উঁহ! উঁহ!...শব্দে ঘুম ভেঙে যায় রাসুলে আরাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের। খুব পরিচিত কণ্ঠ। তার শ্বাস-নিঃশ্বাসের শব্দটাও তিনি চিনেন। শৈশব থেকে কৈশর। জীবনের বাঁকে বাঁকে অজস্র স্মৃতির যেখানে মিছিল করে। মক্কার পাথুরে জমিনে যার আঙুলের ডগায় ধরে পথ হেঁটেছেন তিনি। মক্কার সেই বয়কটের দিনগুলোতেও যে মানুষটি সঙ্গে ছিলেন। তাকে ছেড়ে কাফেরদের সঙ্গে মিশে যাননি। কী ভয়াবহ দিন ছিল। লতাপাতা ভক্ষণ করে পড়ে থেকেছেন ভাতিজার সঙ্গে। ওই চাচারই শব্দ। স্মৃতির উঠোনে ভেসে উঠছে অতীত। কিছুই বাদ যাচ্ছে না। একদম স্পষ্ট আয়নার মতো জীবন্ত অতীত। আজ তিনি বন্দি। বদর প্রান্ত থেকে যুদ্ধ বন্দিদের একজন। কিন্তু কিছুই করার নেই। এখানে সবাই সমান। এককভাবে কারো শাস্তি হ্রাস করে দেওয়ার সুযোগ তিনি নিতে চাচ্ছেন না।
নির্ঘুম রাত কাটান রাসুলে আরাবি। এপাশ-ওপাশ করেও লাভ হচ্ছে না। কোনো অচিনপুরে যেন ঘুম নামক প্রশান্তির পায়রাটা উড়াল দিয়েছে। তা কোনোভাবে নিজের আয়ত্ত্বে আনতে পারছেন না। কেমন করেই বা আনবেন! তিনিও তো কঠিন ও অপ্রতিকূল সময়েও আত্মীয়তার বন্ধনকে ছোট করে দেখেননি। এসব ভাবনার সময় হয়তো বা মনে হলো- একটু বাইরে ঘুরে আসলে কেমন হয়? এমন কিছু ভেবে তিনি বাইরে আসলেন। স্বচ্ছ আকাশ। নির্মল বায়ূ। এতো শান্ত পরিবেশেও ঘুম আসছে না! মনের ভেতর নাড়ির টানের ব্যথা বার বার আঘাত করছে। রাসুলে আরাবি ঘুমাচ্ছেন না। একাকী হাঁটছেন। কোনো সমস্যা নয় তো? উদ্বিগ্ন হওয়ার ব্যাপার ঘটেনি তো? একজন সাহাবি এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি ঘুমাচ্ছেন না হে রাসুলুল্লাহ! রাসুলে আরাবি তো আলআমিন! জীবনে কখনো মিথ্যা বলেননি। তিনি হয়তো ক্ষণিক ভেবে সত্য কথা বলতে দেরি করলেন না। একদম নির্দ্বিধায় নিঃঙ্কুচে বলে দিলেন- ‘কীভাবে ঘুমাব বল? আমার চাচা বন্দি। ব্যথার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। তার কান্না আমাকে ঘুমাতে দেয় না।’ সাহাবিরা অবাক! কী বলেন মহানবী। তিনি চাইলেই আজাদ করে দিতে পারেন চাচাকে। তাহলে করছেন না কেন? বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়। গাঢ় হয়। সত্যিই তিনি ইনসাফের নবী। মনবতার নবী। আপন হলেও ইনফাস করতে বিন্দু পরিমাণ কার্পণ্য করতে দ্বিধা করছেন না। এভাবে কাটছে দিন। বদর যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়ে গেলো। ওমর (রা.) ঈমানি চেতনায় উজ্জীবত হয়ে বললেন, ‘এরা সবাই কাফেরদের নেতা। সবাইকে হত্যা করা হোক। ইসলামের শৌর্য-বীর্য প্রকাশ পাবে। নিকটাত্মীয় মুসলমানরা তাদের আত্মীয়দের হত্যা করবে। সঙ্গে সঙ্গে ঈমানেরও পরীক্ষা হয়ে যাবে।’ আর আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বললেন, ‘ফিদিয়া নিয়ে মুক্ত করে দেওয়া হোক। সম্ভবত তারা ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হবে।’ দয়ার নবীর মনে দয়া উদয় হলো। তিনি ফিদিয়া নিয়ে মুক্তির ফায়সালা দিয়ে দিলেন। মক্কার বড় বড় নেতারা মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত হতে লাগল। আর যারা মুক্তিপণ দিতে পারবে না, তারা ১০ জন শিশুকে শিক্ষা দিয়ে মুক্তি পেয়ে যাওয়ার ফায়সালা হয়ে গেল। এমন আজব ফায়সালা এর আগে কেউ দেখেনি, শুনেনি।
একদিকে আব্বাস বড় নেতা, অন্যদিকে রাসুলে আরাবির চাচা। তার কাছ থেকে মুক্তিপণ নেওয়া যাবে না। সবাই আব্বাসকে বিনাশর্তে মুক্ত দেখতে চায়। কোনোভাবে তার কাছ থেকে মুক্তিপণ না নেওয়া হোক। তাই অনেকে আবেদন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আব্বাসকে মাফ করে দেন। ওনি আপনার চাচা।’ রাসুলে আরাবি গর্জে উঠলেন। তিনি কোনোভাবে রাজি হলেন না। স্পষ্ট বলে দিলেন, ‘না, তার কাছ থেকেও ফিদিয়া নিতে হবে।’ এদিক দিয়ে আব্বাস মুক্তিপণ দিতে অস্বীকার করেছেন। সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তার কাছে দেবার মতো কোনো কিছুই নেই। তাকে মুক্তিপণ ছাড়া মুক্ত করে দেওয়া হোক। রাসুলে আরাবি এ কথা শুনে আব্বাস (রা.) কাছে গেলেন। শুনতে চাইলেন তার কথা। রাসুলে আরাবিকে দেখে চাচা আব্বাস সত্যিই স্পষ্ট মুক্তিপণের ব্যাপারে অক্ষমতা প্রকাশ করে বলছেন-
‘হে মুহাম্মদ! এটা বড় লজ্জার বিষয়। তোমার চাচা মুক্তিপণের অর্থ সংগ্রহে কুরাইশদের কাছে হাত প্রসারিত করবে।’ রাসুল বড় বিস্ময় প্রকাশ করলেন। এ ব্যাপারে রাসুলে আরাবির মাঝে কোনো ধরনের শঙ্কোচতা নেই। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলে উঠলেন-
‘সফরের আসার আগে আপনি আপনার স্ত্রী উম্মুল ফজলের কাছে যে সোনা রেখে এসেছেন, সেগুলোর কী হয়েছে?’
আব্বাস (রা.) বিস্ময়ে হতবাক। কী বলে মুহাম্মদ! ও কি গুপ্ত কথাও জানে! মুখে মুখে শুধু শুনেই এসেছি ও অনেক জানে। বলে কী মুহাম্মদ! এমন বিষয়ে আমাকে সে প্রশ্ন করে ফেলল, যা আমি ও উম্মুল ফজল ছাড়া কেউ জানে না! খুব আশ্চর্যের ব্যাপার! না, নিঃসন্দেহে সে নবী হবে! তাই স্পষ্ট কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘হে মুহাম্মদ! নিঃসন্দেহে আল্লাহতায়ালা তোমাকে এ সংবাদ জানিয়ে দিয়েছেন। শোন শোন মুহাম্মদ! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ এক। আর তুমি তাঁর রাসুল।’ (রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু)।
লেখক : আলেম ও গল্পকার