ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ছোটদের সঙ্গে মহানবীর (সা.) আচরণ

আবদুল কাইয়ুম শেখ
ছোটদের সঙ্গে মহানবীর (সা.) আচরণ

আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আজ যারা শিশু সময়ের পরিক্রমায় কাল তারাই ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্ণধার হবে। দেশ ও জাতির দায়িত্বভার গ্রহণ করবে ও নেতৃত্ব দেবে। তাই শিশুদের মন, মনন ও মানস গঠনে তাদের সঙ্গে শুধু এমন আচরণই করা উচিত, যা তাদের চরিত্রবান মানুষ ও আদর্শ নাগরিকরূপে বেড়ে উঠতে সাহায্য করবে। কেননা, আজকের শিশু-কিশোরদের সঙ্গে যেমন আচরণ করা হবে ও তাদের যে শিক্ষা প্রদান করা হবে সে অনুযায়ীই তারা বেড়ে উঠবে। তাই ছোটদের সঙ্গে শুধু এমন আচরণই করা কাম্য ও তাদের শুধু এমন শিক্ষাই প্রদান করা উচিত, যার দ্বারা তারা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। শিশু কিশোরদের সঙ্গে আচরণ কেমন হওয়া বাঞ্ছনীয় ও তাদের শিক্ষা-দীক্ষা কেমন হওয়া উচিত তার স্পষ্ট নির্দেশনা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কর্ম ও উক্তিগুলোতে বিদ্যমান রয়েছে। ছোটদের সঙ্গে আচরণের নববি আদর্শের কিছু নমুনা পেশ করা হলো :

আল্লাহর বিধান মানার নির্দেশ : শিশু-কিশোরদের প্রথমেই শেখাতে হবে আল্লাহতায়ালা এক ও অদ্বিতীয়। তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। এই গোটাবিশ্ব তিনিই সৃষ্টি করেছেন। মানব, দানব ও সৃষ্টিকূলের স্রষ্টা তিনিই। তার শক্তি ও সামর্থ্য সীমাহীন। তার মতো ক্ষমতা আর কারো নেই। তিনি কারো উপকার করতে চাইলে কেউ তার ক্ষতি করতে পারে না। আর কারো ক্ষতি করতে চাইলে কেউ তার উপকার করতে পারে না। ভালো-মন্দ সব তারই পক্ষ থেকে হয়। তাই ইহ ও পরকালে রক্ষা পেতে চাইলে সর্বাবস্থায় আল্লাহতায়ালার সব বিধান মেনে চলতে হবে। তার আদেশ-নিষেধ মান্য করতে হবে। এজন্য বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদের আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার নির্দেশ প্রদান করতেন। হজরত ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, কোনো এক সময় আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পেছনে ছিলাম।

তিনি বললেন, ‘হে তরুণ! আমি তোমাকে কয়েকটি কথা শিখিয়ে দিচ্ছি। তুমি আল্লাহতায়ালার বিধিনিষেধ রক্ষা করবে, আল্লাহতায়ালাও তোমাকে রক্ষা করবেন। তুমি আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ্য রাখবে, এতে আল্লাহতায়ালাকে কাছে পাবে। তোমার কোনো কিছু চাওয়ার প্রয়োজন হলে আল্লাহতায়ালার কাছে চাইবে। আর সাহায্য প্রার্থনা করতে হলে আল্লাহর নিকটই করবে। জেনে রেখো, যদি সব উম্মতও তোমার কোনো উপকারের উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে ততটুকু উপকারই করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহতায়ালা তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। অপরদিকে যদি সব উম্মত তোমার কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে ততটুকু ক্ষতিই করতে সক্ষম হবে যতটুকু আল্লাহতায়ালা তোমার ভাগ্যে লিখে রেখেছেন। কলম তুলে নেয়া হয়েছে এবং লিখিত কাগজগুলোও শুকিয়ে গেছে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৫১৬)।

নামাজ আদায় করার নির্দেশ : প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগ পর্যন্ত ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য নামাজ আদায় করা ফরজ নয়। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই যদি ছেলেমেয়েদের নামাজ শেখানো না হয় ও আদায় করার নির্দেশ না দেওয়া হয়, তাহলে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও তারা নামাজ আদায় করতে সক্ষম হবে না, ফলে ফরজ হওয়ার পর বহু নামাজ ছুটে যাওয়া ও কাজা হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তাই মা-বাবা, শিক্ষক ও অভিভাবকদের দায়িত্ব হলো, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই ছেলেমেয়েদের নামাজ শেখানো ও তা আদায় করার নির্দেশ দেওয়া। ছেলেমেয়েদের বয়স সাত বছর হলেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের নামাজ আদায় করতে আদেশ করার নির্দেশ দিয়েছেন। হজরত আমর ইবনু শুআইব বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের সন্তানদের বয়স সাত বছর হলে তাদের নামাজ আদায়ের নির্দেশ দাও। যখন তাদের বয়স ১০ বছর হয়ে যাবে, তখন আদায় না করলে তাদের শাস্তি দেবে ও তাদের ঘুমের বিছানা আলাদা করে দেবে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৫)।

সালাম দেওয়ার নির্দেশ : আরবি সালাম শব্দের অর্থ হলো শান্তি। ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ’ বলে যে সালাম দেওয়া হয় তার অর্থ হলো, ‘আপনার উপর শান্তি ও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক’! সালামের অর্থের প্রতি লক্ষ্য করে প্রতীয়মান হয়, বাক্যটি শ্রদ্ধাজ্ঞাপক ও দোয়ামূলক। অতএব, যেসব লোককে সালাম দেওয়া হয় প্রকারান্তরে তাদের শ্রদ্ধা করা হয় ও তাদের জন্য কল্যাণের দোয়া করা হয়। আর শ্রদ্ধা ও কল্যাণের দোয়া পাওয়ার অধিকতর হকদার হলো আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার-পরিজন। তাই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশু-কিশোরদের তাদের পরিবার পরিজনদের সালাম দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। হজরত আনাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন, হে বৎস! তুমি যখন তোমার পরিবার-পরিজনের নিকটে যাও, তখন সালাম দিও। তাতে তোমার ও তোমার পরিবার-পরিজনের কল্যাণ হবে। (তিরমিজি, হাদিস : ২৬৯৮)।

সুন্দরভাবে খাওয়ার নির্দেশ : দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হলো খাবার খাওয়া। খাওয়া ছাড়া বেঁচে থাকা যায় না। প্রতিদিন আমরা বহুবার বিভিন্ন ধরনের খাবার খাই। এই খাবার খাওয়ার বেশ কিছু নিয়ম রয়েছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উম্মতকে খাবার খাওয়ার নিয়ম শিক্ষা দিয়েছেন। তার শিক্ষা দেওয়া খাওয়ার নিয়মগুলোর মধ্য হতে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য হলো হালাল খাওয়া। হারাম খাওয়া ইসলামে নিষেধ। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী যে দেহ হারাম দ্বারা পুষ্ট হয় তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এজন্য আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদেরও হারাম খেতে নিষেধ করতেন। বনু হাশেমের লোকদের জন্য সদকার মাল খাওয়া হারাম ছিল। একবার হজরত হাসান (রা.) সদকার একটি খেজুর মুখে দিলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বমির শব্দ করে তার মুখ হতে খেজুরটি বের করে ফেলেন।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, হাসান ইবনু আলি (রা.) সদকার খেজুর হতে একটি খেজুর নিয়ে তার মুখে দেন। তখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাখ্-কাখ্ করে বললেন, তুমি কি জান না, আমরা সদকা খাই না? (বোখারি, হাদিস : ৩০৭২)। পানাহারের বেশ কিছু নববি সুন্নত রয়েছে। এসব সুন্নতের কয়েকটি হলো, বিসমিল্লাহ বলে খাওয়া শুরু করা। ডান হাতে খাওয়া ও নিজের কাছ থেকে খাওয়া। বড়দের তো বটেই, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছোটদেরকেও খাওয়ার এসব নিয়ম শিক্ষা দিয়েছেন। হজরত উমর ইবনু আবু সালামা (রা.) বলেন, আমি ছোট ছেলে অবস্থায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামণ্ডএর খেদমতে ছিলাম। খাবার বাসনে আমার হাত ছুটাছুটি করত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, হে বৎস! বিসমিল্লাহ বলে ডান হাতে আহার কর এবং তোমার পাশ থেকে খাও। এরপর থেকে আমি সব সময় এ নিয়মেই খাদ্য গ্রহণ করতাম। (বোখারি, হাদিস : ৫৩৭৬)।

স্নেহ করা : শিশুদের সঙ্গে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামণ্ডএর আচরণ ছিল অত্যন্ত স্নেহপূর্ণ। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও শিশুদের স্নেহ করতেন এবং অন্যদেরও শিশুদের স্নেহ করার নির্দেশ দিতেন।

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক বাণীতে যেসব লোক শিশুদের স্নেহ করে না তাদেরকে নিজের দলভুক্ত নয় বলে আখ্যায়িত করে হুঁশিয়ার বাণী উচ্চারণ করেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রা.) বলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না ও বড়দের সম্মান করে না সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৪৩)। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেসব মহিলার প্রশংসা করেছেন যারা তাদের শিশু সন্তানদের প্রতি স্নেহশীল। এই প্রশংসা দ্বারা উদ্দেশ্য ছিল শিশুদের স্নেহের প্রতি গুরুত্বারোপ করে অন্যান্য মহিলাদের শিশুদের স্নেহ করার প্রতি উৎসাহিত করা। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, উষ্ট্রারোহী মহিলাদের মধ্যে কুরাইশি মহিলারা সর্বোত্তম। তারা শিশু সন্তানদের প্রতি স্নেহশীল এবং স্বামীর মর্যাদার উত্তম রক্ষাকারিণী। (বোখারি, হাদিস : ৫০৮২)।

লেখক : শিক্ষক, জামেয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা-১২১১।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত