ফেরাউন পৃথিবীর অন্যতম অত্যাচারী শাসক। ফেরাউন তৎকালীন মিসরের শাসকদের পদবি। মুসা (আ.)-এর যুগের ফেরাউনের প্রকৃত নাম-দ্বিতীয় রামসিস বা মিনফাতাহ। যিনি অত্যাচার, অহংকার, পাপাচার ও অনাচারে দুনিয়ার অন্যসব জালেমকে পেছনে ফেলেছিলেন। শুধু তাই নয়, ক্ষমতার দাম্ভিকতায় নিজেকে খোদা বলেও দাবি করেছিলেন। আল্লাহ ছাড় দেন, ছেড়ে দেন না। যুগ-যুগান্তরে স্মরণীয় থাকবে ফেরাউনের ধ্বংস কথা। পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন সুরায় তার ধ্বংসের বিবরণ এসেছে-
ফেরাউনের দরবারে মুসা (আ.) : আল্লাহ প্রত্যেকটি মানুষকে শোধরানোর সুযোগ দেন। ফেরাউনকে সেই সুযোগ দিয়েছিলেন মুসার মাধ্যমে। আল্লাহ স্বীয় একত্ববাদের দাওয়াতসহ মুসাকে পাঠিয়ে বললেন, ফেরাউনের কাছে যাও, নিশ্চয়ই সে সীমালংঘন করেছে (সুরা ত্ব-হা : ২৪)। মুসা (আ.) ফেরাউনকে বোঝানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন। কিন্তু ফেরাউন নিজেকেই বড় রব হিসাবে দাবি করলেন। রাষ্ট্রের আমলাদের ডেকে বললেন, হে পরিষদবর্গ! আমি ব্যতীত তোমাদের কোনো ইলাহ আছে বলে আমার জানা নেই (সুরা কাসাস : ৩৮)। জনসাধারণকে জমায়েত করে ঘোষণা দিলেন, আমিই তোমাদের শ্রেষ্ঠ প্রতিপালক (সুরা নাযিয়াত : ২৩, ২৪)। প্রজ্ঞাপন জারি করলেন, যারা তাকে রব মানবে না, তাদের ছেলেদের হত্যা করতে আর মেয়েদের জীবিত রাখতে। সুরা মুমিন এ এসেছে, যারা তার সঙ্গী হয়ে বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তাদের পুত্রদের হত্যা করো আর নারীদের জীবিত রাখ (২৫)। এসব কর্মকাণ্ডে সে নিজের ধ্বংসকেই ত্বরান্বিত করেছিল।
বনী ইসরাইলকে হত্যার হীন উদ্দেশ্য : ফেরাউনের আজাব থেকে রক্ষার্থে আল্লাহ মুসাকে বনী ইসরাইলসহ মিসর ত্যাগের আদেশ দেন। সুরা শু’আরার বর্ণনা- আমি মুসার কাছে অহি অবতীর্ণ করলাম যে, আমার বান্দাদের নিয়ে রাতের বের হয় পড় (৫২)। মুসা (আ.) ছয় লাখ লোক নিয়ে বের হলে, তাদের শায়েস্তার জন্য ফেরাউন ১৬ লাখের বিশাল বাহিনী নিয়ে পিছু ধাওয়া করেন। মুসা (আ.) তার জাতিকে নিয়ে লোহিত সাগরের কিনারে পৌঁছলে, ফেরাউনও তার দলবলসহ সেখানে পৌঁছেন। বনী ইসরাইলের ডানে-বায়ে পাহাড়, সামনে লোহিত সাগর আর পেছনে ভয়ংকর ফেরাউন বাহিনী। হতবিহ্বল বনী ইসরাইল, মুসাকে বলতে থাকেন আমরা তো ধরা পড়ে গেলাম। মুসা বললেন, কখনোই নয়! আমার সঙ্গে আমার রব আছেন, তিনি আমাকে পথ দেখাবেন (সুরা শু’আরা : ৬২)।
সাগরে রাস্তার সৃষ্টি : রাখে আল্লাহ মারে কে? স্বয়ং আল্লাহ বনী ইসরাইলকে হেফাজতের ইচ্ছা করলেন। তাঁর হুকুমে মুসা (আ.) লাঠি দ্বারা সাগরে আঘাত করলে ১২টি রাস্তার সৃষ্টি হয়। যেমনটা আল্লাহ বলেছেন, আমি মুসাকে অহি প্রেরণ করলাম, তোমার লাঠি দ্বারা সমুদ্রে আঘাত করো, ফলে এটা বিভক্ত হয়ে প্রত্যেক ভাগ বিশাল পর্বতের মতো হয়ে গেল (সুরা শু’আরা : ৬২)। মুসা তার জাতিসহ শুকনো রাস্তা দিয়ে সমুদ্রের ওপারে চলে যায়।
