ঢাকা ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ন্যায়বিচারকের গুণাবলি

জুনাইদ ইসলাম মাহদি
ন্যায়বিচারকের গুণাবলি

ঝগড়া-ফ্যাসাদ, দ্বন্দ্ব-বিবাদ নিরসনে এবং আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে পক্ষপাতহীন ইনসাফপূর্ণ বিচারের বিকল্প নেই। বিচারে নিরপেক্ষতা না থাকলে সমাজ ও রাষ্ট্র অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে। ন্যায় ও নৈতিকতা, সামাজিক শান্তি ও আত্মিক বন্ধন অভাবিত শিথিল হয়ে পড়ে। ন্যায় বিচারের মাধ্যমে সমাজ ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষিত হয়। জালেমের জুলুমে ভাটা পড়ে। বঞ্চিতজন ফিরে পায় তার ন্যায়সঙ্গত অধিকার। তাই আদর্শ সমাজ ও শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র নির্মাণে ন্যায় বিচার বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে হলে বিচারালয়কে স্বাধীনভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হয় রাষ্ট্র থেকে শুরু করে সর্বমহলের সহযোগিতার মাধ্যমে। সাহাবি, তাবেয়ি ও তৎপরবর্তীকালের মুসলিম শাসকদের সোনালি ইতিহাসে ন্যায় বিচারের বিভিন্ন ঘটনা আজও মানুষের মুখে মুখে। কাজি শুরাইহ আল কিনদি তো জগদ্বিখ্যাত ইনসাফগার বিচারক ছিলেন। যিনি সঙ্গত কারণে মুসলিম সাম্রাজ্যের খলিফাদের বিপক্ষেও রায় ঘোষণা করতেন। ওমর (রা.)-এর ত্রুটিপূর্ণ ঘোড়া কেনার ঘটনায় এবং আলি (রা.) এর হারানো বর্ম এক জিম্মির কাছে পাওয়ার ঘটনায় কাজি প্রমাণের অভাবে বিচারিক রায় দিয়েছিলেন ঘোড়া বিক্রেতা ও জিম্মির পক্ষে। ওমর ও আলি (রা.) (নিজ নিজ আমলে) তখন খলিফা ছিলেন। কাজির বিচারিক রায়ে তারা কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করেননি। এখানেই ইসলামের অনন্য সৌন্দর্য। কোরআন, হাদিসে ধর্মণ্ডবর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হয়েছে। বিচারকার্য পরিচালনা করা একটি জটিল ও কঠিন কাজ। তাই বিচারকের মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকা আবশ্যক, যার দ্বারা তিনি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সক্ষম হবেন। একজন ন্যায় বিচারকের গুণ কী হবে? কোরআন-হাদিসের আলোকে এর কিছু বিবরণ দেয়া হলো।

কোরআন হাদিসের জ্ঞান থাকা : একজন বিচারকের জন্য কোরআন এবং হাদিসের জ্ঞান অর্জন করা অত্যাবশ্যক। একমাত্র আসমানি বিধানই পারে মানুষের মাঝে ইনসাফ কায়েম করতে। দুনিয়াবি কোনো মতাদর্শে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। নবীজি মুয়াজ (রা.) কে ইয়ামেনের শাসক ও বিচারক হিসাবে প্রেরণকালে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, হে মুয়াজ! কীসের আলোকে বিচারকার্য পরিচালনা করবে? উত্তরে তিনি বললেন, কোরআনের আলোকে। নবীজি বললেন, যদি কোরআনে না পাও? তিনি বললেন, রাসুলুল্লাহর সুন্নাতের আলোকে (আবু দাউদ : ৩৫৯২)।

ন্যায়পরায়ণ হওয়া : আল্লাহতায়ালা নিজে ন্যায়পরায়ণ এবং ন্যায়পরায়ণতাকে ভালোবাসেন। তিনি বান্দাকেও ন্যায়পরায়ণ হওয়ার শিক্ষা দেন। কোরআনে এসেছে- নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ন্যায়পরায়ণতার আদেশ করেন (সুরা নাহল : ৯০)। বিশেষত বিচারিককার্যে নিরপেক্ষ, ন্যায়পরায়ণ হওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সুরা নিসায় বিচারকদের সম্বোধন করে আল্লাহ বলেছেন- আর যখন তোমরা মানুষের মাঝে বিচারকার্য করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচারকার্য সম্পাদন করো (৫৮)। ইমাম শাফেয়ি বলেন, যার মধ্যে ন্যায়পরায়ণতা নেই, সে বিচারক হওয়ার যোগ্য নয়। এমতাবস্থায় সে যদি বিচারকার্য করে তাহলে তা কার্যকর হবে না (আদাবুল-কাজি : ১২৯)।

সুবোধসম্পন্ন হওয়া : একজন বিচারকের জন্য কোরআন, হাদিসের জ্ঞানের পাশাপাশি প্রজ্ঞাবান, দূরদর্শী এবং গবেষণা প্রয়াসী হওয়া জরুরি। কারণ, বিচারক সত্য ও সঠিক বিচারের জন্য আদিষ্ট। আল্লাহ বলেন, হে দাউদ আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি বানিয়েছি, অতএব তুমি মানুষের মাঝে ন্যায়সঙ্গতভাবে বিচার করো এবং খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না (সুরা সোয়াদ : ২৬)। ন্যায়সঙ্গত বিচার তখনি সম্ভব, যখন কোনো ব্যক্তি ঐশী জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রজ্ঞাবান হবেন। দূরদর্শী ও গবেষণা মনস্ক হবেন। কেননা, কোরআন হাদিসের নস-অধ্যাদেশ সীমাবদ্ধ কিন্তু নিত্যনতুন সংঘটিত ঘটনাবলি অনেক। তাই, সব ঘটনার হুকুম সরাসরি কোরআন এবং হাদিসে পাওয়া নাও যেতে পারে। তখন বিজ্ঞ বিচারকের দায়িত্ব হবে নিজ প্রজ্ঞার আলোকে কোরআন, সুন্নাহয় গবেষণা করে তার হুকুম বের করা।

স্বদলপ্রীতি না থাকা : পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপ্রীতি কিংবা স্বদলপ্রীতি একজন বিচারকের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পড়ে না। এসব গুণ মন্দ গুণ। বিচারিক কাজে প্রতিবন্ধক। বিচারিক কাজে পক্ষপ্রীতি ঘোরতর অপরাধ। ন্যায় ও কল্যাণের কাজে গোত্রপ্রীতি, পক্ষপাতিত্ব অন্যায় নয়। তবে অন্যায়-অত্যাচারে স্বদলীয় লোকদের সহযোগিতা করা নিষিদ্ধ সাম্প্রদায়িকতা। হাদিসের পরিভাষায় যাকে আসাবিয়্যাত বলা হয়। একজন বিচারককে অবশ্যই নিষিদ্ধ সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত হতে হবে। নবীজি বলেছেন- যে ব্যক্তি পক্ষপ্রীতি করে বা ডাকে এবং সেই অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, সে আমাদের (মুসলমানদের) দলভুক্ত নয় (আবু দাউদ : ৫১২১০। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, রাষ্ট্রীয় ও সমাজ ব্যবস্থায় যারা বিচারিক দায়িত্বে আছেন, তাদের অধিকাংশই দলীয়প্রীতি দোষে দোষী। আর একটি দেশ ও জাতি ধ্বংসের জন্য এটাই যথেষ্ট।

