একজন ব্যক্তির কাছে সর্বাধিক হকদার হলেন তার মা। মায়ের থেকে অধিক অধিকারসম্পন্ন ব্যক্তির জন্য দুনিয়ায় আর কেউ নেই। একজন ব্যক্তি নবীজিকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার উত্তম ব্যবহারের অধিক হকদার কে? উত্তরে তিনি বললেন, তোমার মা, তোমার মা, তোমার মা অতঃপর তোমার বাবা (বোখারি : ৫৯৭১)। হযরত কা’ব বলতেন, কসম সেই সত্তার যার হাতে আমার জীবন। নিশ্চয়ই আল্লাহ বান্দার জীবনকাল ত্বরান্বিত করেন পিতামাতার অবাধ্য হওয়ার কারণে, যাতে আজাব ত্বরান্বিত করা যায়। আর পিতামাতার সঙ্গে সদাচারণের কারণে আল্লাহ বান্দার জীবনকাল বৃদ্ধি করেন (আল-জামে : ১৩০)।
আল্লাহর ঘোষণায় মায়ের অধিকার : একজন মা সন্তানের জন্য কতটা কষ্ট করেন, তা জ্ঞানী মাত্রই বুঝেন। মহাজ্ঞানী আল্লাহ সন্তানের জন্য মায়ের কষ্টের কথা কোরআনে বর্ণনা করেছেন এবং সন্তানকে মায়ের সঙ্গে সদাচারণের আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন, আর আমি মানুষকে তার পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভেধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ান দু’বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও (সুরা লোকমান : ১৪)। আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা ব্যতীত সব বিষয়ে মায়ের সঙ্গে সদাচারণ করা সন্তানের দায়িত্ব। যেনমটা আল্লাহ বলেছেন এবং দুনিয়াতে তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে সহাবস্থান করবে (সুরা লোকমান : ১৫)।
মায়ের সন্তষ্টিতে আল্লাহর সন্তষ্টি : আল্লাহতায়ালার কাছে মায়ের অধিকার এতটাই বেশি যে, মায়ের সন্তষ্টির মধ্যেই তিনি নিজের সন্তষ্টি নিহিত রেখেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আমরের বর্ণনায় এসেছে, নবীজি বলেন, পিতামাতার সন্তষ্টিতে রবের সন্তষ্টি। আর পিতামাতার অসন্তষ্টিতে রবের অসন্তষ্টি (ইবে হিব্বান : ৪২৯)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, নবীজি বলেন, যে ব্যক্তি পিতামাতাকে সন্তষ্টাবস্থায় প্রভাত করে। তার জন্য জান্নাতের অভিমুখে দু’টি দরজা উন্মোচন করা হয়। যদি পিতামাতার একজন থাকে তাহলে একটি। আর যদি পিতামাতাকে অসন্তষ্ট করে, তাহলে জাহান্নামের দুটি রাস্তা তার জন্য খুলে দেয়া হয়। যদিও পিতামাতা সন্তানের প্রতি জুলুম করে (আল-জামে : ৯৩)। মাকে সন্তষ্ট রাখতে পারলে আল্লাহ সন্তষ্ট হবেন আর আল্লাহ সন্তষ্ট হলে ব্যক্তির জন্য জান্নাত নিশ্চিত হবে।
আমি কী মায়ের হক আদায় করতে পেরেছি? : সন্তানের প্রতি মায়ের ঋণ এতটাই বেশি যে, সন্তান কোনোভাবেই মায়ের স¤পূর্ণ ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না। জুর’আ ইবনে ইবরাহিম বলেন, একজন ব্যক্তি ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-এর কাছে এসে বললেন, হে আমিরুল মোমিনিন, আমার বয়ো-বৃদ্ধ মা আছেন। যিনি নিজ শক্তিবলে প্রয়োজন পূরণে অক্ষম। যার কারণে আমার পিঠ তার বাহন হয়। পিঠে করেই আমি তাকে আনা-নেয়া করি। তার প্রয়োজন পূরণ করি। আমি কি তার (মায়ের) হক আদায় করতে পেরেছি? উত্তরে ওমর (রা.) বললেন, না (আল-জামে : ৯০)।