ফেরাউন সম্প্রদায়ের সাগরডুবি : সাগরে রাস্তা দেখে, ফেরাউন দাবি করলেন এ রাস্তা আমার তৈরি। অতএব, চল এবং ধর। তারা মাঝ সমুদ্রে পৌঁছলে, আল্লাহর আদেশে রাস্তা বন্ধ হয়। একাকার হয় পানি। উত্তাল ঢেউয়ে ভয়াল আকার ধারণ করে সাগর। তাদের চিৎকার, চেচামেচি আর আর্তনাদে ভারী হয় আকাশ বাতাস। সঙ্কিত হয়ে সমুদ্রের প্রাণীকুল। তাদের সলিল সমাধিতে পরিণত হয় লোহিত সাগর। সুরা শু’আরার বর্ণনা, আমি সেখানে উপনীত করলাম অপর দলটিকে এবং উদ্ধার করলাম মুসা ও তার সকল সঙ্গীকে। তারপর নিমজ্জিত করলাম অপর দলটিকে (৬২)।
ফেরাউনের ইসলাম গ্রহণ! : নিজকে বড় খোদা দাবি করা ব্যক্তিটি পানিতে হাবডুবু খাচ্ছে। মিসরের সর্বাধিক ক্ষমতাবান ব্যক্তিটি মুহূর্তেই নিঃস্ব। একটু আগেই তো সবাই তার ডাকে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পরেছিল। কিন্তু এখন, বড্ড একা। অহংকার আর ক্ষমতার নেশায় বুদ হওয়া ব্যক্তিটি জীবন রক্ষার জন্য চিৎকার করছে। গলা ফাটিয়ে ডাকছে। কিন্তু কোনো সাড়া নেই। এবার তার বোধোদয় হয়। সে বুঝতে পারে এক আল্লাহ ব্যতীত তাকে রক্ষাকারী কেউ নেই। তাই সে নিদারুণ কণ্ঠে ঘোষণা দিতে থাকে, আমি বিশ্বাস করলাম বনী ইসরাইল যাতে বিশ্বাস করে, নিশ্চয়ই তিনি ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই। আর আমিও মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত। (সুরা ইউনুস : ৯০)।
দাম্ভিকের ভরাডুবি : মৃত্যুকালীন ঈমান বা তাওবাহ গ্রহণীয় নয়। ফেরাউনের ছলনাপূর্ণ ঈমানের ডাকও কোনো উপকারে আসেনি। রেহাই পায়নি নিমজ্জন থেকে। হাদিসে এসেছে, তার ঈমানের চিৎকার শুনে জিবরাইল (আ.) সমুদ্রের কাদা তার মুখে নিক্ষেপ করেন। যাতে সে আর ঈমানের কথা বলতে না পারে। হতে পারে, আল্লাহর রহমত তার ক্রোধের উপর প্রাধান্য পাবে এবং মাফ করে দিবেন (আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া : ৬০৮)। আল্লাহ তার ধোঁকাপূর্ণ ঈমান কবুল করেননি। ধ্বংস হয়েছে জালিমের। পতন হয়েছে প্রবল অহংকারী ও অত্যাচারীর।
দাম্ভিক স্বৈরাচারীদের শিক্ষা : ক্ষমতার লোভে দাম্ভিকরা ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। নিজের পরিণতির কথা ভুলে জুলুমের পথে হাটেন। যা সম্পূর্ণ অনুচিত। দাম্ভিকতা একমাত্র আল্লাহর জন্য (ইবনে মাজাহ : ৪১৭৫)। সব যুগেই আল্লাহর কিছু প্রিয় বান্দা থাকেন, ক্ষমতা লিপ্সুরা অনেক সময় তাদের কলারেও হাত দেন। তখন আসমানি গজব তাদের ওপর ধেয়ে আসে। আল্লাহ বলেন, যে আমার বন্ধুদের সঙ্গে শত্রুতা রাখে, আমি তার সঙ্গে যুদ্ধের ঘোষণা দেই (বোখারি : ৬৫০২)।
লেখক : শিক্ষা পরিচালক-ভরসা মাদ্রাসা রংপুর।