নারীর শিক্ষা বিস্তারে হজরত আয়েশা (রা.)
শাহাদাত হোসাইন
প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নবীজির নারী মুক্তি সংগ্রামের সফল নারী। উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.)। উপনাম উম্মু আব্দুল্লাহ। উপাধি সিদ্দিকা। পিতা আবু বকর সিদ্দিক। মাতা উম্মে রুমান। নবীজির নবুওয়াত প্রাপ্তির ৫০ বছর মোতাবেক ৬১৪ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে জন্মগ্রহণ করেন। (সিরাতে আয়েশা : ৪০)। নারী শিক্ষা বিস্তারে হজরত আয়েশা (রা.)-এর জীবন ও কর্ম চির-অম্লান। তিনি নারী শিক্ষাকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছিয়েছেন।
হজরত আয়েশা (রা.)-এর শিক্ষা : হজরত আয়েশা (রা.) সেই সব সৌভাগ্যবান শিশুদের অন্যতম জন্মের পর শিরকের আওয়াজ যাদের কানে পৌঁছেনি। পিতামাতা উভয়কে মুসলিম হিসাবে পাওয়ার সুবাদে জন্ম থেকেই তিনি ইসলামিক শিক্ষা-দীক্ষায় লালিতপালিত হয়েছেন। পিতা আবু বকর (রা.) বিভিন্ন বিদ্যায় পারদর্শিতার পাশাপাশী কাব্যশাস্ত্রেরও জ্ঞানী ছিলেন। হজরত আয়েশা (রা.) পিতার থেকেই বিদ্যায় পারজ্ঞমতা অর্জন করেন। ৯ বছর বয়সে নবীজির ঘরে এলে, সরাসরি নবীজির শিক্ষা তাকে অন্যন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। ইসলামিক হুকুম আহকামসহ ইতিহাস ঐতিহ্যের সব শিক্ষা নবীজি থেকে লাভ করেন (আসহাবে রাসুলের জীবন কথা ৫ : ৬৭)।
হজরত আয়েশা (রা.)-এর জ্ঞানের স্বীকৃতি : হজরত আয়েশা (রা.)-এর জ্ঞান সম্পর্কে সব সাহাবি ও মনীষীর স্ববাক স্বীকৃতি ছিল। সাহাবি আবু মুসা আশয়ারি (রা.) বলেন, নবীজির সাহাবিরা যখন কোনো হুকুমের ব্যাপারে সন্দেহে পড়তেন। তখন তারা আয়েশা (রা.)-এর দ্বারস্থ হতেন এবং তার কাছে সেই বিষয়ের জ্ঞান পেতেন (তিরমিজি : ৩৮৮৩)। প্রখ্যাত তাবেয়ি হাদিস বিশারদ ইবনে শিহাব জুহরি (রহ.) বলেন, আয়েশা (রা.) সর্বাধিক জ্ঞানী ছিলেন। নবীজির বড় বড় সাহাবিরা তাকে দ্বীনি বিষয় জিজ্ঞাসা করতেন (তাবাকাতুল-কুবরা ২ : ৩৭৪)। অন্যত্র তিনি বলেন, যদি সব মানুষের জ্ঞান একত্রিত করা হত অতঃপর নবীজির অন্য সব স্ত্রীদের জ্ঞান একত্রিত করা হত। তাহলেও আয়েশার জ্ঞান বেশি হত (সিয়ারু-আলামিন-নুবালা ২ : ১৯৯)। আতা ইবনে আবি রবাহ বলেন, হজরত আয়েশা (রা.) সর্বাধিক বুঝমান এবং জ্ঞানী ছিলেন। উত্তম ছিলেন মতামত প্রদানে (আল-মুসতাদরাক : ৬৭৩৩)।
