ওরিয়েন্টালিজম একটি একাডেমিক শৃঙ্খলা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার আগ থেকে পশ্চিমারা ইসলামকে অধ্যয়ন করে একটি প্রতিপক্ষ সভ্যতা হিসেবে। মুহাম্মদ (সা.) যেহেতু এর প্রবক্তা, ফলে তাঁর প্রতি তাদের আগ্রহ ছিলো তুঙ্গে। সাধারণভাবে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া নেতিবাচক ও বিতর্কমূলক উদ্দেশ্য থেকে আগ্রহটি পরিচালিত হয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণা বা সত্যের অনুসন্ধানের প্রচেষ্টার পরিবর্তে তা দাঁড়িয়েছিল নিন্দা ও অবজ্ঞার ভিত্তির উপর। মহানবী (সা.) বিষয়ক মধ্যযুগীয় পশ্চিমা রচনাবলী সত্যের প্রতি মোটেও মনোযোগী ছিল না। ঘৃণা, বিদ্বেষ ও শত্রুতার আবেগ সেসব রচনাকে নিন্দা ও মিথ্যার এমন স্তূপে পরিণত করে, যার হিংস্র চরিত্র নিয়ে আক্ষেপ করেছেন ইসলামের সমালোচক বার্নার্ড লুইস (১৯১৬-২০১৮) এর মতো ব্যক্তিত্বও! কিন্তু এ আক্ষেপ যথেষ্ট নয়। পশ্চিমারা যদি সত্য ও সততার প্রতি নিজেদের দায়কে অস্বীকার না করে, তাহলে মহানবী (সা.) সম্পর্কে বিরতিহীন মিথ্যাচার পরিহার করা এবং অতীতের অনাচারের জন্য তাদের ক্ষমাপ্রার্থনা করা উচিত ছিল।
কিন্তু দেখা গেল ওরিয়েন্টালিজম যখন জ্ঞানশৃঙ্খলা হিসেবে দাঁড়াল, তখন প্রাচ্যবিদগণ সাধারণভাবে পূর্ববর্তী এসব রচনাকে ব্যবহার করলেন সূত্র হিসেবে! এসব অবৈজ্ঞানিক নিন্দাপ্রধান রচনাকে অবলম্বন করে তারা অঙ্কন করতে লাগলেন ইসলামের ছবি। ঘৃণা ও শত্রুতার গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া পুরোনো কুসংস্কারগুলোকে কাজে লাগানো হলো হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ভাবকল্প নির্মাণে। মহানবীর (সা.) প্রশ্নে প্রাচ্যতত্ত্ব সাধারণভাবে অপবাদ ও ইতিহাসের মধ্যে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হয়েছে। কিছু সম্মানজনক ব্যতিক্রম ছাড়া প্রাচ্যবিদগণ ইসলাম ও মহানবীকে (সা.) দেখেছেন পক্ষপাতদুষ্ট চোখ দিয়ে, বিকৃতিপ্রয়াসী ছিলো তাদের ল্যান্স। মহানবীর মহান বৈশিষ্ট্য ও অবদানসমূহকে অবজ্ঞা, উপেক্ষা ও খণ্ডিত করার মধ্যে তারা তৃপ্তি তালাশ করেছেন। তাদের উদ্যম ও উত্তেজনা কাজ করেছে বিতর্ক তৈরি, ত্রুটির তালাশ এবং ব্যক্তিত্বের মহিমা হত্যার পেছনে।
এটা সত্য যে, ইসলামের প্রসার খ্রিষ্টবিশ্বের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে প্রবলভাবে। ফলে ইসলাম শুরু থেকেই রোমান রাজনীতিক, পাদ্রী ও প্রচারকদের জবানীতে বিবৃত হয়েছে একটি হুমকি হিসেবে, যাকে বরাবরই একটি ভ্রষ্টতা ও বিকৃতি হিসেবে দেখানো হয়েছে। ভিত্তিহীন বক্তব্যসমূহ তারা ছড়িয়েছেন বিপুলভাবে। যার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম ও নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর বিকৃত চিত্র তৈরি করে ইসলাম থেকে দূরে থাকার জন্য মানুষকে বিভ্রান্ত করা। সুতরাং তাদের জবানীতে মহানবী হয়ে উঠেছেন ‘মানসিকভাবে অসুস্থ’, একজন ‘মিথ্যাবাদী’, একজন ‘ভুয়া নবী’ এবং একজন ‘খ্রিষ্ট-বিরোধী’, যার কোনোটিরই কোনো বাস্তব ঐতিহাসিক ভিত্তি ছিল না। এই ধরনের অবমাননাকর ছবি কয়েক শতাব্দী ধরে অব্যাহতভাবে তৈরি ও পুনঃ উৎপাদিত হয়েছিল। এই ধারায় জন্ম লাভকারী সাহিত্যকর্মের সংখ্যা ও পরিধি ছিল বিপুল, বিস্তর এবং একরোখা চরিত্রে ক্রমবর্ধমান। খ্যাতিমান প্রাচ্যবিদ মন্টগোমারি ওয়াট (১৯০৯-২০০৬) স্বীকার না করে পারেননি যে, ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষদের মধ্যে, হযরত মুহাম্মদের (সা.) মতো কাউকে এতো বেশি অপমান করা হয়নি। (মুহাম্মদ অ্যাট মদিনা, পৃ. ৩২৪)।
দীর্ঘকাল ধরে মহানবী (সা.)-কে ম্যাফোমেট (Maphomet) বাফোমেট (Baphomet) এবং বাফুম (Bafum) নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এসব নাম সবক’টিই নেতিবাচক অর্থে ভরা। যা দানব, প্রতিপক্ষ, ভণ্ড এবং হিংস্র অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। মুসলমানদের বলা হয়েছিল পৌত্তলিক, যারা পূজা করে মাহোমেট এর প্রতিমার!
