লোক সমাজে মক্কার এক বড় নেতা আবু জাহেল নামে পরিচিত। তবে তার আসল নাম ছিল ‘আমার ইবনে হিশাম’ অর্থাৎ হিশামের পুত্র আমর। বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তার কারণে আবুল হাকাম (প্রজ্ঞাবান) উপাধিতে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে ইসলাম ও রাসুলের ঘোর দুশমনি ও খোদাদ্রোহীতায় লিপ্ত হওয়ায় রাসুল (সা.)-এর দেওয়া নাম আবু জাহেল বলে সবাই ডাকত। আর এ নামেই আজ বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত। তিনি ছিলেন মক্কার একজন মূর্তি পূজারি বা বহু ঈশ্বরবাদী পৌত্তলিক কুরাইশ নেতা। ৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা নগরীর পশ্চিমাংশ হেজাজ নামক জায়গায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি উমর ইবনে আবু রাবিয়াহ-এর ভাই ছিলেন এবং উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-এর মামা ছিলেন। তার সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি মুহাম্মদ (সা.)-এর ঘোরবিরোধী এবং ইসলাম ও মক্কার মুসলমানবিরোধীদের প্রথম পতাকাবাহী।
মক্কার সরদারী ও বিচক্ষণতা : তিনি বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতায় ছিলেন মক্কার প্রথম সারির একজন। তার বুদ্ধির তীক্ষèতা তৎকালীন সকলেই এক বাক্যে মানত। যার ফলে আবুল হিকাম (প্রজ্ঞাবান) উপাধিতে ভূষিত হন। কারণ তিনি গভীর জ্ঞানের মানুষ হিসেবে বিবেচিত ছিলেন। এবং কুরাইশ প্রবীণ নেতারা দক্ষতা ও উপলব্ধির জন্য তাকে নিজেদের আসরে একজন আভিজাত্য সদস্য হিসেবে নিতেন এবং তার মতামতকে প্রাধান্য দিতেন। মোহাম্মদ নিধন বৈঠক ‘দারুণ নাদওয়ার’ মতো কুচক্রের বড় বৈঠকে তার ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। আর এভাবেই তার বিচক্ষণতা ও দক্ষতায় মক্কার কুরাইশ সরদারে পরিণত হন।
ইসলাম ও নবীর বিরোধিতা : আবু জাহেল ইসলাম ও রাসুল বিরোধিতায় মক্কায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন। তার মতামত ও সিদ্ধান্তেই রাসুলকে হত্যার মতো জঘন্যতম ষড়যন্ত্রের দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল। যার তীব্র বিরোধিতায় ইসলাম প্রচার শুরু থেকেই বাধাপ্রাপ্ত হয়। রাসুলের দাওয়াতি কার্যক্রমে বাধা প্রদানের লক্ষ্যে তার হুকুমে মক্কার অলিতে-গলিতে লোক দাঁড় করিয়ে রাখা হতো এবং রাসুলকে পাগল বলে লোক সমাজে বুলি উড়াত। যেন সাধারণ মানুষ রাসুলকে পাগল ভেবে দাওয়াত গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু ফলাফল হয়েছে পুরো উল্টো। লোকজন মুহাম্মদের কথা শুনে, কোরআনের তিলাওয়াত শুনে ইসলামে দীক্ষিত হতে শুরু করে। কোনো অপপ্রচারই কাজে আসেনি। সত্য ধর্ম ইসলাম তার আপন গতিতে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। ইতিহাসের পাঠকমাত্রই জানে, আবু জাহেলের নেতৃত্বে বনু হাশিম ও ইসলাম গ্রহণকারীদের হিজরত পূর্ব মুহূর্তে মক্কায় প্রায় দেড় বছর বয়কট করে রাখা হয়। এভাবে ইসলামের প্রথম শুরুর দিকে ইসলামবিরোধী কার্যক্রমের প্রত্যেকটাতেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার অংশগ্রহণ ছিল।
