দানের প্রতি মহানবীর নির্দেশ

মুফতি আইয়ুব নাদীম

প্রকাশ : ১৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মোমেনের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো দান সদকা। একজন খাঁটি ও যথার্থ মোমেনের মধ্যে যেসব গুণাবলি থাকা অত্যন্ত জরুরি তার অন্যতম একটি দান-সদকা। মোমেনের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও পালনীয় অনুসঙ্গ হলো দান-সদকা। মানুষ তার যাপিত জীবনে নানা পেশায় ও ব্যবসায় এবং নানাবিধ কর্ম-কাজের মাধ্যমে যে আয়-উপার্জন করে থাকে, তার একটি অংশ দান-সদকা করা জরুরি। কোরআন ও হাদিসের বিশাল অংশজুড়ে দান-সদকার অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। আমরা এখানে হাদিসে দানের যে ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে, তার কিছু তুলে ধরছি।

সর্বোত্তম দান : রাত-দিনের চক্রাকারে কম-বেশি সবাই দান করে থাকে, কিন্তু কখন, কীভাবে দান করলে, সে দান সর্বোত্তম দানে পরিণত হয়, তা জানা জরুরি। এ ব্যাপারে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘এক ব্যক্তি নবী (সা.)-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! কোন্ সাদকা সওয়াবের দিক দিয়ে বড়? তিনি বললেন, তোমার সে সময়ের সদকা করা (বৃহত্তম নেকীর কাজ) যখন তুমি সুস্থ থাকবে, মালের লোভ অন্তরে থাকবে, তুমি দারিদ্র্যতার ভয় করবে এবং ধন-দৌলতের আশা রাখবে। আর তুমি সাদকা করতে বিলম্ব করো না। পরিশেষে যখন তোমার প্রাণ কণ্ঠাগত হবে, তখন বলবে,‘অমুকের জন্য এত, অমুকের জন্য এত। অথচ তা অমুক (উত্তরাধিকারীর) হয়েই গেছে।’ (বোখারি : ১৪১৯)।

আরশের ছায়া লাভ হয় : কেয়ামতের বিভীষিকাময়ের কথা কে না জানে, কম-বেশি সবাই জানে, সেদিন আল্লাহতায়ালার আরশের ছায়া ছাড়া কোনো ছায়া থাকবে না; সে ছায়ার নিচে আশ্রয় পাবে সাত শ্রেণি। এর মধ্যে একটি শ্রেণি হলো, যারা আল্লাহর জন্য দান করে থাকে।

এ ব্যাপারে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা সাত ব্যক্তিকে সেই দিনে তার (আরশের) ছায়া দান করবেন যেদিন তার ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া থাকবে না; (তারা হলো,) ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ (রাষ্ট্রনেতা), সেই যুবক যার যৌবন আল্লাহর ইবাদতে অতিবাহিত হয়েছে, সেই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদগুলোর সঙ্গে আটকে থাকে, (মসজিদের প্রতি তার মন সদা আকৃষ্ট থাকে।) সেই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা স্থাপন করে; যারা এই ভালোবাসার উপর মিলিত হয় এবং এই ভালোবাসার উপরেই চিরবিচ্ছিন্ন (তাদের মৃত্যু) হয়। সেই ব্যক্তি যাকে কোনো বংশকৌলিন্য ও সুন্দরী (অবৈধ যৌন-মিলনের উদ্দেশ্যে) আহ্বান করে, কিন্তু সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি। সেই ব্যক্তি যে দান করলে গোপন করে; এমনকি তার ডান হাত যা প্রদান করে, তা তার বাম হাত পর্যন্তও জানতে পারে না। আর সেই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে; ফলে তার উভয় চোখে পানি বয়ে যায়।’ (মুসলিম : ২৪২৭)।

দানে সম্পদ বৃদ্ধি পায় : সম্পদ বৃদ্ধি সবাই চায়, তবে কীভাবে ও কী করলে, সম্পদ বৃদ্ধি পায় সবাই জানে না; সম্পদ বৃদ্ধির সহজ ও নিশ্চিত পদ্ধতি হলো, দান-সদকা করা। এ ব্যাপারে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি (তার) বৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ থেকে একটি খেজুর পরিমাণও কিছু দান করে, আর আল্লাহ তো বৈধ অর্থ ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণই করেন না; সে ব্যক্তির ওই দানকে আল্লাহ ডান হাতে গ্রহণ করেন। অতঃপর তা ওই ব্যক্তির জন্য লালন-পালন করেন; যেমন তোমাদের কেউ তার ঘোড়ার বাচ্চা লালন-পালন করে থাকে। পরিশেষে তা পাহাড়ের মতো হয়ে যায়।’ (বোখারি : ১৪১০)।

দানে আল্লাহর ক্রোধ নিভে যায় : আল্লাহতায়ালা যখন বান্দার কোনো কাজ-কর্মে তার প্রতি ক্রোধান্নিত হন; সেই ক্রোধ প্রশমিত ও দূর করার পরীক্ষিত মাধ্যম হচ্ছে, দান-সদকা করা। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দান আল্লাহর ক্রোধকে ঠান্ডা করে? আর খারাপ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে।’ (তিরমিজি : ৬৬৪)।

দানে গোনাহ মোচন হয় : গোনাহের প্রতি আকর্ষণ মানুষের স্বভাবজাত একটি বিষয়, তাই দৈনন্দিন জীবনে গোনাহ হওয়া স্বাভাবিক। তবে সবাই গোনাহের মোচন করতে চায়, তো কী করলে গোনাহ মাফ ও মোচন হয়, তা হয়তো অনেকেই জানে না; গোনাহ মাফের একটি অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে, দান করা। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন, তোমাকে কি কল্যাণগুলোর কথা বলব না? আমি বললাম হে আল্লাহর রাসুল! অবশ্যই বলুন, তিনি বললেন, রোজা মানুষের জন্য ঢালস্বরূপ। আর সদকা গোনাহ এমনভাবে মুছে দেয়; যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়।’ (তারগীব তারহীব : ৯৮৩)।

সদকায় বালা-মুসিবত দূর হয় : প্রাত্যহিক জীবনের যাবতীয় সব বলা-মুসিবত থেকে মুক্ত ও নিরাপদ থাকার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে, নিয়মিত দান-সদকা করা। এ ব্যাপারে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আনাস (রা.) সূত্র বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা দান-সদকায় প্রতিযোগিতা করো, কারণ বালা-মুসিবত দানকে অতিক্রম করতে পারে না।’ (শুআবুল ঈমান : ৩৩৫৩)।

জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ : মোমেনের জন্য পরকালীন জীবনে সবচেয়ে বড় সফলতা হলো, জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ। দুনিয়ার জীবনের দান-সদকাহর কারণে পরকালে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ হয়। এ ব্যাপারে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সদকা করো, কারণ সদকা তোমাদের জন্য জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের মাধ্যম।’ (শুআবুল ঈমান : ৩৩৫৫)। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে তার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে দান-সদকা করে উপরিউক্ত ফজিলতগুলো অর্জন করার তাওফিক দান করুন।

লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া কাশেফুল উলূম মাদ্রাসা, মধুপুর, টাঙ্গাইল।