ঢাকা ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আযাদী আন্দোলন ও মাওলানা খায়রাবাদী (রহ.)

মাহমুদ হাসান ফাহিম
আযাদী আন্দোলন ও মাওলানা খায়রাবাদী (রহ.)

মাওলানা ফজলে হক খায়রাবাদী রহ. (১৭৯৭-১৮৬১) ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের প্রধান ব্যক্তি। তিনি একজন দার্শনিক, লেখক, কবি ও বিজ্ঞ আলেম। ১৮৫৭ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদের ফতোয়া দেয়ার কারণে আজও ইতিহাস তাকে স্মরণে রেখেছে বর্ণে বর্ণে।

জন্ম ও শিক্ষা-দীক্ষা : মাওলানা ফজলে হক খায়রাবাদী (রহ.) ১৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দে অযোধ্যার অন্তর্গত ‘খায়রাবাদ’-এ জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ফজলে ইমাম ছিলেন সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ জ্ঞান সাধকদের অন্যতম একজন। তিনি ছিলেন দিল্লির ‘সদরুস সুদুর’ বা সরকারের প্রধান আইন ব্যাখ্যাতা। পিতার যত্নে মাওলানা ফজলে হক খায়রাবাদী অতি অল্প বয়সেই কোরআনের হাফেজ ও ইলমে মা’লাকুত (ন্যায়শাস্ত্র, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও প্রাচীন পদার্থবিদ্যা) প্রভৃতিতে একজন বিজ্ঞ আলেম হয়ে ওঠেন। তিনি বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস শাহ আব্দুল আজীজ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহ.) এর কাছে হাদীস ও দ্বীনিয়াত শিক্ষা করেন। এই সময় মাওলানা ফজলে হক খায়রাবাদীর অসাধারণ ধী-শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়।

ইলমি পাণ্ডিত্যে খায়রাবাদি: ইসলামি ধর্মতত্ত্বের পণ্ডিত হলেও মাওলানা ফজলে হক খায়রাবাদী ছিলেন একজন সাহিত্যিক, বিশেষত উর্দু, আরবি ও ফারসি ভাষায়। মির্জা গালিবের অনুরোধে তিনি তার প্রথম দিওয়ান সম্পাদনা করেন। পান্ডিত্যের জন্য তাকে আল্লামা বলা হতো। একজন মহান সুফি হিসেবে তাকে সম্মান করা হতো। তাকে ইমামে হিকমত ও কালাম (যুক্তি, দর্শন ও সাহিত্যের ইমাম) হিসেবেও সম্বোধন করা হতো। ফতোয়া প্রদানের ক্ষেত্রে তার বক্তব্যকে চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করা হতো।

মাওলানা ফযলে হক খায়রাবাদী প্রাচীন মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বশেষ প্রবক্তা ও ব্যাখ্যাতা বলে অভিহিত হতেন। তিনি ছিলেন বুদ্ধিদীপ্তিক ব্যক্তি। মির্জা গালিব ও সমসাময়িক অন্যান্য খ্যাতনামা কবি, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তার শাণিত কথোপকথনের বেশ কিছু গল্পও রয়েছে।

তিনি প্রবাদ পুরুষ : মোগল শাসনের শেষ প্রতীক যেমন ছিলেন বাহাদুর শাহ যাফর, তেমনি এই উপ-মহাদেশে প্রাচীন আলেম সমাজের অসাধারণ প্রতিভা ও জ্ঞান সাধনার প্রতীক ছিলেন মাওলানা ফযলে হক খায়রাবাদী। শেষ মোগল সম্রাট শুধু কেল্লা ও শহরের চার দেওয়ালের মালিক মুখতার ছিলেন। তার দরবারের আমির-উমরাহ এবং তার বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে বিদ্রূপ করা চলে, কিন্তু শেষ যমানার দিল্লির সেই বিদ্বানমণ্ডলীর মধ্যেও এমন কতিপয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যাদের নাম কোনো কালেই ম্লান হওয়ার মতো নয়। অমর কাব্য প্রতিভায় আসাদুল্লাহ খান গালিব, জহির দেহলবী, মাওলানা শাহ আবদুল কাদের, মাওলানা শাহ রফীউদ্দীন ও মাওলানা ফযলে হক খায়রাবাদী প্রমুখ ব্যক্তির নাম আজও উল্লেখ করা হয়।

