বিখ্যাত সাহাবীদের মধ্যে অন্যতম আবু হুরায়রা (রা.)। তিনি আহলে সুফফার সক্রিয় একজন সদস্য এবং একনিষ্ঠ জ্ঞানপিপাসু ছিলেন। রাসুল (সা.)-এর সান্নিধ্যে সৌরভে অল্প সময়ে তিনি শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন। প্রখর স্মৃতিশক্তি ও কঠোর সাধনায় হাদিস শাস্ত্রের সম্রাট হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার হাদিস তিনি বর্ণনা করেছেন?। ইসলামের টানে মাতৃভূমি ইয়েমেন ছেড়ে তিনি মদিনায় চলে আসেন। তার পরিবারে একমাত্র মা ছিল আপনজন। মায়ের প্রতি তার ভক্তি, ভালোবাসা ও টান ছিল অন্যরকম। তার জীবনী থেকে শিক্ষা রয়েছে সবার জন্য।
মায়ের জন্য ছেলের অস্থিরতা : আবু হুরায়রা (রা.) দিন-রাত মহানবীর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা আসহাবে সুফফায় পড়ে থাকতেন। ইলম অর্জন করতেন। কিন্তু তখনও পর্যন্ত তার মা ইসলাম গ্রহণ করেননি। এটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। মায়ের জন্য অস্থিরতা বিরাজ করছিল। শেষমেশ মহানবীর দোয়ার বরকতে তিনি ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। আবু কাসীর (রহ.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি আমার মাকে ইসলামের প্রতি আহ্বান জানাতাম। তখন তিনি মুশরিকা ছিলেন। একদিন আমি তাকে ইসলাম কবুলের জন্য আহ্বান জানালাম। তখন তিনি রাসুল (সা.)সম্পর্কে আমাকে এমন কথা শোনালেন যা আমার কাছে খুবই অপ্রীয় ছিল। আমি কাঁদতে কাঁদতে রাসুল (সা.) কাছে এলাম?। আমি বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি আমার মাকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে আসছিলাম আর তিনি অস্বীকার করে আসছিলেন। এরপর আমি তাকে আজ দাওয়াত দেওয়াতে তিনি আমাকে আপনার সম্পর্কে এমন কথা শোনালেন তা আমি পছন্দ করি না। সুতরাং আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করুন তিনি যেন আবু হুরায়রার মাকে হেদায়েত দান করেন। তখন রাসুল (সা.) বললেন, হে আল্লাহ! আবু হুরায়রার মাকে হেদায়েত দান কর। নবী (সা.)-এর দোয়ার কারণে আমি খুশি মনে বেরিয়ে এলাম। যখন আমি ঘরের দরজায় পৌঁছলাম, তখন তা বন্ধ দেখতে পেলাম। আমার মা আমার পায়ের আওয়াজ শুনতে পেয়ে তিনি বললেন, আবু হুরায়রা একটু দাঁড়াও। তখন আমি পানির কলকল শব্দ শুনছিলাম। তিনি বললেন, এরপর আমার মা গোসল করলেন এবং গায়ে চাদর পরলেন আর তড়িঘড়ি করে দোপাট্টা ও ওড়না জড়িয়ে নিলেন। এরপর ঘরের দরজা খুলে দিলেন। এরপর বললেন, হে আবু হুরায়রা! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ (সা.) তার বান্দা ও রাসুল। তিনি বলেন, তখন আমি রাসুল (সা.) খেদমতে রওনা হলাম। এরপর তার কাছে গেলাম এবং আমি তখন আনন্দে কাঁদছিলাম। আমি বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আল্লাহপাক আপনার দোয়া কবুল করেছেন। আবু হুরায়রার মাকে হিদায়াত দান করেছেন। তখন তিনি আল্লাহর শুকর আদায় করলেন ও তার প্রশংসা করলেন এবং ভালো ভালো কথা বললেন। এরপর আমি বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, তিনি যেন আমাকে এবং আমার মাকে মুমিন বান্দাদের কাছে প্রিয় করেন এবং তাদের ভালোবাসা আমাদের অন্তরের বদ্ধমূল করে দেন। এরপর রাসুল (সা.) বললেন, হে আল্লাহ! তোমার এই বান্দাকে এবং তার মাকে মুমিন বান্দাদের কাছে প্রিয় ভাজন করে দাও এবং তাদের কাছেও মোমিন বান্দাদের প্রিয় করে দাও। তিনি বলেন, এরপর এমন কোনো মোমিন বান্দা সৃষ্টি হয়নি, যে আমার কথা শুনেছে অথবা আমাকে দেখেছে অথচ আমাকে ভালোবাসেনি। (মুসলিম : ৬১৭১)।
মায়ের প্রতি আলাদা টান : আবু হুরায়রা (রা.) সর্বদা জ্ঞানচর্চায় মগ্ন থাকতেন। আসহাবে সুফফায় পড়ে থাকতেন। এজন্য ক্ষুৎপিপাসা ছিল তার নিত্য সঙ্গী। প্রচণ্ড ক্ষুধার মধ্যেও তিনি মায়ের কথা ভুলে যাননি। একদিন তিনি মসজিদের দিকে রওয়ানা হলেন। দেখলেন কিছু সাহাবী জটলা বেঁধে আছে। তিনি এগিয়ে গেলেন। ?তারা দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, আবু হুরায়রা কি জন্য এখানে এলে? তিনি বললেন, ক্ষুধায় আর টিকতে পারছি না। বের হলাম দেখি কি হয়! তারা বলল, ও আল্লাহ! আমরাও তো ক্ষুধার কারণে এখানে সমবেত হয়েছি। তখন সবাই মিলে হাজির হলো রাসুল (সা.)-এর দুয়ারে। দয়ার নবী বলে কথা! তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, এ মুহূর্তে তোমরা এখানে? তারা বলল, ইয়া রাসুলুল্লাহ! এই হলো আমাদের হালাত। তখন রাসুল (সা.) খেজুরের থালা হাতে নিয়ে সবার হাতে দুটি করে তুলে দেন। আর বলেন, খেজুর দুটো খেয়ে পানি পান করো। আজ আর সারাদিন তোমাদের ক্ষুধা লাগবে না। আবু হুরায়রা (রা.) হাত পেতে দুটো খেজুর নিলেন। কিন্তু খেলেন মাত্র একটি। অপরটি রেখে দিলেন। রাসুল (সা.) এমনিতেই আবু হুরায়ারাকে অনেক মহব্বত করতেন। বিষয়টি দেখে তিনি দেখে বললেন, আবু হুরায়রা কি করছ? তিনি বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! বাড়িতে মা আছেন। এটা তাকে দেব। রাসুল (সা.) বললেন, না, না। দুটোই তুমি খাও। তোমাকে আমি আরো দুটো দিচ্ছি, তোমার মাকে নিয়ে দেবে। (তবাকাতে ইবনে সাদ ৪/৩২৮, তারীখে ইবনে আসাকির ৫৮/৪৪০)।