চেতনার জয়

আবদুল্লাহ আশরাফ

প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

‘রবিন ভাইয়া, দেখো না, বাবার কবরে ফুল ফুটেছে! কী সুন্দর তাই না!’

মুসার কথা শুনে রবিন কবরের দিকে ফিরে তাকাল। সারি সারি কবর। সব কবরেই নতুন ঘাস গজাচ্ছে। কোনোটিতে ফুলও ফুটেছে। ঘাসফুল। বনফুল। দেখতে সুন্দর। তবে রবিনের বাবার কবরে ঘাসফুলের সঙ্গে গাঁদাফুলও ফুটেছে। গাছটা পাহাড়ি পথ থেকে কুড়িয়ে এনেছিল রবিন। অনেক দিন পর তাতে ফুল এলো। রবিনের ভালো লাগার কথা। কিন্তু হঠাৎ করে বাবার কথা মনে পড়ে গেল তার। সাদা কাপড়ে আচ্ছাদিত হয়ে শুয়ে আছেন বাবা। সবাই কাঁদছে। কী কান্না! সে কান্নার যেন শেষ নেই। মুসা তখন খুব ছোট। এখনো যেন সবকিছু চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সবাই মিলে বাবাকে শুইয়ে দিল কবরে। অন্যান্য শহিদের কবরের পাশে।

রবিন প্রতিদিন বাবার কবরের পাশে দাঁড়ায়। দোয়া করে। অন্য শহিদদের জন্যও দোয়া করে। সেই থেকে মুসা জেনে যায় এটা তার বাবার কবর। কোনো কোনো দিন মুসা একা এসে দাঁড়ায় বাবার কবরের পাশে। বাবা বাবা বলে ডাকে। বাবার উত্তর না পেয়ে শিবিরে চলে যায়। মায়ের কাছে গিয়ে বলে- ‘বাবা আমার কথা শোনে না! ওঠে না। আমাকে কোলে নেয় না, মা! চলো। তুমি ডাকলে বাবা শুনবেন।’ প্রতিদিনের এই আবদার মা বিভিন্নভাবে পাশ কাটিয়ে চলেন। সান্ত¡না দেন।

মুসা এখন বুঝতে শিখেছে। সে জানে তার বাবা আর উঠবে না। ঘুমিয়ে আছে। জাগবে না। তবু বাবার কবর দেখে সান্ত¡না খোঁজে। কখনো একাকী বাবার সঙ্গে কথা বলে। কী কথা হয় তাদের সঙ্গে মুসা ছাড়া জানে না কেউ। তার সে কথাবার্তা কেউ জানতেও তেমন আগ্রহী হয় না। কে কার খবর নেবে। সবার বুকেই তো জ্বলছে অভিন্ন আগুন।

শহিদদের কবরস্থানের পাশেই রবিনদের শিবির। জায়গাটা তুলনামূলক উঁচু। এখানে রবিন, হাসান, ফারুকরা বসে বসে আড্ডা দেয়। সেনাবাহিনীর গতিবিধির প্রতি লক্ষ্য রাখে। কখনো সেনাদের দেখতে পেলে শিস দেয়। হাতের ইশারা বা অঙ্গভঙ্গি দিয়ে বুঝায় যে ‘সৈন্যরা আসছে। সবাই সতর্ক হও।’

এভাবে কতদিন রবিনরা শিবিরের পাহারাদারি করেছে! সারাদিন পড়ে থেকেছে পাহাড়ের চূড়ায়। গুটি গুটি পায়ে চলে যাওয়া। সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা। পাখি যেমন সকাল হতেই চলে যায় জীবিকার সন্ধানে, তেমনি সবার জীবনের প্রহরী হয়ে তারা চলে আসে পাহাড়ে। এ কাজ করতে গিয়ে কখনো কখনো বিপদেও পড়তে হয়েছে তাদের। কখনো ইসরাইলিদের হাতে ধরা পড়ে মার দেখতে হয়েছে। যারা পালিয়ে আসতে পারে তারা বেঁচে যায়। জীবনযুদ্ধে রবিনরা কখনো পিছে তাকায়নি। প্রতিনিয়ত নতুন শঙ্কা মাথায় নিয়ে ছুটে যায় পাহাড়ে। লুকিয়ে লুকিয়ে। সতর্কতার সঙ্গে। কখনো গাছের আড়ালে, ঘাসের ভিড়ে-ঘাপটি মেরে কাটায় সারাদিন। গভীর রাত। আকাশে চাঁদ নেই। নিকষ অন্ধকার। বিস্ফোরণের শব্দ শুনে নাসেরিয়া শিবিরের সবার ঘুম ভেঙে গেল। সবাই জানালা খুলল। বুঝতে চেষ্টা করল- কোথা থেকে আসছে এ শব্দ...?