বৈচিত্র্যময় কর্ম জীবন : মাওলানা ফজলে হক খয়রাবাদী লখনৌর প্রধান বিচারক ছিলেন। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিদ্রোহে উৎসাহ প্রদান ও নেতৃত্বের জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তিনি নিজেই তার আত্মপক্ষ সমর্থনে লড়াই চালিয়ে যান। মিথ্যা বলতে পারবেন না উল্লেখ করে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তিনি তার ফতোয়া দেয়ার কথা স্বীকার করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে কালাপানিতে পাঠানো হয় এবং অযোধ্যা আদালতের বিচারক কমিশনার কর্তৃক তার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়। ১৮৫৯ সালে ৮ অক্টোবর তাকে আন্দামানে নির্বাসন করা হয়।

আজাদী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ : ইমামে আহলে সুন্নাত মাওলানা ফজলে হক খায়রাবাদী ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের সময় ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেওয়ার অভিযোগে আন্দামান দ্বীপে নির্বাসিত হন। সে দ্বীপে তাকে যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল তার এক হৃদয় বিদারক বর্ণনা এবং উপমহাদেশে ইংরেজদের ইসলামবিরোধী কার্যকলাপের এক বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন কাফনের কাপড়ে কয়লা দিয়ে লিখা এক কিতাবে। অবশেষে সারা দুনিয়াব্যাপী বিশ্বখ্যাত এ জ্ঞান সাধকের প্রতি করা নির্যাতনের প্রতিবাদে এবং মাওলানা খায়রাবাদী (রহ.) এর জ্ঞান প্রতিভার প্রতি আকৃষ্ট ঊর্ধ্বতন এক ইংরেজ কর্মকর্তার জোর তদবিরে কয়েক বছর পর তাকে ব্রিটেনের প্রিভি কাউন্সিল মুক্তির নির্দেশ দিতে বাধ্য হয়।

ছেলে মাওলানা আব্দুল হক খায়রাবাদী লিখিত ওই মুক্তিনামাসহ ১৮৬১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পোর্ট বে¬য়ারে পৌঁছেন। কিন্তু সময় অনেক দেরি হয়ে যায়। তিনি আন্দামানে পৌঁছার পর একটি জানাজা দেখতে পান। আন্দামানবাসীরা একটি জানাজার নামাজে মিলিত হচ্ছেন। জানাজায় শরিক হয়ে জানতে পারেন পিতা আর বেঁচে নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। এটাই তার পিতা বিশ্বখ্যাত জ্ঞান সাধক মাওলানা খায়রাবাদীর জানাজা।

অভিশপ্ত আন্দামান : বিদায়ের আগে মাওলানা খায়রাবাদী কাফনের কাপড় বলে এক টুকরা বস্ত্র ও কয়েকটি বিচ্ছিন্ন টুকরা কাগজে কয়লা দ্বারা লিখিত একটা পত্র দিয়েছিলেন এবং বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিলেন যেন এগুলো তার সুযোগ্য পুত্র মাওলানা আবদুল হক খায়রাবাদীর হাতে পৌঁছানো হয়। এই কাফনের কাপড় ও টুকরা কাগজের সমষ্টিই ‘আসাওরাতুল-হিন্দিয়া’ ও ‘কাসিদাতু ফিতনাতিল-হিন্দ’ নামক দুইটি পুস্তিকা। বৃদ্ধ মাওলানাকে আন্দামানের কঠোর বন্দি জীবনে যে নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে, ‘আসাওরাতুল-হিন্দিয়া’ পুস্তকের ছত্রে ছত্রে তার বেদনা অনুরণিত হয়েছে। অবশেষে এক হৃদয় বিদারক ঘটনার অবতারণার পর পিতার কাফনে লেখা ‘আস সাওরাতুল হিন্দিয়া’ কিতাবটি নিয়েই দেশে ফিরতে হয়েছিল তাকে। আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদীর শত শত কিতাবের মধ্যে এটিও একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী কিতাব যাতে ব্রিটিশ শাসনের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে।

আসাওরাতুল-হিন্দিয়া’ সম্পর্কে সিয়ারুল-উলামা’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে আযাদী সংগ্রামে মাওলানা ফযলে হক খায়রাবাদী প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করা ওয়াজিব বলে ফতোয়াও প্রচার করেন। এই অপরাধে তার বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের করা হয় এবং তাকে যাবজ্জীবন দণ্ডিত করে নির্বাসন জীবনযাপন করার নিমিত্ত ১৮৫৯ সালে ৮ অক্টোবরে আন্দামানে প্রেরণ করা হয়। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই অভিশপ্ত দ্বীপেই ইন্তেকাল করেন। সূত্র: (আযাদী আন্দোলন ১৮৫৭, উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট)

লেখক : শিক্ষার্থী, উচ্চতর ইসলামি আইন ও গবেষণা বিভাগ, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত