মসজিদে নববির জুমার খুতবা

বরকত লাভ ও বঞ্চনার কারণ

ড. হোসাইন বিন আব্দুল আজিজ আল-আশশায়খ

প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বরকতে মানসিক প্রশান্তি : হে মুসলমানরা! সর্বশ্রেষ্ঠ উপদেশ হচ্ছে তাকওয়া অবলম্বন করা, ধার্মিকতাকে আঁকড়ে ধরা আর মাওলাপাকের আনুগত্য করা। হে মুসলিম সম্প্রদায়! এই যুগের ব্যতিব্যস্ততা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, জীবনের নানান চাপ এবং জীবনকেন্দ্রিক নতুন নতুন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে বরকত থেকে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ করে থাকেন। বরকত কী? বরকত হলো, যা পার্থিব জীবনের আনন্দের অন্যতম প্রয়োজনীয় দাবি। জীবন ও জীবনের দাবিতে বর্ধন ও বৃদ্ধি এবং এর ভালো ফল প্রকাশিত হওয়া। এই কারণে, যখনই কোনো জিনিস থেকে বরকত সরানো হয়, তখন তার পূর্ণ ফল এবং ভালো উপকারগুলো নষ্ট হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে, যখনই কোনো জিনিস থেকে বরকত সরানো হয়, তখনই তার ওপর বিপদ ও দুর্দশা নেমে আসে। রাসুল (সা.) বলেছেন : ‘বৃষ্টি বর্ষণ না করা দুর্ভিক্ষ নয়, কিন্তু দুর্ভিক্ষ হলো বৃষ্টির পর বৃষ্টি হওয়া (টানা বর্ষণ হওয়া) অথচ (এ বৃষ্টি দ্বারা) জমিন কিছুই উৎপাদন না করা। অর্থাৎ দুর্ভিক্ষ হলো আকাল, খরা-অনুর্বরতা। (মুসলিম) এই কারণেই সফল ব্যক্তি নিজ জীবনে বরকত আসার ও প্রাপ্তির কারণগুলো অনুসন্ধান করে এবং সেগুলো অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা করে। যাতে তার জীবনের উপকারিতা বৃদ্ধি পায়, এর বরকত ও কল্যাণ বৃদ্ধি পায় এবং এর মাধ্যমে একটি সুন্দর জীবন অর্জন করা যায়। কোনো মানুষ যখন বরকতপ্রাপ্ত হয়, তখন তার থেকে মানসিক অস্থিরতা এবং আগত ভয় ও বিপদ দূর হয়ে যায়, যার ফলে আত্মার প্রশান্তি ও স্বস্তি এবং হৃদয়ের তৃপ্তি ও সুখ অর্জিত হয়।

বরকত লাভের উপায় : প্রকৃতপক্ষে, বরকত, কল্যাণ এবং আনন্দ লাভের সবচেয়ে বড় উপায় হলো আল্লাহর আনুগত্যে অবিচল থাকা এবং তার সীমা মেনে চলা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যদি সে জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং পরহেজগারি অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের জন্য আসমান ও জমিন থেকে বরকতগুলো উন্মুক্ত করে দিতাম।’ (আল-আরাফ : ৯৬)। ঠিক তেমনিভাবে বরকত কেড়ে নেওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো, হারাম জিনিসের প্রসার ও ব্যাপকতা, পাপ ও খারাপ কাজে অবিচল থাকা। (মানুষের কৃতকর্মের কারণে স্থলে ও জলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদের তাদের কিছু কৃতকর্মের শাস্তি আস্বাদন করাবেন, যাতে তারা ফিরে আসে। (সুরা রুম : ৪১)।

বরকত থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ : হে মুসলিম সম্প্রদায়! বরকত কেড়ে নেওয়ার অন্যতম প্রভাব হলো, বিশাল ক্ষমতা এবং বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রাপ্যতা থাকা সত্ত্বেও বিশ্ব বড় অর্থনৈতিক সমস্যায় ভুগছে এবং বড় আর্থিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে; চরম উচ্চমূল্য, বিশাল ঋণের বোঝা জমা হওয়া এ সবকিছুই হচ্ছে, বিপুল সংখ্যক মানুষ আজ আল্লাহর পথ ও পদ্ধতি থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে। যে পথে তাদের স্রষ্টা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়, সে পথ থেকে তাদের দূরত্বের কারণে। অথচ আল্লাহর নির্দেশিত পথই একমাত্র উপায় তাদের জীবনে এবং ভবিষ্যতে তাদের সুখের জন্য। আল্লাহর পথ ছেড়ে ভিন্নপথে গমন বা বিচ্যুতির মধ্যে রয়েছে সুদের লেনদেনের বিস্তার, যার ওপর ভিত্তি করে আজ বিশ্ব অর্থনীতি গড়ে উঠেছে। এর ফলে অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং অসংখ্য সামাজিক সমস্যার উদ্ভব ঘটেছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহ সুদকে নির্মূল করেন আর দান-সদকাকে বৃদ্ধি করেন।’ (সুরা আল-বাকারা : ২৭৬)।