মহানবীর (সা.)লিখিত বিবরণে ভ্রষ্ট চিত্রায়ন শুরু হয় John of Damascus (মৃত্যু-৭৫০) এর হাত দিয়ে।
তিনি ছিলেন সিরিয়ার এক খ্রিষ্টান ধর্মযাজক। তিনি তার dialogue between a saracen and a christian গ্রন্থে মহানবী সা. সম্পর্কে আলোকপাত করেন। চারপাশের লোকদের প্রতারিত করেন, মিথ্যানবী, খ্রিষ্টধর্মের নকলকারী ইত্যাদি অপবাদ দিয়ে তিনি মহানবীকে উপস্থাপন করেন, যিনি অ্যারিয়ান পুরোহিতদের সাহায্যে খ্রিষ্টান উৎস ব্যবহার করে ইসলামকে তৈরি করেছেন! ভিত্তিহীন সমালোচনার ভিত তৈরি করে জনের এই বই। জন ইসলামের যুদ্ধগুলোকে কলঙ্কিত করেন এবং ইসলামের মহিমাকে করেন অস্বীকার। বস্তুত মুসলিমদের বিপরীতে খ্রিষ্টানরা কীভাবে তর্ক করবে, তার কৌশল শেখানোর জন্য বইটি রচিত হয়। শত্রুতার উত্তাপ বাড়ানো এবং এর চর্চাকে বিস্তৃত করার অভিপ্রায় থেকেই বইটির জন্ম। কিন্তু পরবর্তী প্রাচ্যবিদদের কাছে এটা হয়ে গেলো মাতৃগ্রন্থ। এ গ্রন্থে যে শত্রুতার ভাষা তৈরি করেন জন অব দামেশক, সেই শত্রুতাকে ইসলামের ব্যাপারে জ্ঞানীয় সত্য হিসেবে উপস্থাপন করতে থাকল পরবর্তী প্রাচ্যবাদ।
মহানবীর জীবনী নিয়ে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে বসবাসকারী পুরোহিত এবং অন্যান্যদের নানা কাজ শত্রুতামূলক উদ্বেগ ও প্রতিপক্ষীয় উত্তেজনায় ফেনায়িত ছিলো। নবম শতকে Nicetas Byzantium কর্তৃক রচিত Refutatio Mohammedis, থিওফেনেস দ্য কনফেসার (৭৫২-৮১৮), কর্তৃক রচিত Chronographia মহানবীর সা. বিপরীতে বৈরী উত্তাপ তৈরিতে মনোযোগী ছিলেন। চার্চ অব রুমের প্রধান অর্কাইভিস্ট Anastasius Bibliothecarius (৮১০-৮৭৮) কনফেসারের বইটিকে আবিষ্কার ও সম্পাদনা করেন এবং তিনি তার compiled বা Chronographia tripartita গ্রন্থে মহানবীর প্রশ্নে অপবাদের চর্চা করেন।
অন্যদিকে স্পেনে মুসলিম বিজয়ের দীর্ঘকাল পরে খ্রিষ্টবাদী জাতীয়তাবাদের ভেতর থেকে এক ধরনের প্রান্তিক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। যা ইসলাম ও নবী মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী ও ভুল বোঝাবুঝি ছড়ানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর পেছনে সক্রিয় চরমপন্থা শান্তিনাশের অন্ধ চেষ্টায় লিপ্ত ছিলো। কর্ডোভার সেন্ট জুলিয়াস গির্জার যাজক ইউলোজিয়াস (৮১৯-৮৫৯) পারফেকটাস (৮৫০ খ্রি.) এবং এলভারোর (৮৫৯খ্রি.) নেতৃত্বে স্পেনে আনুষ্ঠানিকভাবে জিলট মুভমেন্ট বা ধর্মান্ধ আন্দোলন শুরু হয়। মুসলিমদের মসজিদ, সম্মেলন কিংবা বাজারের ভিড়ে ইসলাম ও হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর অব্যাহত অপমানকে তারা কৌশল হিসেবে নিয়েছিল। সব ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও তাদের এ বিদ্রোহের সুনির্দিষ্ট কারণ পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হয় মুসলিম শাসনে ঈর্ষান্বিত হয়ে তারা এ আন্দোলনের সূচনা ঘটায়।
