নবীজির ভাষায় সন্তানের অধিকার

শাহাদাত হোসাইন

প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সন্তানের প্রতি পিতামাতার যেমন অধিকার আছে, তেমনি পিতামাতার প্রতি সন্তানেরও কিছু অধিকার আছে। সাহাবি আবু রাফে (রা.) নবীজিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাদের যেমন সন্তানের ওপর অধিকার রয়েছে সন্তানেরও কি আমাদের ওপর অধিকার আছে? নবীজি বলেছিলেন, হ্যাঁ (বায়হাকি ৬ : ২৯০০)। পিতামাতার উচিত সন্তানের অধিকারগুলো যথাযথভাবে পালন করা। সন্তানের অধিকার কী? আল্লাহ ও তার রাসুলের ভাষায় সন্তানের অধিকার বিষয়ে আলোচনা করা হলো।

সমতা প্রতিষ্ঠা করা : সন্তানদের মাঝে সমতা, ইনসাফ ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা পিতামাতার দায়িত্ব। কাউকে কোলে আর কাউকে পিঠে রাখা ইসলাম সমর্থন করেন না। ইসলাম সবার প্রতি সমনজরে তাকাতে উৎসাহিত করে। হাসান (রা.) বলেন, একজন লোক নবীজির কাছে বসা ছিল। এমতাবস্থায় তার ছেলে সেখানে এলে তিনি ছেলেটিকে ডান উরুতে বসান। কিছুক্ষণপর তার দ্বিতীয় ছেলে সেখানে এলে তাকে মাটিতে বসান। নবীজি তার উদ্দেশে বলেন, কতই না ভালো হতো, যদি তুমি তাদের মাঝে সমতা বিধান করতে। তখন তিনি দ্বিতীয় ছেলেটিকে বাম উরুতে বসান (আল বিররু ওয়াস-সেলাতু : ৮১)। ইবনুল মুবারাক (রহ.) বলেন, তারা তাদের সন্তানদের মাঝে সমতা কায়েমে উদ্গ্রীব থাকতেন, এমন কি চুমুদানের ক্ষেত্রেও (আল বিররু ওয়াস-সেলাতু : ৮১)।

সুন্দর নাম রাখা : সন্তান পৃথিবীতে পদার্পণের পরে যে সব বিষয় পিতামাতার ওপর আবশ্যকীয় হিসাবে বর্তায় তার অন্যতম হলো, সন্তানের সুন্দর অর্থবোধক ইসলামিক নাম রাখা। নবীজি বলেছেন, পিতার প্রতি সন্তানের অধিকার হলো, তার সুন্দর নাম রাখা (বায়হাকি : ৮৬৫৮)। আমরা অনেকেই সন্তানের নাম রাখার ক্ষেত্রে উদাসীন। রিন্টু, ঝন্টু, পিন্টু ইত্যাদি নাম রাখি। যা কোনো অর্থবোধক নাম নয়। কোনো কাফেরের নামে নামকরণ করাও উচিত নয়। কিংবা কোরআনের কোনো শব্দ মনে ধরলেই তা সন্তানের নাম রাখা উচিত নয়- যেমন, লাহাব, মিনহা, মাহিন। এটা অনুচিত, কারণ শব্দটি কোরআনে থাকলেই হবে না বরং তার অর্থও সুন্দর হওয়া চাই। নাম রাখার ক্ষেত্রে কোনো আলেমের পরামর্শ নেওয়া উচিত। রাসুল (সা.) তার সাহাবিদের নাম পছন্দ না হলে নাম পরিবর্তন করে দিতেন। তার আসল নাম ছিল আবদুশ শামস; যার অর্থ সূর্যের গোলাম। রাসুল (সা.) নাম পাল্টে রাখেন আবদুর রহমান। যার অর্থ দয়াময়ের বান্দা। নবীজি (সা.) বলেছেন, আবদুল্লাহ ও আবদুর রহমান সবচেয়ে প্রিয় ও উত্তম নাম।

কোরআন শিক্ষা দেয়া : কোরআন মুসলিমের জীবন বিধান। কোরআন শেখা ছাড়া তার বিধান জানা ও আমল করা সম্ভব নয়। সন্তানকে কোরআন শিক্ষা দেয়া পিতামাতার আবশ্যকীয় কর্তব্য। সাহাবি আবু রাফে (রা.) বলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাদের মতো সন্তানেরও কি আমাদের ওপর অধিকার আছে? উত্তরে নবীজি বলেন, হ্যাঁ। পিতামাতার প্রতি সন্তানের অধিকার হচ্ছে, তাকে কোরআন শিক্ষা দেয়া (নাওয়াদেরুল উসুল ২ : ৩৪৮)।