আল্লাহর ভয় থাকা : ইমাম মালিক (রহ.) বলেন, বিচারকের জন্য ইলম, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও আল্লাহভীতি অবশ্য প্রয়োজনীয়। বর্তমানে আমি কারো মধ্যেই সবগুলো দেখি না। তবে কারো মধ্যে যদি ইলম ও আল্লাহভীতি থাকে তবে তাকে বিচারক হিসাবে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। আব্দুল মালিক (রহ.) বলেন, বিচারকের জন্য তাকওয়া-আল্লাহভীতি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়, কারণ আল্লাহভীতির মাধ্যমেই সে যাবতীয় অন্যায় বিচারাচার থেকে বিরত থাকবে (আকজিয়াতুর-রাসুল)। অন্যায় বিচার মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া। অন্যায় করতে সাহায্য করা। অন্যায়ে সাহায্যকারীর পরিণাম বড়ই ভয়াবহ। আল্লাহ বলেন, গোনাহ এবং অবাধ্যতায় (অন্যায় বিচারে) তোমরা পরস্পরকে সাহায্য করো না। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চই আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী (সুরা মায়েদা : ২)। যার অন্তর সদা আল্লাহর ভয়ে জাগরুক থাকে সে কখনো অন্যায় বিচার করতে পারে না।

উপঢৌকন গ্রহণে বিরত থাকা : হাদিয়া-উপঢৌকন দেয়া-নেয়া বৈধ। অনেক ক্ষেত্রে সুন্নাতও বটে। তবে সরকারি কর্মচারী বিশেষত বিচারক এবং বিচার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উপঢৌকন গ্রহণ করা উচিত নয়। এতে বিচারকার্যে ন্যায্যতা বিঘ্নিত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে। সাহাবি আবু সাঈদ খুদরি (রা.) নবীজি থেকে বর্ণনা করেন, আমিরদের (শাসক, প্রশাসক, বিচারক) উপঢৌকন ধোকা মিশ্রিত অতিরঞ্জন (আল মুসনাদ : ৭০৭৩)। নবীজি ইবনে রাওয়াহাকে (শাসক হিসাবে) খায়বারে প্রেরণ করলে, খায়বারবাসী তার কাছে উপঢৌকন পেশ করেন। তিনি তা ফেরত দেন এবং বলেন, এগুলো অবৈধ-হারাম (আদাবুল কাজী) ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রা.) কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আপনি হাদিয়া গ্রহণ করেন না কেন, অথচ নবীজি হাদিয়া গ্রহণ করতেন? উত্তরে তিনি বলেন, নবী যুগে যেগুলো হাদিয়া-উপঢৌকন ছিল বর্তমান সমাজে সেগুলো ঘুষ (আদাবুল কাজী ২ : ৪০)। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে একজন বিচারকের জন্য উপঢৌকন গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা জরুরি।

পরামর্শের মানসিকতা সম্পন্ন হওয়া : পরামর্শ সাপেক্ষে কাজ করা রবের আদেশ। আল্লাহ নবীজিকে সম্বোধন করে বলেছেন, এবং কাজ-কর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করুণ (সুরা আলে-ইমরান : ১৫৯)। বিচারকার্য যেহেতু জটিলবিষয়, সেহেতু জটিল মামলা-মকাদ্দমায় সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পরামর্শ করা দরকার। ইমাম আহমাদ (রহ.) বলেন, যে মকদ্দামার রায় সম্পর্কে কোরআন-হাদিসের স্পষ্ট অধ্যাদেশ আছে, সে বিষয়ে পরামর্শ করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যে বিষয়ে স্পষ্ট অধ্যাদেশ নেই সেই বিষয়ে পরামর্শ করা চাই (আদাবুল কাজী : ৩৭০)।

প্রচলিত আইনের ক্ষেত্রেও ধারায় সবকিছু সুস্পষ্টভাবে বলা থাকে না। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই আইনজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। ধর্মীয় বিষয়ে কোনো রায় ঘোষণা করার আগে ধর্মীয় বিষয়ে স্পষ্ট জ্ঞান লাভ করা জরুরি। প্রয়োজনে বিজ্ঞ মুফতিদের সঙ্গে বৈঠক করে প্রয়োজনীয় জ্ঞান লাভ করা যেতে পারে। অজ্ঞতাবশত ধর্মের বিপক্ষে কিংবা ইনসাফপরিপন্থি বিচারিক রায় ঘোষণা করা হলে এজন্য বিচারক পরকালে শাস্তির সম্মুখীন হবে বলে হাদিসে বিশদ বিবরণ এসেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত