মহানবীর ধর্মে যৌতুক হারাম
আবদুল কাইয়ুম শেখ
প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বিবাহ করার সময় কিংবা এর আগে বা পরে জোরপূর্বকভাবে বরপক্ষ কনেপক্ষের কাছ থেকে যে অর্থ, স্বর্ণালংকার, জিনিসপত্র বা ফার্নিচার আদায় করে তাই যৌতুক। বরপক্ষ কর্তৃক কনেপক্ষের কাছে যৌতুক দাবি করা নিতান্ত অভদ্রতা, অসভ্যতা ও অমানবিক কাজ। যৌতুক দাবি করার কারণে কন্যাদায়গ্রস্ত বহু পিতা ও পরিবার অসহায়ত্বের শিকার হয়। গরিব ও দরিদ্র লোকদের বিবাহযোগ্য কন্যাদের বিবাহ এ কারণে বিলম্বিত হয়। অনেক সময় অভাবী পিতা যৌতুকের দাবি মেটানোর জন্য অন্যের কাছে হাত পাততে ও ভিক্ষাবৃত্তি করতে বাধ্য হয়। বহু নিরীহ স্ত্রী যৌতুক দিতে না পারার কারণে জোর-জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন ও মারধরের সম্মুখীন হয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। কারো উপর জোর-জুলুম করা বৈধ নয়। ঠিক তেমনিভাবে অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ হরণ করাও অবৈধ ও নাজায়েজ। যৌতুক গ্রহণ করার ক্ষেত্রে যেহেতু বরপক্ষ কন্যাপক্ষের উপর জোর-জুলুম করার মাধ্যমে তাদের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করে তাই এটা শরিয়ত পরিপন্থি ও হারাম। অন্যায্যভাবে অন্যের সম্পদ উপভোগ করতে নিষেধ করে মহাগ্রন্থ আল কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ করো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ৮৮) অন্যত্র আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ২৯)।
বিবাহ করার আগে বরপক্ষ কন্যাপক্ষের সহায়-সম্পত্তি, বংশ-ঐতিহ্য, রূপ-মাধুর্য ও ধার্মিকতার বিষয়টি যাচাই করা স্বাভাবিক। কিন্তু আজ-কাল সবকিছু ছাড়িয়ে বরপক্ষীয় বহু পরিবার শুধু কনেপক্ষের অর্থ-সম্পদের আধিক্য দেখে বিবাহ করা বা করার প্রতি উৎসাহিত হয়। কনেপক্ষের কাছ থেকে মোটা অংকের যৌতুক পাওয়ার নিশ্চয়তা পেলেই শুধু বিবাহে সম্মত হয়; অন্যথায় পিছিয়ে যায়। মেয়ের পরিবারের কাছ থেকে মোটা অংকের যৌতুক গ্রহণ করার বিষয়টি বাহ্যিকভাবে উপকারী মনে হলেও বরপক্ষের জন্য পরিণামে তা ক্ষতিকর। মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী সহায়-সম্পত্তির মোহে পড়ে বিবাহ করলে বর ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পক্ষান্তরে ধার্মিকতার প্রাবল্য দেখে বিবাহ করলে সফল হবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সাধারণত চারটি কারণে নারীদের বিয়ে করা হয়। তার সম্পদ, তার বংশমর্যাদা, তার সৌন্দর্য ও তার দ্বীনদারি। সুতরাং তুমি দ্বীনদার নারীকে বিবাহ করে সফল হও; নতুবা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫০৯০)।
যৌতুক দেওয়া-নেওয়া হিন্দুয়ানি প্রথা ও সংস্কৃতি। হিন্দু ধর্মে নারীদের জন্য উত্তরাধিকার-স্বত্ব স্বীকৃত নয় বলে বিবাহের সময় মেয়ে যা পায় তাই তার অর্জিত পৈতৃক সম্পত্তি। এ কারণে কনেপক্ষের কাছ থেকে যৌতুক গ্রহণ করার বিষয়টি হিন্দুদের মধ্যে স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য। পক্ষান্তরে ইসলাম ধর্মে নারীদের উত্তরাধিকার-স্বত্ব স্বীকৃত। পিতার সম্পত্তি হতে নারীরাও তাদের নির্ধারিত অংশ পায়।
এজন্য যৌতুক নেওয়ার বিষয়টি ইসলামে সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ। মুসলমানরা যদি যৌতুক গ্রহণ করে, তাহলে তা হবে হিন্দুদের সংস্কৃতির অনুসরণ ও বিজাতীয় সভ্যতার অনুকরণ। আর ইসলাম ধর্মে বিজাতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির অনুসরণ ও অনুকরণ নাজায়েজ ও হারাম। বিজাতীয় সভ্যতার অনুসরণ করতে হাদিস শরিফে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। হজরত ইবনু উমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪০৩১)
যৌতুক আদায় করার জন্য বরপক্ষ কন্যাপক্ষকে নির্মমভাবে বাধ্য করে। যৌতুক প্রদান না করলে বিবাহ করা বা করানো থেকে বিরত থাকে কিংবা স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে। আর বেআইনিভাবে কাউকে কোনো কিছু প্রদান করতে বাধ্য করা বা কারো সহায়-সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়া জুলুম ও হারাম। মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘জুলুম কেয়ামতের দিন অনেক অন্ধকারের রূপ পরিগ্রহ করবে।’ (সহিহ বোখারি, হাদিস : ২৪৪৭) অবশ্য কনের পরিবার যদি মেয়ের প্রতি স্নেহের বশীভূত হয়ে তার বিয়েতে স্বেচ্ছায় কিছু উপহার প্রদান করে, তাহলে তা হালাল হবে ও কনে সেগুলোর মালিক হবে। কেননা, সন্তুষ্টচিত্তে প্রদানকৃত উপহার গ্রহণ করা হালাল। হজরত আবু হুররা রাকাশি (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোনো মুসলমানের সম্পদ তার ভাইয়ের জন্য হালাল নয়, তবে স্বেচ্ছায় সে যা তাকে দান করে তার বিষয়টি ভিন্ন।’ (সুনানে কুবরা বাইহাকি, হাদিস : ১৬৭৫৬) তা ছাড়া হজরত ফাতেমা (রা.)-এর বিবাহের সময় মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ব্যবহার করার জন্য বেশকিছু আসবাব উপহার দিয়েছিলেন। এ হিসেবে কনের পিতা বা পরিবার যদি বিয়েতে তার মেয়েকে কিছু উপহার-উপঢৌকন প্রদান করে, তাহলে সেগুলো গ্রহণ করতে শরয়ি দৃষ্টিকোণে কোনো বাধা নেই। হজরত আলি (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতিমা (রা.)-কে একখানা চাদর, একটা পানির পাত্র ও একটা বালিশ উপহার দিয়েছিলেন যার ভেতরে ছিল ইযখির নামক তৃণ।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৩৩৮৪)। কাজেই কনেপক্ষের স্বেচ্ছায় দেওয়া উপহার আর শর্তসাপেক্ষে বা কৌশলে উপহারের নামে কনেপক্ষ থেকে বরপক্ষের গ্রহণ করা সামগ্রী এক নয়। এ পার্থক্য বজায় রাখতে হবে। যৌতুক হারাম ও বর্জনীয়।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা-১২১১।