প্রখ্যাত বিচারপতি ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) ছিলেন হানাফি মাজহাবের অন্যতম প্রধান একজন ইমাম। তিনি ছিলেন জামানার সবচেয়ে বড় ফকিহ, মুজতাহিদ ও মুহাদ্দিস। লিখনির মাধ্যমে তিনি হাদিস, ফিকাহ ও ইসলামি অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তিনি তাফসির, ইতিহাস, সাহিত্য এবং ইলমে কালামের উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। জ্ঞানের প্রদীপ আমৃত্যু জ্বালিয়ে গেছেন। এই মহান ইমামের জীবনের অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরা হলো।
জন্ম ও পরিচয় : ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) ১১৩ হিজরিতে ৭৩১ খ্রিষ্টাব্দে কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার মূল নাম ছিল ইয়াকুব। উপনাম আবু ইউসুফ। উপাধি কাজিউল কুজাত। পিতার নাম ইব্রাহিম। তার বংশপরম্পরা বিশিষ্ট সাহাবী হজরত সাদ আনসারী (রা.)-এর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এজন্য তাকে আনসারীও বলা হয়।
শৈশব ও শিক্ষা : শৈশবেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর ফিকাহ শাস্ত্রে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন আঁকেন। এ বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জনের লক্ষ্যে তিনি প্রথমে আব্দুর রহমান ইবনে আবু লাইলা (রহ.) এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তারপর ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.)-এর দরসে অংশগ্রহণ করে দীর্ঘ ১৭ বছর অধ্যয়ন করেন। ইমাম আজমের জ্ঞানের ছোঁয়ায় তিনি আলোকিত হয়ে ওঠেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেছেন, আমার ছাত্রদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জ্ঞান অর্জন করেছে আবু ইউসুফ। মূলত ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)-এর পরিবার দরিদ্র ছিল। এ কারণে তার পিতা ছেলের লেখাপড়া পছন্দ করত না। ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.) এটা জেনে তার সব খরচ বহন করেন। ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) বলেন, দরসে আমাকে অনুপস্থিত দেখে ইমাম আজম আমার খোঁজখবর নিলেন। সংসারের দুর্দশার কথা জেনে তিনি লোক চক্ষুর আড়ালে আমাকে ১০০ দিরহাম বোঝাই থলে প্রদান করলেন। নিয়মিত ক্লাসে থাকতে বললেন এবং অর্থ শেষ হলে তাকে জানাতে বললেন। এরপর আমি নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত হতে লাগলাম। অর্থ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই কীভাবে যেন তিনি বুঝে যেতেন। আবার অর্থ প্রদান করতেন। আল্লাহপাক তাকে আমার পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদান দান করুন এবং ক্ষমা করুন, আমিন।
বিচার কাজ ও ইবাদাত : ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) কে ৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা মুহাম্মাদ আল মাহদী ইবনে মানসুর বসরার বিচারক হিসেবে নিযুক্ত করেন। খলিফা হারুনুর রশিদ ক্ষমতা গ্রহণ করে তাকে পুরো সাম্রাজ্যের কাজিউল কুজাত বা চিফ জাস্টিস হিসাবে ঘোষণা করেন। তিনি বিচার কার্যের পাশাপাশি তালিম-তাজকিয়ার কাজ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে আঞ্জাম দিতেন। ইবাদাতের রুটিন ঠিক রাখতেন। তিনি দৈনিক ২০০ রাকাত নফল নামাজ আদায় করতেন। তিনি নিজে বলেন, ইমাম আবু হানিফার দরবারে আমি ২৯ বছর ছিলাম কখনো ফজরের জামাত মিস করিনি। তিনি সারা জীবন কতটা স্বাধীন আর ইনসাফের সঙ্গে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন মৃত্যুর আগে একটি ঘটনায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। মৃত্যুর সময় তিনি একটি বিষয়ে পেরেশান ছিলেন। বার বার বলছিলেন, আল্লাহর কসম ! জীবনে কোনো দিন পাপাচার, জুলুম-অবিচার করিনি। কিন্তু ওই দিনের জন্য ভয় হচ্ছে। ইমাম মুহাম্মাদ (রহ.) জিজ্ঞেস করলেন ওই দিনের ঘটনা কি? তিনি বললেন, একটা ভূমি নিয়ে খলিফার বিরুদ্ধে আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছিল। মামলার বিবাদী খলিফা হারুনুর রশিদ আর বাদী হলো এক খ্রিষ্টান। বিষয়টি আমি খলিফার কাছে পেশ করলে তিনি বললেন, এটি আমি আমার দাদা খলিফা মানসুর থেকে মিরাসসূত্রে পেয়েছি। অতঃপর আমি খ্রিষ্টানকে বললাম, তোমার দলিল এবার পেশ কর। সে বলল, আমার কাছে দলিল নেই। আপনি হারুনুর রশিদকে শপথ করান। তিনি শপথ করলেন। তখন খ্রিষ্টান চলে গেল। ফায়সালা খলিফার পক্ষে গেল। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে, আমি কেন খলিফাকে খ্রিষ্টানের সমমর্যাদায় রেখে আদালত কক্ষে বসাইনি। কেননা, বিচার মঞ্চে মর্যাদার দিক থেকে বাদী বিবাদী দুজনেই সমান। ইমাম মুহাম্মাদ (রহ.) বললেন, এতে ভয়ের কি আছে? আপনি তো ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। তিনি বললেন, আমিরুল মোমিনীনকে যে বাদীর সমমর্যাদায় রাখিনি!
অবদান ও ইন্তেকাল : ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। কাশফুজ জুনুন গ্রন্থকার লিখেছেন তার রচনা তিনশত খণ্ডে বিস্তৃত। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কিতাব হলো মুসনাদে ইমাম আবু হানিফা, কিতাবুল খারাজ, আদাবুল কাজী, ইখতিলাফুল আমসার, আল মালী ফিল ফিকহ ও আল ফারায়েজ, কিতাবুল বুয়ু ইত্যাদি। ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.)-এর প্রতিচ্ছবি ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, মুহাম্মাদ ইবনে হাসান শাইবানী, মুআল্লা ইবনে মানসুর প্রমুখ শিষ্যবৃন্দ ও হাজার হাজার ভক্ত অনুরাগী রেখে ১৮২ হিজরিতে ৭৯৮ খ্রিষ্টাব্দে বাগদাদে ইন্তেকাল করেন।
(সূত্র : খতিব বাগদাদি, তারিখে বাগদাদ ১৪/২৪৪, মানকিবু আবী হানীফা:১/৪৯৬, ফাজাইলু আবী হানীফা, ইবনে আবিল আওয়াম : ৩২৬, ফাজায়েলে জিন্দেগি ও আল কাউসার)।
লেখক : তরুণ আলেম