বেশিক্ষণ তাদের অপেক্ষা করতে হলো না। তারা বুঝতে পারল- শব্দ আসছে ‘বারিজ’ থেকে। অবরুদ্ধ ‘বারিজ’। মুসলমানরা সেখানে কাটাচ্ছে অবরুদ্ধ জীবন। সে জীবন থেকে তাদের মুক্তিও মিলছে না। ফিরে আসতে পারছে না নিরাপদ জীবনেও। জীবন আর মৃত্যুর মাঝে ঝুলে আছে তাদের জীবন।

মাঝেমধ্যে মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে হাজির হয় শত শত বুলেট। চোখের সামনে থেকে ভাইবোন হারিয়ে যায়। ছটফট করে নিষ্প্রভ চোখে বিদায় নেয়। হাসপাতালে নেওয়ারও সুযোগ হয় না। ক্রমেই শোকগুলো বাষ্প হয়ে উড়ে যায় আকাশে। ছড়িয়ে যায় বাতাসে বাতাসে।

স্থির থাকার কোনো মওকাও থাকে না। ঘরগুলো জিন্দানখানা মনে হয়। মনে পড়ে অম্লান-মধুর কথা ‘মুসলমান ভাই ভাই। একে অপরের সুখে-দুঃখে পাশে থাকা ইমানি দায়িত্ব।’

পুরুষশূন্য এই শিবিরের মহিলারাও তো মুসলমান। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা কি তারা ভুলে থাকতে পারে? পারে না। একজন দুজন করে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। ধীরে ধীরে জমা হতে থাকে মানুষ। পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় নাসেরিয়ার মহিলারা অবরুদ্ধ বারিজের দিকে। ছোট-বড?। শিশু-কিশোর। একসময় নিরস্ত্র মানুষগুলো জড়ো হয় বারিজের সামনে। হাজার হাজার মানুষ, যেন সমুদ্র। এত মানুষের ভিড়ে এক সাহসী কণ্ঠে উচ্চারিত হয়- ‘ওরা কত মারবে? আমাদের ১০০ জনকে মেরে ফেলার আগে ওদের আচ্ছাদিত করে ফেলব’। এই একটি উচ্চারিত বাক্যে সাহস যেন সুবাসিত গন্ধ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। ফুসফুস ফুলে ওঠে সাহসে। আবেগে মুষ্টিবদ্ধ হাত যেন হাতুড়ির মতো শক্ত হয়ে যায়। ভিড়ের ভেতর কোরাস শোনা যায়- নারায়ে তাকবির! আল্লাহু আকবার!

তাকবির ধ্বনিতে সৈন্যদের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। স্তম্ভিত হয়ে পড়ে তারা। ভয় তাড়াতে অকস্মাৎ গুলি ছুড?তে থাকে এলোপাথাড়ি। কিন্তু জমানার খাওলারা সামান্য নড়ে না। ভয়ে কাঁপে না। নির্ভীক ভঙ্গিতে এগিয়ে চলে সম্মুখপানে। তাদের নির্ভিকতা দেখে ব্যারিকেড ছেড়ে সরে যেতে বাধ্য হয় সৈন্যরা। ভেঙে যায় অবরোধ। জয় হয় চেতনার।

ভিড় ঠেলে ঠেলে হাঁটছিল রবিন। রবিন বিস্ময়-তাড়িত চোখে চারপাশের মানুষদের দেখে মুষ্টিবদ্ধ মানুষ। চোখে-মুখে উচ্ছ্বাস। মুখে উচ্চকিত তাকবিরধ্বনি। রবিন দেখে- জালিমের বুলেট উপেক্ষা করে ছুটে চলছে মিছিল। এক সময় অবরোধ ভেঙে বেরিয়ে আসে মুসলমানরা। আনন্দে তাকবির বলে ওঠে সবাই। আনন্দে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে সবার গাল বেয়ে। সবার চোখে আনন্দের ঝিলিক দেখতে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে রবিন। অবরুদ্ধ বারিজ-মুক্ত। ইহুদি সৈন্যরা ক্রোধে জ্বলছে। এ পরাজয় অকল্পনীয়। মেনে নেওয়া যায় না। যে করে হোক একটা শাস্তি ওদের পেতেই হবে। ওদের সাহসের আস্থা যদি উপড়ে না ফেলা হয়, তা হলে আবার তারা জেগে উঠবে। খাবলে খাবে। এ মাটিতে আমরা থাকতে পারব না। প্রধানের রক্তচক্ষু আর দেখতে চাই না। এমন প্রতিশ্রুতি সবার। ঘুমন্ত নাসেরিয়া শিবির। নিস্তব্ধ দিগন্ত ছোঁয়া সারি সারি তাঁবু। এমন সময় এক করুণ সুর বেজে ওঠে। সেই সুর ঝংকৃত হতেই আক্রান্ত হয়ে পড়ে নাসেরিয়া শিবির। একটি-দুটি করে প্রদীপ জ্বলে ওঠে। দেখতে দেখতে দিগন্ত-ছোঁয়া প্রদীপ আর প্রদীপ। মিটিমিটি আলো। পটপট করে খুলে যায় ঘরের দুয়ারগুলো। পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়। আলোয় ভরা মিছিল। ছুটছে আক্রান্ত শিবিরের দিকে। গত দিনের সাহসী ভূমিকার ফল এটা। সবাই তবু এগিয়ে চলে। মশাল হাতে। স্রোতের তোড়ে ভেসে যেতে থাকে সব অপশক্তি। কেউ তাদের রুখতে পারে না। থামাতে পারে না। তারা চলছে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ে ঢেউয়ে। গর্জনে গর্জনে কেঁপে উঠছে আকাশ-বাতাস। সব পরিবেশ। সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে ওঠে সব অপশক্তি।

ঘটনাটি ১৯৮৯ সালের। আলোর মশাল হাতে সেই প্রতিরোধ মিছিল আজ থেমে নেই। সময়ের স্রোতে যদিও পালটে গেছে পৃথিবীর রূপ। বয়ে গেছে বহতা নদীর বুকে কত জল! তবু সাহস হারিয়ে যায়নি। হারিয়ে যায়নি চেতনা। এসব যে হারাবার নয়!

লেখক : সম্পাদক, শব্দবুনন