খেলাফতের নারী মুফতি : হজরত আয়েশা নারী শিক্ষার অগ্রজ ছিলেন। শিক্ষা অর্জনে তিনি শীর্ষ চূড়ায় আরোহণ করেছিলেন। নবীজি তার শিক্ষার স্বীকৃতি দিয়ে বলেছেন, পুরুষের মধ্যে অনেকেই পূর্ণতা পেয়েছেন। তবে নারীদের মধ্যে শুধু মারইয়াম ও আসিয়া। আর সব নারীর ওপর আয়েশার শ্রেষ্ঠত্ব তেমন, যেমন সারিদের (এক-প্রকার সুস্বাদু খাবার) শ্রেষ্ঠত্ব অন্য সব খাবারের ওপর (বোখারি : ২৪৩৩)। ইসলাম নারীদের জন্য শিক্ষার্জনের বন্ধুর পথকে উন্মোচিত করেছে। আয়েশা ছিলেন সে পথের মশালবাহী অগ্রজ নারী। যিনি পরবর্তী সময় সব নারীর জন্য এ পথকে আলোকিত করেছেন। নবীজির ইন্তেকালের পর আবু বকর ও ওমর (রা.)-এর খেলাফতকালীন তারা বিধান সংক্রান্ত কোনো জটিলতায় পড়লে, আয়েশা (রা.) কে সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন। তিনি সে সম্পর্কে নবীজির কর্ম বলে দিতেন এবং সে অনুযায়ী ফায়সালা দেয়া হত।
সর্বোচ্চ হাদিস বর্ণনাকারী : ইসলামিক জ্ঞানের দ্বিতীয় উৎস প্রিয়নবীর হাদিস। যে সব সাহাবি নবী (সা.) থেকে সর্বাধিক হাদিস বর্ণনা করেছেন, হজরত আয়েশা (রা.) তাদের অন্যতম। নবীজি থেকে তার বর্ণিত হাদিস সংখ্যা ২২১০টি (আসহাবে রাসুলের জীবন কথা ৫ : ৬৭)। তিনি শিক্ষায় কতটা অগ্রগামী ছিলেন তা অনুমান করা যায় তার বর্ণিত এই সব হাদিস থেকে। তিনি নারী শিক্ষার উজ্জ্বল উপমা ছিলেন। তিনি নবীজি থেকে শিক্ষালাভ করেন এবং নবীজির বাণী আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত হলেও তা অন্যের কাছে পৌঁছে দেও (বোখারি : ৩৪৬১)। অনুযায়ী সেগুলো অন্যান্য নারী সাহাবিদের মধ্য প্রচার করতেন। এভাবে তিনি নারীদের শিক্ষিত করেছেন।
শিক্ষার প্রতি তীব্র বাসনা : হজরত আয়েশা (রা.) শিক্ষার জন্য অধিক প্রশ্ন করতেন। যতক্ষণ মন তৃপ্ত হত না, ততক্ষণ প্রশ্ন করেই যেতেন। একবার তিনি নবীজিকে বলতে শুনলেন, যার হিসাব নেয়া হবে তাকে আজাব দেওয়া হবে। তখন আয়েশা (রা.) নবীজিকে জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহ কি বলেননি, তার হিসাব সহজে নেওয়া হবে (ইনশিকাক : ৮) (প্রশ্নের উদ্দেশ্য ছিল, হিসাব তো সবারই নেওয়া হবে। তাহলে কি সবাইকে আজাব দেওয়া হবে?) নবীজি বললেন, তা হলো হিসাব প্রকাশ করা। কিন্তু যার হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খ নেওয়া হবে সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে (বোখারি : ১০৩)। এমনিভাবে যখন তিনি নবীজিকে বলতে শুনেছিলেন, কেয়ামতের দিন মানুষকে বস্ত্রহীন অবস্থায় উত্থিত করা হবে। তখন তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, নারী-পুরুষরা কি পরস্পরের দিকে তাকাবে না? নবীজি বললেন, কেয়ামতের বিষয় এমন কঠিন হবে যে, মানুষ তা ভাবার ও সুযোগ পাবে না (মুসলিম : ২৮৫৯)। এমন গোছাল জিজ্ঞাসা তার জ্ঞানের জগৎকে সুশোভিত করেছে। নারীদের জন্য শিক্ষার পথকে অবারিত করেছে।
নবীজির প্রিয় স্ত্রী হওয়ার কারণ : হজরত আয়েশা (রা.) নবীজির সর্বাধিক প্রিয় স্ত্রী ছিলেন। যা সব সাহাবারা জানত। নবীজির অন্যান্য স্ত্রীরা এ ব্যাপারে নবীজির কাছে অনুযোগও করেছিলেন। তার প্রতি নবীজির এই ভালোবাসা নিছক সৌন্দর্যের কারণে ছিল না। বরং এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, তার জ্ঞান। অন্যের তুলনায় তার দ্বারা দ্বীনের খেদমত এবং প্রচার-প্রসার অধিক হওয়া। কোরআনের তাফসির, হাদিস, ফেকাহ, ইজতেহাদ, মাসয়ালা বের করণ, নব-উদ্ভুত বিষয়ের হুকুম বের করা করায় তার জুড়ি ছিল না। জ্ঞান-বিজ্ঞানে তার সমপর্যায়ের কেউ ছিলেন না। তার এই সব গুণের কারণেই নবীজি তাকে অধিক ভালোবাসতেন (সিরাতে আয়েশা : ৮০)।
নারী অধিকারের জন্য লড়াই : হজরত আয়েশা (রা.) নারীদের সম্মান ও অধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার ছিলেন। যখনই কোথাও নারীদের সম্মানহানীর মতো কথা এসেছে, সেখানেই তিনি সোচ্চার হয়েছেন। প্রতিবাদ করেছেন। একবার কেউ বলছিলেন, কুকুর, গাধা ও মহিলা সামনে দিয়ে গেলে নামাজ ভঙ্গ হবে কি না? এমন প্রশ্নে হতবিহ্বল হয়ে তিনি বলেছিলেন, নারীরা কি নাপাক প্রাণী? তোমরা আমাদেরকে কুকুর গাধার সঙ্গে তুলনা করছ? এটা কতই না নিকৃষ্ট ব্যাপার! অথচ, আমি নবীজিকে দেখেছি। তিনি নামাজ পড়ছেন, আর আমি তার সামনে জানাজা রাখার মতো শুয়ে আছি। যখন তিনি সেজদাহ করতে চাইতেন, তখন আমাকে পা দ্বারা খোঁচা দিতেন (আবু দাউদ : ৭১২)।
দ্বীন শিক্ষায় নারীদের সহায়ক : ইসলামিক শিক্ষা অর্জনের জন্য নারীরা নবীজির কাছে আসত। কিছু কিছু বিষয় সূক্ষ্ম ও তীক্ষè থাকত। যা সাধারণ নারীরা ব্যাখ্যা করতে পারত না। অনেক ক্ষেত্রে লজ্জার কারণেও তারা বলতে পারত না। তখন আয়েশা (রা.) সেই সব বিষয় বুঝতে ও বুঝাতে তাদের সাহায্য করতেন। আরবরা অহংকার প্রদর্শনের জন্য কাপড় ঝুলিয়ে পরিধান করা পছন্দ করত।
নবীজি তা নিষেধ করে বললেন, যে ব্যক্তি অহংকার বসত কাপড় ঝুলিয়ে পড়বে। কেয়ামতের দিন আল্লাহ তার দিকে তাকাবেন না (বোখারি : ৩৬৬৫)। তখন আয়েশা নবীজিকে বললেন, নারীরা তাদের ঝুল কি করবে? তাদের পা তো বের হয়ে যাবে? তখন নবীজি বললেন, তারা এক-হাত পর্যন্ত ঝুলিয়ে পড়তে পারবে (তিরমিজি : ১৭৩১)।
লেখক : শিক্ষা পরিচালক, ভরসা মাদ্রাসা রংপুর।