হে মোমেনরা! আজকের বিশ্বে বাণিজ্যিক জালিয়াতি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং জালিয়াতির ধরনও নানান রকম হয়েছে। এর ধরন ও প্রকার অন্তহীন। রূপ ও আকৃতি সীমাহীন। যা বিভিন্ন আর্থিক ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে দেখা দিয়েছে বাণিজ্যিক লেনদেনে মন্দা ও ক্ষতি এবং বরকত শূন্য হওয়া। নবী (সা.) বলেছেন, ক্রেতা-বিক্রেতার জন্য ততক্ষণ পর্যন্ত ক্রয়চুক্তি সম্পাদনের অধিকার থাকবে, যতক্ষণ না তারা পরস্পরে পৃথক হয়ে যাবে। তারপর যদি তারা সৎ হয় এবং পণ্য ও মূল্যের স্পষ্ট বর্ণনা করে তাহলে তাদের বেচাকেনায় বরকত হবে। আর যদি তারা (বেচাকেনার চুক্তিতে পণ্য ও মূল্যের বিষয়ে) গোপন করে এবং মিথ্যা বলে তবে তাদের বিক্রয়ের বরকত মুছে ফেলা হবে।’ (মুসলিম)।

হে মুসলিম ভাইয়েরা! অর্থ-সম্পদ থেকে বরকত চলে যাওয়ার একটি কারণ হলো, পণ্যের প্রচারের জন্য মিথ্যা কসমের প্রচার-প্রসার। আজকের বিশ্বে মিথ্যা কসমের প্রচার-প্রসারের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে প্রতিটি জিনিস। যেমন- বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনে পণ্যের গুণ ও বৈশিষ্ট্যের মিথ্যাচার এবং মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার প্রবণতা বিদ্যমান। যা আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রচারিত। নবী (সা.) বলেন, কসম খাওয়া অধিক পণ্য বিক্রি হওয়ার কারণ আর এটি বরকত মিটে যাওয়ার কারণ। (বোখারি ও মুসলিম)।

হে মুসলিম জাতি! ব্যক্তি এবং সমাজের জনসাধারণের জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তিগত এবং ব্যাপক তথা সরকারি বরকত উঠে যাওয়ার একটি কারণ হলো : লুণ্ঠন, ডাকাতি, কারসাজি এবং বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে পাবলিক ফান্ড নিয়ন্ত্রণ করা। এর নেতিবাচক ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ে গ্রহণকারীর ওপর এবং সামগ্রিকভাবে সমাজের প্রত্যেকের ওপর। এই কারণেই নবী (সা.) নিশ্চয়ই এ সম্পদ সবুজ মিষ্ট, যে ব্যক্তি তা (এর মালিকের) সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করে তাহলে তাতে তার জন্য বরকত হবে। আর যে সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করে না তাতে তার জন্য বরকত হবে না। আর সে হবে ওই ব্যক্তির মতো যে খায় কিন্তু অতৃপ্ত থাকে। (বোখারি ও মুসলিম)। যা হোক, যদি এই হাদিসটি এমন কারো ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, যে আফসোস, লোভ-লিপ্সা এবং তার মন্দের কারণে জনসাধারণের টাকা আত্মসাৎ করে। তাহলে হারাম উপায়ে অর্থ গ্রহণকারীর অবস্থা কী হবে?

হে আল্লাহর বান্দারা! বরকত থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, সমাজে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেওয়া, বিভিন্নভাবে মানুষের সহায়সম্পদে প্রতারণা করা, বিক্রয় মূল্য পরিশোধে বিশ্বস্ততা হারানো বা গড়িমসি করা, ঋণ পরিশোধ, বেতন বা পারিশ্রমিক আদায় করার ক্ষেত্রসহ নানাভাবে কারসাজি করা। নবী (সা.) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয় এ নিয়তে যে, সে তা পরিশোধ করে দিবে, তখন আল্লাহ তা পরিশোধ করার জন্য সহজ করে দেন এবং যে তা নিয়ে মেরে দিতে চায়, আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দেবেন।’ (বোখারি)।

সুতরাং হে আল্লাহর বান্দারা! আল্লাহকে ভয় করুন। নিজের সব লেনদেনে এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর পথ ও পদ্ধতি আঁকড়ে ধরুন। মহানবীর দিকনির্দেশনা মেনে চলুন। তাহলে আপনার ওপর বরকত নাজিল হবে। কল্যাণময় কাজ ব্যাপক ও বিস্তৃত হবে। আর আপনার জন্য উন্মুক্ত ও অবারিত হবে পৃথিবীর কল্যাণকর সমুদয় সুফল।

৫ জানুয়ারি ২০২৪ মোতাবেক ২৩ জুমাদাল আখিরা ১৪৪৫ হিজরি তারিখে প্রদত্ত মসজিদে নববির জুমার খুতবা সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের সহ-সম্পাদক মুফতি দিদার শফিক।