ইসলামে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। শিক্ষাই একটা জাতির আলোকোজ্জ্বল ভিত্তি। মানুষের মধ্যে আল্লাহ প্রদত্ত যেসব গুণাবলি রয়েছে তার বিকাশ ঘটে শিক্ষার মাধ্যমে। অজানাকে জানা। অচেনাকে চেনা মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানার্জন করতে হলে শিক্ষা অপরিহার্য। সেই অপরিহার্য শিক্ষাকে সুশিক্ষায় রূপ দিতে আদর্শ শিক্ষকের বিকল্প নেই। প্রকৃত অর্থে শিক্ষকরাই জ্ঞান অর্জনের কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিটি মানুষ তার শিক্ষকের কাছেই জ্ঞানার্জন করে। শিক্ষক থেকে আহরিত জ্ঞানই মানুষকে যথার্থ শক্তি, শান্তি ও মুক্তির পথনির্দেশ দিতে পারে। সে গুণে গুণান্বিত সর্বসেরা আদর্শ শিক্ষক ছিলেন রাসুল (সা.)। যিনি উম্মতকে ছোট থেকে ছোট বিষয়ের শিক্ষা দিয়েছেন। তাই তিনি ঘোষণা করেছিলেন, নিশ্চয়ই আমি শিক্ষক হিসেবেই প্রেরিত হয়েছি। (ইবনে মাজাহ : ৪৪)।
রাসুল (সা.) শ্রেষ্ঠ শিক্ষক : মুহাম্মদ (সা.) গোটা মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ শিক্ষকরূপে এই ধরায় আগমন করেছিলেন। তিনি ছিলেন আদর্শ শিক্ষক, যার শিক্ষা-দীক্ষা মাত্র ২৩ বছরের সংক্ষিপ্ত সময়ে জ্ঞানের আলোকিত মশাল হয়ে সমগ্র আরব উপদ্বীপকে আলোকিত করেছে। পাল্টে দিয়েছে তাদের বর্বরতাকে মানবতায়। তিনি সমগ্র পৃথিবীর জন্য কল্যাণ ও হেদায়াতের এমন এক মশাল প্রজ্জ্বলিত করেছেন, যা কেয়ামত পর্যন্ত আগত মানব ও জীন জাতিকে ইনসাফ, সুখ-শান্তি, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির আলোকোজ্জ্বল পথ দেখাবে। অতি সংক্ষিপ্ত সময়ে মহানবী (সা.) আরবে অনারবে যে বিস্ময়কর বিপ্লব সাধন করেছেন তার অপ্রতিরোধ্য গতি ও ব্যাপকতা দেখে বিস্মিত ও চিন্তিত হয়েছে সেসব লোকও, যারা তার সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের এবং তার এই কল্যাণময় মিশনের কঠোরবিরোধী ছিল। এটা তার শিক্ষারই বিস্ময়কর প্রভাব ছিল। এই অতি সামান্য সময়ে আরব মরুর অশিক্ষিত ও বর্বর জাতি; যারা ছিল এক সময়ে শিক্ষা-দীক্ষা, তাহজিব-তামাদ্দুন, সভ্যতা ও ভদ্রতা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ, সেই তারাই সমগ্র জাহানে প্রজ্জ্বলিত করেছেন শিক্ষা-দীক্ষা, সভ্যতাণ্ডভদ্রতা ও সামাজিকতার পরিশীলিত শিষ্টাচারের দ্বীপ্তিময় মশাল। তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ধন্য হয়েছেন সাহাবায়ে কেরাম। যাদের যে কারো অনুসরণে রয়েছে উম্মতে মুহাম্মদির পথচলার নির্দেশিকা ও হেদায়াতের পাথেয়। তাই রাসুল (সা.) তাদের ব্যাপারে বলেন, ‘ নিশ্চয় আমার সাহাবিরা আকাশের তারকার মতো তোমরা তাদের যে কারো অনুসরণ করলে হেদায়াত তথা সঠিক পথনির্দেশনা পাবে।
