একজন ভারতীয় ইসলামি ব্যক্তিত্ব মাহমুদ হাসান দেওবন্দি (১৮৫১-১৯২০)। শায়খুল হিন্দ নামে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। যিনি ইংরেজবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়ার সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ভারত স্বাধীনতার জন্য রেশমি রুমাল আন্দোলনের প্রধান পুরুষ ও মূল পরিকল্পনাকারী। যিনি দারুল উলুমদেওবন্দের প্রথম ছাত্র। তার শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম হলেন কাসেম নানুতুবি ও মাহমুদ দেওবন্দি রহিমাহুমাল্লাহ। সুফিবাদে তিনি হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি ও মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহির অনুসারী। তার প্রধান ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী, মাওলানা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি, মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি, মাওলানা কেফায়াতুল্লাহ দেহলভি, মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধি, মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানি, মাওলানা আজিজুর রহমান উসমানি ও মাওলামা ইলিয়াস কান্ধলভি প্রমুখ।
জন্ম ও পরিচয় : শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান ১৮৫১ সালে (বর্তমানে ভারতের উত্তরপ্রদেশ) বেরেলি শহরের দেওবন্দের উসমানি বংশীয় এক সুফি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা জুলফিকার আলি দেওবন্দি ছিলেন দারুল উলুম দেওবন্দের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বেরেলি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন এবং পরে মাদ্রাসার উপ-পরিদর্শক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
শিক্ষাদীক্ষা : তিনি মিঁয়াজি ম্যাংলোরির কাছে কোরআন এবং আব্দুল লতিফের কাছে ফার্সি অধ্যয়ন করেন। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময় তার পিতা মিরাটে চলে যান এবং তাকে দেওবন্দে পাঠিয়ে দেন। সেখানে তিনি তার চাচা মেহতাব আলীর কাছে দারসে নিজামি পাঠ্যক্রমের ফার্সি ও আরবি সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। তারপর তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের প্রথম ছাত্র হিসেবে মাহমুদ দেওবন্দির কাছে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৮৬৯ সালে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করে কাসেম নানুতুবির কাছে সিহাহ সিত্তাহ অধ্যয়ন করতে তিনি মিরাটে গমন করেন। সেখানে তিনি দুই বছর হাদিস অধ্যয়ন করেন। ১৮৭২ সালে দাওরায়ে হাদিস (স্নাতক) সমাপ্ত করার পর ১৮৭৩ সালে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রথম সমাবর্তনে সম্মাননা পাগড়ি লাভ করেন।
কর্মজীনের সূচনা : শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর ১৮৭৩ সালে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৮৯০ সালে তিনি সদরুল মুদাররিস হিসেবে পদোন্নতি পান। তিনি দেওবন্দ মাদরাসাকে শুধু একটি দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মনে করতেন না, বরং ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের ক্ষতি পূরণের জন্য প্রতিষ্ঠিত এক প্রতিষ্ঠান মনে করতেন।
দারুল উলুম দেওবন্দ : ১৮৭৮ সালে বুদ্ধিভিত্তিক কেন্দ্র হিসেবে সামরাতুত তারবিয়াত নামে একটি সংগঠন চালু করেন। যার উদ্দেশ্য ছিল দারুল উলুমদেওবন্দের শিক্ষার্থী ও স্নাতকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। পরবর্তীতে এটি জমিয়তুল আনসারে রূপ নেয়। ১৯০৯ সালে আহমদ হাসান আমরুহীর সভাপতিত্বে মোরাদাবাদে অনুষ্ঠিত প্রথম সম্মেলনের মাধ্যমে যা কর্মক্ষেত্রে পদার্পণ করে। তিনি হাতে গড়া ছাত্র উবায়দুল্লাহ সিন্ধিকে সঙ্গে নিয়ে ১৯১৩ সালের নভেম্বর মাসে নাযারাতুল মাআ’রিফ আল কুরআনিয়া শুরু করেন। আলেমদের প্রভাব বৃদ্ধি এবং ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানদের ইসলামি শিক্ষা প্রদান করাই ছিল এই সংগঠনের উদ্দেশ্য।
রেশমি রোমাল আন্দোলন : ভারতের জমিন থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান করতে মুহাম্মদ মিয়া মনসুর আনসারিকে সঙ্গে নিয়ে রেশমি রুমাল আন্দোলনের সূচনা করেন। তিনিই ছিলেন এই আন্দোলনের মূল নায়ক। প্রথম সারিতে কাজ করা মহান ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন- মাওলানা আব্দুল গাফফার খান, মাওলানা আব্দুর রহিম সিন্ধি, মাওলানা মুহাম্মদ মিয়া মনসুর আনসারি, মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধি এবং মাওলানা উজাইর গুল পেশাওয়ারির মতো তার অন্যান্য ছাত্র ও সঙ্গীরা। দ্বিতীয় সারিতে কাজ করেছেনÍ মাওলানা মুখতার আহমদ আনসারি, মাওলানা আব্দুর রহিম রায়পুরী এবং মাওলানা আহমদুল্লাহ পানিপতি। কাজের সুবিধার্থে মহেন্দ্র প্রতাপকে রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করে মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধি ও তার সাথী-সঙ্গীরা ভারতের অস্থায়ী সরকার গঠন করেন।