যুদ্ধ ও ষড়যন্ত্র : রাসুল (সা.)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির পর নানাভাবে মক্কার কাফেররা ইসলাম ও রাসুল (সা.) কে শেষ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকত। রাসুল (সা.) নবুওয়াত প্রাপ্তির দীর্ঘ ১৩ বছর মাতৃভূমির মানুষদের দ্বীনের পথে আহ্বান করেন। কিন্তু কাফেরদের পক্ষ থেকে আসা কষ্ট ও বিরোধিতা যখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায় এবং উগ্রতা ও অনীহা চরম পর্যায়ে পৌঁছে। তখন আল্লাহর নির্দেশে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে ২১ জুন নবুওয়াতের ১৩তম বছর মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে রাসুল ও তার অনুসারীরা মদিনায় হিজরত করেন। তখনও আবু জাহেলের নেতৃত্বে মক্কার কাফেররা শত্রুতা ও ষড়যন্ত্র দমিয়ে রাখেনি। বরং মদিনার আশপাশের জনগোষ্ঠীকে রাসুলকে দেশান্তর করার জন্য চিঠিপত্র দিয়ে দাওয়াত দিত। এ সময় বেশ কিছু খণ্ডযুদ্ধও সংঘটিত হয়। হিজরি দ্বিতীয় সনে ১৭ রমজান মক্কার কাফের ও মুসলমানদের মধ্যে প্রথম সামরিক যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধটি বদর প্রান্তে হওয়ায় তার নাম হয় ‘বদর যুদ্ধ’। এ যুদ্ধে মুসলমানদের সেনাপ্রধান ছিলেন স্বয়ং রাসুল (সা.)। আর অন্যদিকে মক্কা থেকে আসা কাফের বাহিনী আবু জাহেলের নেতৃত্বে ১০০০ জন সেনা ১০০ ঘোড়া, ৬০০ লৌহবর্ম এবং অসংখ্য উট। তাদের সেনাপতি ছিল উতবা ইবনে রাবিয়া। যুদ্ধে ৭০ জন অমুসলিম সেনা নিহত হন এবং ৭০ জন বন্দি হন। অন্যদিকে মুসলিম সেনা ছিলেন ৩১৩ জন। উট ছিল ৭০টি এবং ঘোড়া ছিল ২টি। যুদ্ধে ১৪ জন শহীদ হন। তবে এ যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয় লাভ করেন।
শিশুর হাতে করুণ মৃত্যু : বদর যুদ্ধে তুমুল লড়াই চলছে। আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) শত্রুকে ঘায়েল করার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন সুযোগের অপেক্ষায়। হঠাৎ তার পাশে দুজন বালক উপস্থিত। তারা আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) কে জিজ্ঞাসা করেন। চাচা! আপনি কি আবু জাহেলকে চেনেন? উত্তরে বলেন, হ্যাঁ চিনি।
তবে তোমরা আবু জেহেলকে চিনে কী করবে? জবাবে বলে, আমরা শুনেছি সে রাসুলকে গলমন্দ করে ও ইসলামবিরোধী নানা ষড়যন্ত্র করে। আমরা আল্লাহর শপথ করেছি- যার হাতে আমাদের প্রাণ। আমরা তার উপর আক্রমণ করব এবং আক্রমণ চালিয়েই যাব যতক্ষণ না আমাদের মধ্যে কেউ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) বলেন, আমার হৃদয় সাহসে ভরে গেল এবং আমি বিস্মিত হলাম। তাদের আবু জাহেলকে দেখানো মাত্রই তারা দৌড়ে আবু জাহেলের সামনে হাজির। তখন আবু জাহেল ঘোড়ায় চড়ে ছুট ছিলেন। তাদের দুজনের পক্ষে ঘোড়ায় চড়া অবস্থায় আবু জাহেলের শরীরে আক্রমণ করা সম্ভব ছিল না। তাই একজন আক্রমণ করল আবু জাহেলের ঘোড়ায়। আরেকজন তলোয়ার দিয়ে আবু জাহেলের পায়ে। এক আঘাতে আবু জাহেল মুহূর্তের মধ্যে মাটিতে লুটে পড়ে এবং ছটফট করতে থাকে। আর তারা দুজন সমানতালে আঘাত করতে থাকে। আবু জাহেল এখনো মারা যাননি। দূর থেকে আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) এ অবস্থা দেখে এগিয়ে আসেন এবং আবু জাহেলের মৃত্যু নিশ্চিত করেন। সাহসী বালক দুজন ছিলেন আফরা (রা.)-এর পুত্র। একজন মা’আজ ও অপরজন মু’আয়াজ। আল্লাহতায়ালা বড়ো বড়ো ক্ষমতাধর নেতা ও রাজা-বাদশাদের ছোট ছোট ব্যক্তি বা প্রাণী দিয়ে হত্যা করিয়ে জগদ্বাসীকে বুঝিয়ে দেন ক্ষমতা ও শক্তি তোমার হাতে নয়, আমার হাতে।
লেখক : সহকারী মুফতি, মারকাযুদ দাওয়াহ ওয়াল ইরশাদ, ঢাকা।