অধিকারে মায়ের প্রাধান্য : একজন সন্তানের উচিত এবং কর্তব্য হলো, নিজ সন্তানের ওপর মাকে প্রাধান্য দেয়া। যদি এমনটা করতে পারি, তাহলে সফলতা আমাদের পদ চুম্বন করবে, নয়তো আমাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। আবু সালেম জাইশানি নবীজি থেকে বর্ণনা করেন, আ’ক সম্প্রদায়ের একজন নারী প্রচণ্ড গরমের দিনে প্রস্থান করলেন। সঙ্গে তার মা এবং সন্তান ছিল। আমি তার সন্তানের পাশ দিয়ে গমনকালে দেখলাম মহিলাটি স্বগোত্রীয় এক লোককে তার সন্তানটিকে অর্পণ করেছেন আর নিজ মাকে মাটির গরম থেকে বাঁচাতে নিজ উরুতে রেখেছেন। নবীজি বলেন, এই কাজটির কারণে আল্লাহতায়ালা তাকে ক্ষমা করেছেন (আল-জামে : ৯৯)। আফসোস আমাদের জন্য! আমরা সন্তানকে রাজপুত্রের স্থানে রাখতে পারলেও আপন মাকে রাজ-মাতার স্থান দিতে পারি না। সন্তানের আরামণ্ডআয়েশের ব্যবস্থা করলেও মায়ের আরামণ্ডআয়েশের প্রতি ভ্রুক্ষেপও করি না। সন্তান হিসাবে এটা আমাদের জন্য কলংকের।
বার্ধক্যে মায়ের সেবা : মায়ের সব প্রকারের সেবা-শুশ্রুষা করা সন্তানের জন্য অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। আব্দুর রহমান ইবনে সুরাই বলেন, একজন মহিলা নবীজির কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার মা বৃদ্ধাবস্থায় উপনীত হয়েছেন। আমি তার সেবায় সেই সব কাজ করি, যা তিনি আমার জন্য করতেন। আমি তার প্রত্যেকটি আরামণ্ডআয়েশের খেয়াল রাখি। আমি তার সেই সব ময়লা পরিষ্কার করি যা শিশু সন্তানের করা লাগে। হে আল্লাহর রাসুল আমি কি তার অধিকার আদায় করতে পেরেছি? নবীজি বললেন, না (আল-জামে : ১১৩)। কালবেলা পত্রিকার খবর বৃদ্ধ পিতামাতাকে ছেলেরা যনুমার চরে ফেলে গেলে বৃদ্ধ পিতা ইন্তেকাল করেন। সন্তান হয়ে যদি পিতামাতাকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দিতে না পারি, তবে এর থেকে নিকৃষ্ট মানসিকতার উপমা হতে পারে না। এমন সন্তানে আমাদের সমাজটা ছেয়ে গেছে। এদিক-সেদিক একটু কান পাতলেই শুনতে পাবেন, এমন নানান খরব।
নিজের ধ্বংস আহ্বানকারী : যে ব্যক্তি নিজ মাকে পেল এবং তার সেবা যত্ন করে জান্নাত অর্জন করতে পারল না, ধ্বংস ও আফসোস তার জন্য। নবী (সা.) বলেছেন, ধ্বংস সেই ব্যক্তির জন্য যে, পিতামাতাকে অথবা কোনো একজনকে পেল এবং তাদের প্রতি সদাচরণের মাধ্যমে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না (আল-জামে : ১১৫)। মায়ের আদেশ অমান্য করাও এক-ধরনের অবাধ্যতা গোনাহের কাজ। কা’বে আহবারকে পিতামাতার অবাধ্যতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান, পিতামাতা তোমাকে কোনো কিছুর আদেশ করলে তা পালন না করাই অবাধ্যতা (আল-জামে : ১১৬)। আমাদের সমাজে এমন সন্তানের অভাব নেই যারা প্রতিনিয়ত মায়ের আদেশ অমান্য করেন। মাকে গালিগালাজ করেন। সেবা-শ্রুষা করেন না। নবীজির কথা মতে এদের ধ্বংস নিশ্চিত।
মায়ের সঙ্গে মন্দ আচরণ বর্জনীয় : বর্তমান যুব-সমাজের প্রতি লক্ষ্য করলে সবার মধ্যে একটি বিষয় দেখা যায়, তা হলো তারা নিজ বন্ধুদের সঙ্গে মিশুক, ভদ্র ব্যবহারকারী, সদাচারণকারী। কিন্তু এরাই আবার পিতামাতার সঙ্গে বদণ্ডস্বভাবি, বদণ্ডমেজাজি। যারা তার কাছে সদ্ব্যবহারের অধিকার রাখে তাদের প্রতি তারা খারাপ আচরণ করছে। আর যারা কোনো অধিকারই রাখে না। তাদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করছে। আবার অনেকেই বন্ধুমহলে দাতা হাতেম তাঈ হিসাবে পরিচিত; কিন্তু পিতামাতার ক্ষেত্রে এরাই আবার কৃপণ, অভাবি। এটা কেয়ামতের আলামত। নবীজি বলেছেন, কেয়ামতের আগে এমন এক সময় আসবে, যখন সন্তান বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে; কিন্তু পিতামাতার সঙ্গে কঠিন আচরণ করবে। আমাদের ভাবা উচিত আমরা কোন পথে চলছি। ধ্বংসের পথ থেকে ফিরে আসা দরকার। নয়তো, জাহান্নাম থেকে আমাদের কেউ রক্ষা করতে পরবে না।
লেখক : শিক্ষা পরিচালক-ভরসা মাদরাসা রংপুর।