মেনে চলার অন্যতম চালিকাশক্তি। পাথুরে, শ্যাওলা পড়ে যাওয়া কলুষিত অন্তরেও নবীপ্রেমের দ্যুতি ঈমানের প্রদীপ জ্বালিয়ে দেয়। নবীপ্রেম সাহাবিদের অস্থিমজ্জায় মিশেছিল। মিশেছিল তাদের রক্তকণিকায় ও শিরা-উপশিরায়। তাইতো তারা প্রিয়তম নবী (সা.)-এর ন্যূনতম কষ্ট সহ্য করতে পারতেন না। এখানে সেই আত্মত্যাগী কাফেলার ঐতিহাসিক ঘটনাটি খুবই প্রাসঙ্গিক, যেখানে উপস্থিত ছিলেন যায়েদ ও খুবাইবের মতো জানবাজ সাহাবি। যাদের অত্যন্ত বর্বর নির্মম, নিষ্ঠুরভাবে শহিদ করা হয় এক খোলা প্রান্তরে। সেই নির্মমতাকে তারা প্রতিহত করেছেন নবীপ্রেমের ঢাল দিয়ে। অবশেষে শাহাদতের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে হাসিমুখে শায়িত হয়েছেন চিরনিদ্রায়। যায়েদ ইবনে দাসিনাহ (রা.)-কে যখন মক্কার বাইরে ‘তানঈম’ নামক স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় হত্যা করার জন্য, তখন সে পাশবিকতায় শরিক হতে কোরাইশের একটি দল সঙ্গে যায়। সেখানে উপস্থিত ছিল মক্কার চতুর সরদার আবু সুফিয়ানও। (আবু সুফিয়ান তখনও মুসলমান হননি)। যায়েদ (রা.)-কে হত্যা করা হবে, এমন মুহূর্তে আবু সুফিয়ান এগিয়ে আসে। বলল, ‘আচ্ছা যায়েদ! আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, আমাকে বল তো, আজ যদি এ মুহূর্তে তোমার স্থানে তোমার মনিব মুহাম্মদ আমাদের হাতে থাকত, আর তুমি তোমার পরিবারের মাঝে অবস্থান করতে, তবে কেমন হতো?’ এমন প্রশ্নে নবীপ্রেমে উদ্বেলিত যায়েদ (রা.) ঈমানদীপ্ত দাঁতভাঙ্গা যে জবাব দেন, ইতিহাসের পাতায় তা স্বর্ণাক্ষরে সংরক্ষিত হয়েছে আজও। তার প্রতিটি শব্দ থেকে যেন নির্গত হচ্ছিল ঈমানের বারুদ ও নবীপ্রেমের স্ফুলিঙ্গ। তার চোখেমুখে বিচ্ছুরিত হচ্ছিল আল্লাহপ্রেমের দ্যুতি ও ইশকে নবীর কিরণ। যায়েদ (রা.) নির্বিঘ্নে বললেন, ‘(আবু সুফিয়ান! তুমি তো অনেক বেশিই বলে ফেলেছ!) আল্লাহর কসম! মুহাম্মদ (সা.) যেখানে আছেন, সেখানে তার শরীরে একটি কাঁটা ফুটবে আর আমি ঘরে বসে থাকব, এতটুকুও তো আমি বরদাশত করব না!’ শুনে আবু সুফিয়ান চুপ থাকতে পারেনি। স্বজাতির সামনে চির সত্যটি স্বীকার করতে বাধ্য হলো, ‘মুহাম্মদের সঙ্গীরা তাকে যে পরিমাণ ভালোবাসে, এমন নিঃস্বার্থ ও গভীর ভালোবাসার নজির আমি কোথাও পাইনি।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম : ২/১৭২, বোখারি : ৪০৮৬)।

লেখক : সিনিয়র মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া হেমায়াতুল ইসলাম কৈয়গ্রাম, পটিয়া, চট্টগ্রাম

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত