মিউজিক শয়তানের বাঁশি
শাহাদাত হোসাইন
প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মিউজিক শয়তানের অন্যতম শক্তিশালী অস্ত্র। যার মাধ্যমে সে মানুষকে পথভ্রষ্ট করে। মিউজিক ব্যক্তিকে অবৈধ পথে পরিচালিত করে। ইসলাম থেকে দূরে সরায়। মানুষের মনে নেফাকের বীজ বপন করে। হৃদয়ে শিরকের অঙ্কুরোদগম করে। মিউজিকাসক্তি মানুষের অন্তরে মদের মত আসক্তির সৃষ্টি করে। ইবনু তাইমিয়্যা (রহ.) বলেন, গান-বাজনা, বাদ্যযন্ত্র অন্তরের মদ। মদের মত এটিও অন্তরে নেশার উদ্রেক করে (মাজমাউল ফাতাওয়া ১০ : ৪১৭)।
কোরআনের বর্ণনায় গান-বাজনা : গান-বাজনা আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধকৃত হারামবিষয়। মিউজিকাসক্ত ব্যক্তিদের জন্য আল্লাহ অবমাননাকর শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছেন। সুরা লোকমানে আল্লাহ ঘোষণা করেন- একশ্রেণির লোক আছে, যারা মানুষকে পথভ্রষ্ট করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথাবার্তা (গান-বাজনা) সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং উহাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি (৬)। সাহাবি জাবের (রা.) বলেন, আয়াতে অবান্তর কথাবার্তা দ্বারা উদ্দেশ্য হল, গান করা বা শ্রবণ করা। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, বরং তোমরা খেলতামাশায় (গান-বাজনায়) লিপ্ত রয়েছে (সুরা নাজম : ৫৯-৬১)। ইকরিমা (রহ.) এর বর্ণনামতে আয়াতে ’সামিদুন’ দ্বারা গান-বাজনা উদ্দেশ্য।
বাদ্যযন্ত্র ক্রয়বিক্রয় ইসলামে নিষিদ্ধ : ইসলামে গান-বাজনা নিষিদ্ধ। মিউজিক এবং তা সংশ্লিষ্ট সব বাদ্যযন্ত্রও নিষিদ্ধ। তাই, এগুলো ক্রয়-বিক্রয়, শিখন-শিক্ষাদান অবৈধ। নবীজি বলেছেন, আর এগুলো ক্রয়-বিক্রয় এবং শিক্ষাদান হালাল নয়। এগুলোর ব্যবসা এবং তা হতে উপার্জিত টাকা হারাম (ইবনে মাজাহ : ২১৬৮)। অন্যত্র এসেছে, নবীজি বলেছেন, গায়িকা দাসীকে ক্রয়-বিক্রয় কর না। এ ব্যবসায় কোনো উপকার নেই। এর দ্বারা উপার্জিত টাকা হারাম (তিরমিজি : ১২৮২)।
বাদ্যযন্ত্র ধ্বংস করা নবীজির মিশন : যে সব ভিশন ও মিশন নিয়ে নবীজি দুনিয়াতে এসেছিলেন, তার অন্যতম হচ্ছে- বাদ্যযন্ত্র, মিউজিক ইত্যাদিকে ধ্বংস করা। নবীজি বলেছেন, আল্লাহতায়ালা আমাকে জগতবাসীর জন্য রহমত ও পথ-প্রদর্শক হিসাবে প্রেরণ করেছেন এবং আমাকে আদেশ করেছেন, গান-বাজনা, বাদ্যযন্ত্র এবং মূর্তি ধ্বংস করতে (নাইলুল-আওতার ৮ : ২৬২)। নবীজি বলেছেন, তবলা হারামা। পিয়ানো, ম্যান্ডোলিন হারাম। ঢাকঢোলক হারাম এবং বাঁশি ইত্যাদিও হারাম (আস-সুনানুল কুবরা : ২১০০০)।
গান-বাজনা কোরআন ভুলিয়ে দেয় : কোরআন মানবের জীবন বিধান। নবীজি বলেছেন, আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে গেলাম। যতদিন তোমরা এ দুটিকে আঁকড়ে ধরবে, ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না। তা কোরআন এবং সুন্নাহ। মিউজিক, গান-বাজনা ব্যক্তিকে কোরআন থেকে দূরে সরায় এবং ভুলিয়ে দেয়। বাগদাদের এক মসজিদে বক্তৃতাকালে আলি (রা.) বলেছিলেন, গান-বাজনার আসর কোরআন ভুলিয়ে দেয়। সেখানে শয়তান উপস্থিত হয় এবং সব অশ্লীলতার দিকে মানুষকে আহ্বাণ করে (আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায়া ৭ : ৩০৭)।
মিউজিক শয়তানের বাঁশি : হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা তার সুরের মোহনায় ইঁদুরকে বশ করেছিল। আর মিউজিক-বাদ্যযন্ত্র শয়তানের এমন এক বাঁশি। যার দ্বারা সে মানুষকে বশ করে। প্রভাবিত করে। আল্লাহ বিমুখ করে। জাহান্নামের পথে পরিচালিত করে। নবীজি বলেছেন, বাদ্যযন্ত্র শয়তানের বাঁশি (মুসলিম : ২১১৪)। প্রত্যেকেরই উচিত মোহনীয় এ বাঁশির সুর থেকে নিজেকে হেফাজত রাখা।
গানের স্থান ও ব্যক্তির কাছে ফেরেস্তা আসে না : গান-বাজনা, মিউজিক এবং বাদ্যযন্ত্র এমন নিকৃষ্ট ও অপয়া যে, যারা গান করে কিংবা যে বাসায় বাদ্যযন্ত্র থাকে সেখানে রহমতের ফেরেস্তা আসে না। আবু হুরায়রা (রা.) নবীজি থেকে বর্ণনা করেন, যে স্থানে কুকুর কিংবা বাদ্যযন্ত্র থাকে সেখানে ফেরেস্তারা আসে না (মুসলিম : ২১১৩)। উম্মুল মুমিনিন সালমা (রা.) বলেন, আমি নবীজিকে বলতে শুনেছি, সেই ঘরে ফেরেস্তা প্রবেশ করে না যেখানে মিউজিক থাকে (নাসায়ি : ৫২২২)।
বাদ্যযন্ত্রে লিপ্ততা ধ্বংসের কারণ : মিউজিক আসক্তি মদাকাসক্ততার থেকে কোনো ক্ষেত্রে কম নয়। বাদ্যযন্ত্রে লিপ্ত থাকাবস্থায় একটি জাতির ধ্বংসের হবে। মাদকাসক্তি ও মিউজিকাসক্তির শেষ পরিণাম ধ্বংস। নবীজি বলেছেন, আমার উম্মতের একটি দল ভিন্ন নামে মদ পান করবে। যাদের মাথার ওপর বিভিন্ন প্রকারের বাদ্যযন্ত্রের বাজনা বাজতে থাকবে। আল্লাহতায়ালা তাদেরসহ সেই জমিন ধসিয়ে দেবেন (ইবনে মাজাহ : ৩২৬৩)।
গায়ক ও শ্রোতা বানর ও শুকরে পরিণত হবে : যারা গান গায় এবং যারা শ্রবণ করে, আখেরাতের শাস্তির সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়াতেও তারা লাঞ্ছনাকর শাস্তির সম্মুখীন হতে পারে। নবীজি বলেছেন, আমার উম্মতের একটি দল গান-বাজনা ও মদ্যপানে রাত্রিযাপন করবে। তারপর তারা শুকর ও বানর অবস্থায় প্রভাত করবে। আর জীবিতদের ওপর প্রেরণ করবেন ঝঞ্চাবায়ূ। যা তাদেরকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবে। যেমন তাদের পূর্ববর্তীদের করে দিয়েছিল। এই গজব তাদের ওপর আসবে, মদকে হালাল করার কারণে, ঢোলক, তবলা, নর্তকী ও গায়িকা গ্রহণ করার কারণে (মুসনাদে আহমাদ : ২২২৮৫)।
কানের মধ্যে গরম সীসা ঢালা হবে : যারা গান-বাজনা শ্রবণ করে আখেরাতে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভয়ানক শাস্তি। সাহাবি আনাস ইবনে মালেক (রা.) নবীজি থেকে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি গায়ক-গায়িকার আসরে বসবে। গান-বাজনা শ্রবণ করবে। কেয়ামতে তার উভয় কানে ফুটন্ত সীসা ঢালা হবে (আহকামুল কোরআন ৩ : ৫২৫)।
অন্তরে নেফাকির সৃষ্টি : মিউজিক ও গান-বাজনা অন্তরে নেফাক সৃষ্টি করে। গোনাহের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। ইবাদতের প্রতি অনীহা সৃষ্টি করে। সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদকে গান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, গান-বাজনা অন্তরে নেফাকি সৃষ্টি করে, যেমনিভাবে পানি শস্য-উদ্ভিদ উৎপন্ন করে (আল-জামে : ১৯৭৩৭)।
মিউজিক হালাল মনে করা : কেয়ামতের আগে মিউজিক, গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করা হবে। বিভিন্ন বাহানার আশ্রয় নিয়ে মিউজিক বৈধ বানানোর প্রচেষ্টা করা হবে। আবু মালেক আশয়ারি (রা.) নবীজি হতে বর্ণনা করেন, আমার উম্মতের একটি দল এমন হবেন, যারা রেশম ও রেশমী কাপড়, মদ এবং মিউজিককে হালাল মনে করবে (বোখারি : ৫৫৯০)। এই সময় চলে এসেছে, বর্তমানে বিভিন্নভাবে মিউজিক হালাল করার ব্যর্থ চেষ্টায় লিপ্ত মানুষ।
লানতপ্রাপ্ত দুই দল : নবীজি দুই শ্রেণির আওয়াজের অধিকারীর ওপর লানত বর্ষণ করেছেন। হাসান (রহ.) বলেন, দুটি আওয়াজ অশ্লীল, গোনাহের এবং লানতপ্রাপ্ত। একটি খুশির আওয়াজ। অন্যটি দুঃখের আওয়াজ। দুঃখের আওয়াজ হল, বিলাপ করা, মুখে আঁচড় কাটা, কাপর ছেঁড়া, চুল উপরা ইত্যাদি। আর খুশির আওয়াজ হল, বাদ্যযন্ত্র, ঢাক-ঢোল, বাঁশি ইত্যাদি বাজানো (আল-জামে : ১৯৭৪৪)।
মিউজিক শ্রবণে নবীজি যা করতেন : প্রখ্যাত তাবেয়ি না’ফে (রহ.) বলেন, একদা আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বাঁশির আওয়াজ শুনতে পেলেন। তখন তিনি দুই আঙ্গুলি স্বীয় কানের মধ্যে প্রবেশ করালেন এবং রাস্তার পার্শ্বে চলে গেলেন। তারপর তিনি আমাকে বললেন, হে না’ফে! তুমি কি কিছু শুনতে পাচ্ছ? আমি বললাম, না। তখন তিনি স্বীয় কান থেকে আঙ্গুল তুলে নেন এবং বলেন, আমি নবীজিকে দেখেছি তিনি রাখালের বাঁশির আওয়াজ শুনে এমনভাবে কানে আঙ্গুল দিয়েছিলেন। (আবু দাউদ : ৪৯২৪)।
লেখক : শিক্ষা পরিচালক, ভরসা মাদ্রাসা, রংপুর।