ওমরের (রা.) কাছে এক ব্যক্তির অভিযোগ : ওমর (রা.)-এর কাছে একজন ব্যক্তি স্বীয় ছেলেকে নিয়ে এলেন এবং বললেন, আমার এই ছেলে আমার অবাধ্যতা করে। তখন ওমর (রা.) ছেলেটিকে বললেন, পিতামাতার অবাধ্যতার ক্ষেত্রে তুমি কি আল্লাহকে ভয় করো না! পিতামাতার অধিকারের ব্যাপারে আল্লাহ এমন এমন কথা বলেছেন। ছেলেটি বলল, হে আমিরুল মুমিনিন পিতার ওপর সন্তানের কি কোনো অধিকার নেই? উত্তরে ওমর বললেন, হ্যাঁ আছে। সুন্দর নাম রাখা। কোরআন শিক্ষা দেয়া ইত্যাদি সন্তারের অধিকার। তখন ছেলেটি বলল, আমার বাবা আমার একটি সুন্দর নামও রাখেনি এবং আমাকে কোরআনের একটি আয়াতও শেখাননি। তখন ওমর (রা.) এই বাবাকে বললেন, তুমি বলছ, ছেলে আমার অবাধ্য! অথচ তুমিই তাকে অবাধ্য হতে বাধ্য করেছ। চলে যাও আমার সামনে থেকে (তান্বিহুল গাফেলিন : ১৩০)।

শিষ্ঠাচার শিক্ষা দেয়া : সন্তানকে শিষ্টাচার, ভদ্রতা ও আদব আখলাক শিক্ষা দেয়া পিতামাতার কর্তব্য। হাদিসে এসেছে নবীজি বলেন, পিতামাতার ওপর সন্তানের অধিকার হলো, তাকে ভদ্রতা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া (মাজমাউজ-জাওয়ায়েদ ৮ : ৫০)। অন্যত্র এসেছে নবীজি বলেন, সন্তানকে ভদ্রতা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া প্রতিদিন অর্ধ-সা সম্পদ দান করার থেকেও উত্তম (আল বিররু ওয়াস-সেলাতু : ৮৬)। প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, কোনো পিতা স্বীয় সন্তানকে শিষ্টাচার ও ভদ্রতা অধিক উত্তম কোনো উপহার দিতে পারেন না (তিরমিজি : ১৯৫২)। প্রকৃতপক্ষেই, সন্তানকে উপহার-উপঢৌকন হিসাবে যাই দেবেন, তাই নষ্ট ও ধ্বংস হবে। কিন্তু শিষ্টাচার সন্তানকে আলোকিত করবে।

লেখা শিক্ষা দেয়া : দুনিয়ায় চলার জন্য সন্তানকে প্রয়োজনীয় বিষয়াদি শিক্ষা দেয়া পিতার কর্তব্য। সন্তানকে লেখা শিক্ষা দেয়াও পিতামাতার দায়িত্ব। কারণ লেখার মাধ্যমে সে দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ভাবে উপকৃত হতে পারে। নবীজি বলেছে, পিতার দায়িত্ব হলো, সন্তানকে লিখনি শিক্ষা দেয়া (নাওয়াদেরুল উসুল ২ : ৩৪৮)। লিখতে না জানা, সন্তানের একটি কমতি। এই ত্রুটির কারণে সর্বক্ষেত্রে তার হেরে যাওয়ার সম্ভবনা থেকে যায়।

সাঁতার শেখানো : দুনিয়ায় নিরাপদে বসবাস করতে, নদী ও সমুদ্রে শত্রুদের আক্রমণ থেকে নিজেকে হেফাজত রাখতে সাঁতারের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। তাই, সন্তানকে সাঁতার সেখানোও পিতার কর্তব্য। নবীজি বলেছেন, পিতার প্রতি সন্তানের অধিকার হলো, তাকে সাঁতার শিক্ষা দেয়া (নাওয়াদেরুল উসুল ২ : ৩৪৮)। যাতে বিপদের সময় সাঁতারের মাধ্যমে নিজের জীবন রক্ষা করতে পারে।

অস্ত্র ব্যবহার শেখানো : আত্মরক্ষার তাগিদে এবং শত্রুর মোকাবিলায় নিজের আবরু ও সম্মান রক্ষায় সন্তানকে তীরান্দাজ ও অন্যান্য অস্ত্রের ব্যবহার শেখানো পিতার দায়িত্ব। নবীজি বলেছেন, পিতার দায়িত্ব হলো, সন্তানকে তীরান্দাজি শেখানো (নাওয়াদেরুল উসুল ২ : ৩৪৮)। সেই যুগের জন্য তীরান্দাজের কথা বলা হলেও বর্তমান সময়ের জন্য অন্যান্য অস্ত্র পরিচালনার শিক্ষা দেয়াও পিতার কর্তব্য। যুগ-সচেতন কোনো ব্যক্তি অস্ত্র ব্যবহার শিক্ষার গুরুত্বকে অস্বীকার করতে পারেন না। এটি ব্যক্তির জন্য যেমন উপকারী রাষ্ট্রের জন্যও তেমন প্রয়োজনীয়। দুঃখের বিষয় অমুসলিমরা নিজেদের সন্তানদের অস্ত্র শিক্ষা দিলেও মুসলিমরা জুজুর ভয়ে নিজেদের সন্তানদের আত্মরক্ষার জন্যও অস্ত্রের ব্যবহার শিক্ষা দিতে রাজি নয়।

হালাল খাদ্যদান : পিতার প্রতি সন্তানের অন্যতম অধিকার হলো, সন্তানকে হালাল ও উত্তম রিজিক দেয়া। পিতার প্রতি যতদিন সন্তানের খোর-পোষের দায়িত্ব থাকবে, ততদিন সন্তানকে হালাল খাবার খাওয়ানো পিতার কর্তব্য। হাদিসে এসেছে নবীজি বলেন, পিতার ওপর সন্তানের অধিকার হলো, তিনি সন্তানকে হালাল ও উত্তম খাবার ব্যতীত অন্য কিছু দেবেন না (নাওয়াদেরুল উসুল ২ : ৩৪৮)। যাতে করে নাপাক ও হারাম খেয়ে তার রক্ত মাংস তৈরি না হয়। নবীজি বলেছেন, সেই শরীর জান্নাতে যাবে না, যে শরীর হারাম দ্বারা গঠিত (বাযযার ১ : ১০৫)।

বাসস্থানের ব্যবস্থা করা : সন্তানের উত্তম বাসস্থানের ব্যবস্থা করাও পিতার দায়িত্ব। সাহাবি মুসআব ইবনে সা’দ বর্ণনা করেন। নবীজি বলেছেন, পিতার প্রতি সন্তানের অধিকার হলো, তার সুন্দর নাম রাখা। উত্তম বাসস্থানের ব্যবস্থা করা এবং শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া (মুজামুশ-শুয়ুখ : ৩২০)।

যথাসময়ে বিবাহ দেয়া : সন্তান প্রাপ্ত বয়স্ক হলে তাকে বিবাহ দেয়া পিতার দায়িত্ব। নবীজি বলেছেন সন্তানের প্রতি পিতামাতার দায়িত্ব হলো, সন্তান প্রাপ্ত বয়স্ক হলে তাকে বিবাহ দেয়া (আল-ফেরদাউস : ২৬৭০)। আবু হোরায়রা (রা.) বলেন, তিনটি বিষয় পিতার প্রতি সন্তানের অধিকার। যথা- জন্মগ্রহণের পরে সুন্দর নাম রাখা। বুঝতে শিখলে কোরআন শিক্ষা দেয়া আর প্রাপ্ত বয়স্ক হলে বিবাহ দেয়া (আল-ফেরদাউস : ২৬৭০)। জৈবিক চাহিদাকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। যদি বৈধপন্থায় সন্তানের চাহিদা নিবারণ করা না হয়, তাহলে তারা অবৈধ পন্থায় চাহিদা পূরণ করবে। আর বিবাহবহির্ভূত যৌনাচারে দুনিয়াবি হরেকরকম মরণ ব্যাধির সঙ্গে পরকালীন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। তাই, সঠিক সময়ে সন্তানকে বিবাহ দেয়াই দায়িত্বশীল পিতার কাজ।

নবীজির দোয়া : সন্তানকে ভালো কাজের পথপ্রদর্শন করা এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখা পিতামাতার একান্ত কর্তব্য। সন্তানকে সৎকাজে উৎসাহদানকারী পিতামাতার জন্য নবীজি দোয়া করেছেন। মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বাহ কিতাবে এসেছে, নবীজি বলেন, আল্লাহতায়ালা সেই জনকের প্রতি দয়া করুন! যিনি সৎকাজে সন্তানকে সাহায্য করেন (২৭০৫৭)। নবীজির বরকতময় দোয়া পেতে সন্তানকে ভালো কাজে সাহায্য করা উচিত।

লেখক : শিক্ষা পরিচালক, ভরসা মাদ্রাসা, রংপুর