মাল্টার বন্দী জীবন : জার্মান এবং তুরস্কের সমর্থন লাভের জন্য ১৯১৫ সালে তিনি হেজাজ ভ্রমণ করেন। ১৮ অক্টোবর তিনি মক্কায় তুরস্কের গভর্নর গালিব পাশা এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী আনোয়ার পাশার সাথে বৈঠক করার সময় গালিব পাশা তাকে সহায়তার আশ্বাস দিয়ে তিনটি চিঠি দেন। একটি ভারতীয় মুসলমানদের উদ্দেশ্যে, দ্বিতীয়টি গভর্নর বুসরা পাশাকে এবং তৃতীয়টি আনোয়ার পাশাকে। তিনি সিরিয়র গভর্নর জামাল পাশার সাথেও বৈঠক করেন এবং জামাল গালিব পাশার বক্তব্যে একমত হন। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, ভারতে ফিরে এলে ব্রিটিশরা তাকে গ্রেপ্তার করতে পারে। সেজন্য তাকে আফগান সীমান্তে পৌঁছিয়ে দিতে বলেন। সেখান থেকে তিনি ইয়াগিস্তানে চলে যাবেন।
কিন্তু একদল গাদ্দারের সক্রিয় ভূমিকায় রেশমি রুমাল আন্দোলন ফাঁস হয়ে যায় এবং এর সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি এবং মাওলানা উজাইর গুল পেশোয়ারির সঙ্গে শরিফ হুসাইন তাকে গ্রেপ্তার করে। যে তুর্কিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ব্রিটিশের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে। শরিফ তাদেরকে ব্রিটিশের হাতে তুলে দেয়। ফলে মাল্টার ভারডালা দুর্গে তাদের কারারুদ্ধ করা হয়।
পুনরায় খিলাফত আন্দোলনে : দীর্ঘ ৩ বছর ৪ মাস নির্মম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মাঝে মাল্টার অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে বন্দিজীবন কাটিয়ে ১৯২০ সালের ২০ মার্চ মাল্টা থেকে ছাড়া পেয়ে স্বদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। দীর্ঘ ৩ মাস পর বোম্বাই বন্দরে পৌঁছেন। বোম্বাইয়ে তখন খিলাফত কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। স্বদেশের আযাদীর চেতনা তাদের এতই প্রবল ছিল যে, জাহাজ থেকে নেমেই সরাসরি খিলাফত কনফারেন্সে যোগদান করেন। মাওলানা আব্দুল বারি ফিরিঙ্গি মহল্লী, হাফেজ মুহাম্মদ আহমদ, মাওলানা কেফায়াতুল্লাহ দেহলভি, শওকত আলি ও মহাÍা গান্ধী সহ প্রধান রাজনৈতিক ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা তাকে স্বাগত জানান। তার মুক্তি খিলাফত আন্দোলনের জন্য একটি বিশাল সাহায্য হিসেবে দেখা হয়। সেদিন খিলাফত কমিটি তাকে ‘শায়খুল হিন্দ’ (ভারতবর্ষের নেতা) খেতাবে ভূষিত করেন।
জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ : ১৯২০ সালের নভেম্বর মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের দ্বিতীয় সাধারণ সভায় সভাপতিত্ব করেন।এই সভায় তিনি জমিয়তের সভাপতিও নিযুক্ত হন। অসুস্থতার কারণে তিনি সে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। ১৯ নভেম্বর থেকে শুরু করে তিন দিনব্যপী সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। তার ছাত্র শাব্বির আহমদ উসমানি তার পক্ষ থেকে উচ্চস্বরে সভাপতির ভাষণ পাঠ করেন। তিনি হিন্দু-মুসলিমণ্ডশিখ ঐক্যের পক্ষ সমর্থন করে বলেন, ‘হিন্দু ও মুসলমানরা যদি ঐক্যবদ্ধ হয়, তবে স্বাধীনতা অর্জন করা খুব বেশি কঠিন নয়’। এটিই ছিল তার সর্বশেষ সম্মেলন।
অন্তিম লগ্নে শায়খুল হিন্দ : আলিগড়ে জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া প্রতিষ্ঠার একদিন পর মাওলানা মুখতার আহমদ আনসারির অনুরোধে তিনি দিল্লি যান। কয়েকদিন পরে তার স্বাস্থ্যের অবনতি হয় এবং দরিয়াগঞ্জে আনসারির বাড়িতে থেকে তিনি চিকিৎসা নেন। ১৯২০ সালের ৩০ নভেম্বর দিল্লিতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর খবর শুনে হিন্দু-মুসলমান সবাই তাদের দোকানপাট বন্ধ করে এসে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে আনসারির বাড়ির বাইরে জড়ো হন। একাধিকবার তার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। দিল্লির লোকেরা আনসারির বাড়ির বাইরে তার জানাজার নামাজ পড়েন। দিল্লি রেলস্টেশনে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর লোক জড়ো হওয়ায় আরেকটি জামাত হয়। পরবর্তীতে মিরাট সিটি রেলওয়ে স্টেশন এবং মিরাট ক্যান্ট রেলস্টেশনেও জানাজার জামাত হয়। শেষ জানাযার নামাজের ইমামতি করেন তার ভাই হাকিম মুহাম্মদ হাসান। প্রিয় উস্তাদ কাসেম নানুতবির পাশে কবরস্থ হওয়ার ইচ্ছায় তাকে মাকবারায়ে কাসেমিতে সমাহিত করা হয়।
মরেও অমর : তার বেশ কয়েকটি সম্মাননা রয়েছে। আশরাফ আলী থানভী তাকে ‘শায়খুল আলম’ (বিশ্বের নেতা) বলে অভিহিত করেন। হযরত থানভী বলেন, ‘আমাদের মতে তিনি ভারত, সিন্ধু, আরব ও অনারবের নেতা’। সাহারানপুরের একটি মেডিকেল কলেজের নাম রাখা হয় শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান মেডিকেল কলেজ। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় তার রেশমি রুমাল আন্দোলনের একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেন।
লেখক : শিক্ষার্থী, ফতোয়া ও ইসলামি আইন গবেষণা বিভাগ, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা