‘মা, রাসুল কোন দিন ইন্তেকাল করেছেন?’
ইলিয়াস মশহুদ
প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আবু বকর (রা.) একটানা ১৫ দিন অসুস্থ ছিলেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘শেষ সোমবার এসে উপস্থিত হলে আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘মা, রাসুলের ইন্তেকাল কোন দিন সংঘটিত হয়েছিল?’ আমি বলি, সোমবারে। জবাবে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কাছে আমিও এমনটা আশা করি।’ এরপর তিনি বলেন, ‘নবীজিকে কে কয়টি কাপড় দ্বারা দাফন করা হয়েছিল?’ আয়েশা বলেন, ‘তিনটি ইয়ামেনি সুতির কাপড় দ্বারা। এর মধ্যে কামিস কিংবা পাগড়ি ছিল না।’ আবু বকর (রা.) বলেন, ‘তোমরা আমার এই কাপড়টি দেখো। এর মধ্যে হয়তো মিশক বা জাফরান লাগানো আছে। এটি ধুয়ে দাও। এর সঙ্গে আরো দুটি কাপড় যোগ করে নিও।’ তাঁকে বলা হয়েছিল, ‘আল্লাহ তো আপনাকে এটার চেয়ে উত্তম কাপড় দেওয়ার তাওফিক দিয়েছেন। আমরা আপনাকে নতুন কাপড়ে দাফন করব।’ তিনি জবাবে বলেন, ‘মৃতব্যক্তি অপেক্ষা জীবিতরাই নতুন কাপড়ের বেশি হকদার। সে এটা দিয়ে তার সতর ঢেকে রাখবে। মৃত ব্যক্তি তো কয়েকদিন পর পঁচেগলে নষ্ট হয়ে যাবে।’
তিনি অসিয়ত করেছিলেন, তাঁকে যেন তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইস গোসল দেন। এ ছাড়া তাঁকে যেন রাসুলের পাশে দাফন করা হয়। দুনিয়া থেকে বিদায়ের আগে তাঁর সর্বশেষ কথা ছিল, ‘আমাকে মুসলিম হিসেবে মৃত্যু দাও এবং আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত করো।’ [সুরা ইউসুফ : ১০১]
আল্লাহ তাঁর আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেছিলেন। তিনি ১৩ হিজরির ২২ জুমাদাল উখরা সোমবার দিবাগত রাতে ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকাল হতেই যেন মদিনায় ভূমিকম্প বয়ে যায়। নবীজির ইন্তেকালের পর মদিনা তাঁর ইন্তেকালের দিনের মতো আর কখনো এতটা শোকাহত হয়নি।
আয়েশা (রা.) আরো বলেন, ‘আবু বকর (রা.) যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন আমি তাঁর পাশে উপস্থিতহই। তাঁর ওপর মৃত্যুর বিভিন্ন উপসর্গ প্রকাশ পেয়ে গিয়েছিল। নিঃশ্বাস যেন বুকে এসে আটকে যাচ্ছিল। অবস্থাদৃষ্টে আমি এই পঙ্ক্তিগুলো আবৃত্তি করি, তোমার জীবনের শপথ, সম্পদ কখনো যুবকের জন্য উপকারী হতে পারে না, যখন রুহ আটকে যায় এবং বক্ষ সংকুচিত হয়ে আসে।
এগুলো শুনে তিনি আমার দিকে রাগান্বিতভাবে তাকিয়ে বলেন, ‘মা, এভাবে নয়; বরং আল্লাহর ফরমানই সঠিক, ‘মৃত্যুযন্ত্রণা সত্যিই আসবে এ থেকেই তোমরা অব্যহতি চেয়ে আসছ।’ [সুরা কাফ : ১৯] এরপর বলেন, ‘আয়েশা, পরিবারের সবার মধ্যে আমার কাছে তুমিই অধিক প্রিয়। আমি তোমাকে একটি বাগান উপহার দিয়েছিলাম; কিন্তু এই মুহূর্তে অন্তরে খটকা অনুভব করছি। অতএব, তুমি এটি মিরাসের মধ্যে ফেরত দিয়ে দাও।’ উম্মুল মুমিনিন তা ফিরিয়ে দিলে আবু বকর (রা.) বলেন, ‘আমি খলিফা হওয়ার পর মুসলমানদের একটি দিনার বা একটি দিরহামও খাইনি। আমি ভূষিযুক্ত আটা খেয়েছি এবং মোটা কাপড় পড়েছি। সেই হাবশি গোলাম আর উট ব্যতীত মুসলমানদের ফাই-এর সম্পদ থেকে আমার কাছে আর কিছুই নেই। সে দুটি পৃথক করে নাও এবং আমার ইন্তেকালের পর সেগুলো উমরের হাতে পৌঁছে দেবে। আমার আঁচল এগুলো থেকে মুক্ত করে দেবে।’ আমার এই প্রচেষ্টা অবশ্যই সমালোচনাযোগ্য এবং পথনির্দেশনার মুখাপেক্ষী। এটি একটি সামান্য প্রচেষ্টা। এর দ্বারা আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে খিলাফতে রাশিদার শাসনামলের পরিচিতি প্রদান, যাতে আমরা শরিয়ত বাস্তবায়ন এবং মানুষের মধ্যে তার প্রচার-প্রসারের ব্যাপারে উপকৃত হতে পারি। আমি সমালোচকদের উদ্দেশে বলেন, আমি আরশের অধিপতি মহান রবের কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন এই অধমের চেষ্টা কবুল করেন। এতে বরকত দান করেন। এ কাজকে আমার পুণ্যকাজ হিসেবে গণ্য করেন, যাতে আমি তাঁর নৈকট্য অর্জন করতে পারি। আমাকে এবং যারা কাজটি পূর্ণতায় পৌঁছাতে আমাকে সহযোগিতা করেছেন, তাদের যেন প্রতিদান থেকে বঞ্চিত না করেন- এই দোয়া করি। আমাদের হাশর যেন আম্বিয়া, সিদ্দিকিন, শুহাদা ও সালিহিনদের সঙ্গে হয়। আল্লাহ বলেন, ‘আমাদের প্রতিপালক, আমাদের এবং ইমানে অগ্রণী আমাদের ভাইদের ক্ষমা করো এবং মুমিনদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে বিদ্বেষ রাখো না। আমাদের প্রতিপালক, তুমি তো দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু।’ [সুরা হাশর : ১০]
হে আল্লাহ, তোমার সত্তা পবিত্র। সকল প্রশংসা তোমার জন্য। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। আমি তোমার কাছেই ক্ষমা চাই। তোমার দিকেই আমার প্রত্যাবর্তন। আমিন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘তাঁর ইন্তেকালের পর খলিফা উমরের কাছে এগুলো পৌঁছে দিলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে। তিনি বলতে থাকেন, ‘আল্লাহ আবু বকরের ওপর রহম করুন, তিনি পরবর্তীদের জন্য কাজ (খিলাফত পরিচালনা) কঠিন করে দিয়ে গেছেন। আল্লাহ আবু বকরের ওপর রহম করুন। তিনি পরবর্তীদের জন্য কাজ কঠিন করে দিয়ে গেছেন। আল্লাহ আবু বকরের ওপর রহম করুন। তিনি পরবর্তীদের জন্য কাজ কঠিন করে দিয়ে গেছেন। (কথাটি তিনি তিনবার বলেন)’
এক বর্ণনায় আছে, আবু বকর (রা.) বলছিলেন, ‘উমরের পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে আমি বায়তুলমাল থেকে ছয় হাজার দিরহাম নিয়েছিলাম। অমুক জায়গার আমার অমুক বাগানটি এগুলোর পরিবর্তে দিয়ে দিলাম।’ যখন তাঁর ইন্তেকাল হয়ে যায় এবং উমরের কাছে তা আলোচনা করা হয়, তখন তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর ওপর রহম করুন, তিনি এটাই চাচ্ছিলেন যে, ইন্তেকালের পর যেন কেউ তাঁর দিকে আঙুল তুলতে না পারে।’
সরকারি সম্পদের ব্যাপারে খলিফা আবু বকরের এই অবস্থান তাঁর তাকওয়া ও পরহেজগারির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি তো খিলাফত পরিচালনা আর মুসলমানদের কল্যাণ-চিন্তায় তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমদানির সব উৎস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাধ্য হয়ে বায়তুলমাল থেকে পরিবারের ভরণ-পোষণের প্রয়োজন-উপযোগী ভাতা গ্রহণ করেছিলেন। এর অতিরিক্ত মোটেও ছিল না; অথচ তিনি মুসলমানদের জন্য এমন কাজ করে গেছেন, যেগুলোর জন্য কোনো রত্নভান্ডারই যথেষ্ট ছিল না। এরপর ও যখন তাঁর সামনে মৃত্যু এসে উপস্থিত হয়, তখন তাঁর সামনে সামান্য এই সম্পদ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তাও আবার বায়তুলমালে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন। এর ফলে তিনি তাঁর প্রতিপালকের কাছে নিশ্চিন্ত মনে উপস্থিত হতে পেরেছিলেন। তাঁর উভয় হাত ইমান ছাড়া সবকিছু থেকে শূন্য ছিল। তার বোঝায় তাকওয়া ছাড়া কিছুই ছিল না। এর মধ্যে রয়েছে বুদ্ধিমান জন্য শিক্ষাগ্রহণের উত্তম উপাদান।
এ ছাড়া তিনি নিজের ও সন্তানাদির জন্য যে ভাতা গ্রহণ করেছিলেন, এর মূল্য পরিশোধেরও অসিয়ত করে যান। বলেছিলেন, ‘আমার অমুক জায়গা যেন এর বিনিময়ে বায়তুলমালে দিয়ে দেওয়া হয়।’ এ ছিল তাঁর পরহেজগারির নমুনা। তিনি চাচ্ছিলেন খিলাফতের দায়িত্ব যেন কেবল আল্লাহর জন্য হয়। এতে পার্থিব কোনো স্বার্থের আঁচও না থাকে।
সূত্র . আসহাবুর রাসুল : ১/১০৬, ১/১০৫; আত-তারিখুল ইসলামি : ১০৪; আনসাবুল আশরাফ : ৬৯; তাবাকাতে ইবনে সাদ : ৩/১৪৬, ১৪৭; আল মুনতাজাম : ৪/১২৭; আশহারু মাশাহিরিল ইসলাম : ১/৯৪।
লেখক : গবেষক আলেম