ন্টনি গোমেজের মধ্যস্থতায় খ্রিষ্টান বিশপগণ এই চরমপন্থাকে প্রত্যাখ্যান করলেও জিলট মুভমেন্ট কোনো নিয়ম বা যুক্তির ধার ধারত না। জিলটরা মহানবী (সা.) সম্পর্কে সঠিক তথ্য থেকে দূরে ছিল না এবং ইসলামের সত্যতা সম্পর্কেও অন্ধকারে ছিল না। তারা মূলত চেয়েছিল নৈরাজ্য এবং বিদ্রোহ।
যে কোনো উপায়ে সাম্প্রদায়িক রক্তপাতের মধ্য দিয়ে স্পেনের মুসলিম শাসনকে বিপদে ফেলার জন্য আত্মঘাতী উপায় অবলম্বনে উদ্যমী ছিল তারা। মহানবী (সা.) সম্পর্কে মিথ্যা, উদ্ভট ও বিকারগ্রস্থ গল্পসমূহ তারা তৈরি করে। শত্রুতামূলক নানা সাহিত্যও জন্ম নেয় তখন। সেন্ট ইউলোজিয়াসের liber apologeticus martyrum ঘৃণার উপর ভর করে রচিত ল্যাতিন গ্রন্থ।
যা রচিত হয় ৮৫৭ থেকে ৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে। এই গ্রন্থে মহানবীর (সা.) প্রসঙ্গ আলোচিত হয় বারবার। যে আলোচনা জন্ম নিয়েছে রাসুল (সা.) এর প্রতি সর্বোচ্চমাত্রার বিদ্বেষের গর্ভ থেকে।
এমনতরো ঘৃণার আরেকটি জ্বালামুখ তৈরি হয় ক্রুসেডের প্রেক্ষাপটে। সেকালে অগ্রসর মুসলিম দুনিয়ার প্রতি অনগ্রসর খ্রিষ্টবিশ্বের ধ্বংসাত্মক অভিপ্রায়ের প্রতিফলিত রূপ হলো ক্রুসেড। ১০৯৫ সালে সূচিত ক্রুসেড ২০০ বছর ধরে ঘৃণা ও ক্রোধের উপর সওয়ার হয়ে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে অব্যাহতভাবে আপতিত হয়েছে ইউরোপ থেকে মুসলিম জাহানে। এ সময় শোনা যাবে Petrus Venerablis তথা Peter of Montboissier (১০৯২-১১৫৬) এর কণ্ঠস্বর। ইসলামচর্চায় তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন পশ্চিমে। টলেডোর ক্লোনি গীর্জা হয়ে উঠেছিলো ইসলাম অধ্যয়নের কেন্দ্র। অধ্যয়নের কেন্দ্রে ছিলো শত্রুতার ঐতিহ্য। পিটারের গবেষণাসমূহ অধিকতরো পরিশীলিত উপায় সন্ধান করেছে ইসলামকে আক্রমণের জন্য। কারণ ততক্ষণে ইসলামি দুনিয়ার জ্ঞানজগতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটেছে স্পেনের পাশাপাশি সিরিয়ায়, ফিলিস্তিনে। পুরোনো গালগল্প ও একরৈখিকতা সেভাবে কাজ দিচ্ছিল না। কিন্তু পিটারের কাজগুলো পুরোনো মিথ ও মিথ্যাসমূহের ভিত্তি প্রদানেরই চেষ্টা করেছে। সেই সব গবেষণা এখনো বিখ্যাত Toledo-Cluny collection নামে।
লেখক: কবি ও গবেষক