নবীদের জীবনে উম্মতের জন্য নানান শিক্ষা রয়েছে। তাদের জীবনে ঘটিত প্রতিটি ঘটনা থেকে বোদ্ধামহল শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। নবীদের জীবনের নানান দিক ও আদর্শ উম্মতের জন্য দিকনির্দেশক ও পাথেয়। মানুষকে হেদায়াতের পথ দেখিয়ে জান্নাতের পথে নিয়ে আসা এবং আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের পথ ও পন্থা বাতলে দেওয়া নবীদের অন্যতম গুরু দায়িত্ব। এ দায়িত্ব প্রতিটি নবীই পালন করেছেন। ঘরে বাইরে সর্বত্র ঈমানের দাওয়াত দিয়েছেন। আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় আর নবী আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত উম্মতের রাহবার এ কথার সাক্ষ্য দিয়ে এক আল্লাহর ইবাদত করার প্রতি আহ্বান জানাতেন সব নবী। যেমন শুআইব (আ.) মাদইয়ানবাসী তার উম্মতকে তৌহিদ ও ইবাদতের প্রতি আহ্বান করে বলেন, ‘হে আমার কওম, আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো মাবুদ নেই। আর ওজন ও পরিমাপে কম দিয়ো না। (সুরা হুদ : ৮৪)। আদ জাতির কাছে আল্লাহতায়ালা হুদ নবীকে প্রেরণ করেন। হুদ নবী তার উম্মতকে আল্লাহর ইবাদত করার জন্য কী বলে আহ্বান করতেন, তা কোরআনে এসেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি তাদের ভাই হুদকে। সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো মাবুদ নেই। তবুও কি তোমরা আল্লাহকে ভয় করবে না? (সুরা হুদ : ৬৫)। নুহ (আ.) তার কওমকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য আহ্বান করতেন। আহ্বান করতেন একমাত্র উপাস্য আল্লাহর ইবাদত করতে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি নুহকে তার কওমের কাছে পাঠিয়েছি। অতঃপর সে তার কওমকে বলল, হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো উপাস্য নেই। আমি তোমাদের ওপর আশঙ্কা করছি এক মহা দিবসের শাস্তির। (সুরা আরাফ : ৫৯)।
ঈমানই আসল পরিচয় : নবীদের সঙ্গে তাদের আত্মীয় ও অনাত্মীয় সবার সম্পর্ক ঈমানের ভিত্তিতে। ঈমানের সম্পর্ক ছাড়া নবীর আত্মীয় ও সাহায্যকারী হলেও সে আত্মীয়তার কোনো মূল্য নেই। এ সম্পর্ক কেয়ামতের দিন জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবে না। কাজেই নবীকে না মেনে যতই ধর্মের কাজ করা হোক, সে কাজও আল্লাহর কাছে কোনো গুরুত্ব পাবে না। জাহান্নাম থেকেও বাঁচবে না। এর দৃষ্টান্ত হলো- ইবরাহিম নবীর বাবা আজর। যিনি ছিলেন মূর্তিপূজক।
তিনি ইবরাহিম নবীর প্রতি ঈমান আনেননি। তাই তিনি নবীর বাবা হয়েও জাহান্নামি। নুহ (আ.)-এর ছেলে বাবার প্রতি নবী হিসেবে ঈমান না আনার কারণে জাহান্নামি। ঈমান ছাড়া রক্ত সম্পর্কও জাহান্নাম থেকে বাঁচাতে পারবে না। নুহ (আ.)-এর ছেলে কিনআন ঈমান আনেনি। মহাপ্লাবনের সময়ও কিশতিতে ওঠেনি। পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের সেই মুহূর্তের ঘটনা কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। ‘পাহাড়ের মতো ঢেউয়ের মধ্যে তা (কিশতি) তাদের নিয়ে বয়ে চলে। নুহ তার ছেলেকে যে পৃথক ছিল তাকে ডেকে বলল, ‘হে আমার ছেলে, আমাদের সঙ্গে আরোহণ কর এবং কাফেরদের সঙ্গী হয়ো না। সে (ছেলে) বলল, ‘আমি এমন এক পর্বতে আশ্রয় নিব, যা আমাকে প্লাবন থেকে রক্ষা করবে। নুহ বললেন, আজ আল্লাহর শাস্তির নির্দেশ থেকে রক্ষা করার কেউ নেই। তবে ওই ব্যক্তিই রক্ষা পাবে যার প্রতি আল্লাহ দয়া করবেন।
এরপর ঢেউ তাদের পৃথক করে দেয়। আর সে (ছেলে কিনআন) নিমজ্জিতদের দলভুক্ত হয়ে যায়। (সুরা হুদ : ৪২-৪৩)।
লুত (আ.)-এর স্ত্রীও জাহান্নামি। নবীর স্ত্রী হয়েও জান্নাতি হতে পারবে না। কারণ সে নবীর ওপর ঈমান আনেনি। সমকামিতার মতো পাপকাজে লোকদের সহায়তা করেছে। তাই আল্লাহ তাকেসহ পুরো জাতিকে জমিন উল্টিয়ে দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছেন। কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অতঃপর ফেরেশতারা লুত (আ.) কে নিজ পরিবারসহ (সুরা কমার : ৩৪) ‘কিছু রাত থাকতেই’ এলাকা ত্যাগ করতে বললেন এবং বলে দিলেন যেন ‘কেউ পেছন ফিরে না তাকায়। তবে আপনার বৃদ্ধা স্ত্রী ছাড়া। নিশ্চয়ই তার ওপর ওই গজব আপতিত হবে, যা ওদের ওপরে হবে। ভোর পর্যন্তই ওদের মেয়াদ। ভোর কি খুব নিকটে নয়’? (সুরা হুদ : ৮১; শো’আরা : ১৭১)।
আবু তালিবের শেষ ঠিকানা : রাসুল (সা.) কে সবচেয়ে বেশি আগলে রেখেছেন রাসুলের চাচা আবু তালিব। মক্কার কাফেরদের অত্যাচার থেকে নবী (সা.) কে রক্ষার জন্য তিনি ছিলেন ঢালস্বরূপ। রাসুলের শৈশব থেকে নবুয়ত পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সাহায্যকারী ছিলেন আবু তালিব। মুসলমানদের সঙ্গে বয়কটকালে কঠিন মুহূর্তেও তিনি সবী (সা.)-এর সঙ্গে ছিলেন। তিন বছর কষ্টে সময় কাটিয়েছেন। বয়কটকালে যেখানে অবস্থান করেছেন মুসলিমগণ সে স্থানের নামও হয়েছে তার নামে ‘শিয়াবে আবি তালিব’। খাদিজা (রা.)-এর সঙ্গে রাসুলের বিয়ের খুতবাও পাঠ করেন আবু তালিব। রাসুল সত্য নবী এ কথাও তিনি সত্যায়ন করতেন। কিন্তু নিজে ভাতিজার প্রতি ঈমান আনেননি। কালিমা পড়েননি। শেষ বয়সে মৃত্যর ভয়ে বাপ-দাদার ধর্ম ছেড়ে ভাতিজার ধর্ম গ্রহণ করেছে বলে মক্কার নেতারা তিরস্কার করবে এই অপমানের ভয়ে। তাই আবু তালিব রাসুলের চাচা হয়েও জাহান্নামি। রাসুলের সহযোগী হয়েও জাহান্নামি।
আবু তালিবের শাস্তির ব্যাপারে হাদিসে এসেছে। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি নবী (সা.) কে বলতে শুনেছেন, যখন তার সামনে তার চাচা আবু তালিবের আলোচনা করা হলো, তখন তিনি বললেন, আশা করি কেয়ামতের দিনে আমার সুপারিশ তার উপকারে আসবে। অর্থাৎ আগুনের হালকা স্তরে তাকে ফেলা হবে। যা তার পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত পৌঁছাবে আর এতে তার মগজ টগবগ করে ফুটতে থাকবে। (বোখারি : ৩৮৮৪)।
নবী পরিবারের ঘটনা থেকে শিক্ষা : নবীদের আনুগত্য ও যথার্থ অনুরণ করা ছাড়া মোমিন হওয়া যায় না। নবীদের প্রতি বিশ্বাস ও ঈমান না এনে হাজারো নেক কাজ করলে তা কোনো উপকারে আসবে না পরকালের জীবনে। সর্বক্ষেত্রে মুহাম্মদ (সা.)-এর আনুগত্য ও অনুসরণ এবং তার আনীত বিধানকে যথাযথভাবে পালন করা মোমিন বান্দার জন্য অতি আবশ্যক কর্তব্য।
লেখক : প্রিন্সিপাল ও শাইখুল হাদিস, জামেয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা-১২১১।