শিক্ষা বিস্তারে রাসুল (সা.) : মহানবী (সা.)-এর আগমনের আগে আরবে ছিল সীমাহীন মূর্খতার যুগ। সে যুগকে জাহিলি যুগ হিসেবে ডাকা হতো। অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত জাতি তখন হেন কোনো কাজ ছিল যা করেনি। এমনকি মেয়ে সন্তানদের জীবন্ত পুঁতে ফেলত। রাসুল (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সুফফা’ নাম বিশেষ শিক্ষাকেন্দ্র চালু করেন। এতে বেশির ভাগ ওইসব মুসলমান অবস্থান করতেন, যারা যাবতীয় পার্থিব ক্রিয়া-কর্ম থেকে মুক্ত হয়ে দিন-রাত ইবাদত ও জ্ঞানার্জনে মগ্ন থাকতেন। মহানবী (সা.) শিক্ষক ও শিক্ষার প্রতি যে অনুরাগী ছিলেন এবং শিক্ষকদের মূল্যায়ন করতেন-এর প্রমাণ নিম্নে বর্ণিত হাদিস থেকে আমরা তার শিক্ষা পাচ্ছি। নবী (সা.) একদিন মসজিদে গেলেন। মসজিদে তখন দুটি মজলিস চলছিল : একটি হচ্ছে জিকিরের মজলিস, অন্যটি পাঠদানের। নবী (সা.) পাঠদান তথা জ্ঞানচর্চার মজলিসটিতে বসলেন এবং মন্তব্য করলেন, আমাকে শিক্ষকরূপে প্রেরণ করা হয়েছে। (মিশকাত, কিতাবুল ইলম পর্ব)। এভাবে উদ্দীপনামূলক তাঁর নানান উক্তি ও কর্মের মাধ্যমে শিক্ষার ব্যাপকতা লাভ করে।
শিক্ষা বিস্তারে রাসুল (সা.)-এর পদক্ষেপের অনেক উদাহরণ রয়েছে। এরমধ্যে বদরের যুদ্ধের সময়কার নজির অন্যতম। দ্বিতীয় হিজরি ১৭ রমজান শুক্রবার বদরের যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এই যুদ্ধে পরাজিত ৭০ জন কাফিরকে বন্দি করে মদিনায় আনা হয়। এসব বন্দির প্রত্যেকের মুক্তিপণ হিসেবে অর্থ জরিমানার নিয়ম ছিল। রাসুল (সা.) বদরের যুদ্ধবন্দিদের ক্ষমা করেন এবং তাদের মুক্তিপণ গ্রহণ করেন। যেরকম ধনী ও বিত্তবান ছিল তার মুক্তিপণও ছিল সেই অনুপাতে। যার দেওয়ার মতো কিছুই ছিল না, তাকে বিনা পণেই মুক্তি দেয়া হয়। মোটের ওপর কুরাইশরা তাদের বহু বন্দিকেই মুক্তিপণের মাধ্যমে মুক্ত করে; কিন্তু তাদের মধ্যে এমন কিছুসংখ্যক বন্দিও ছিল, যাদের মুক্তিপণ দেওয়ার মতো কিছু ছিল না। তাদের ব্যাপারেও তিনি সিদ্ধান্ত নেন, তারা আনসারদের শিশুদের লেখাপড়া শেখাবে। (মুসনাদে আহমদ, ১ম খ., ২৪৭ পৃ.) একজন বন্দি দশজন মুসলিমকে লেখাপড়া শেখাবে ঠিক করে দেওয়া হয়। (তাবাকাত ইবন সা’দ, ২য় খ., ১৪ পৃ.) যায়দ ইবনে ছাবিত (রা.) এভাবেই লেখাপড়া শিখেছিলেন। এই নির্দেশে জ্ঞান অর্জনকে যতখানি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং লেখাপড়া শেখাকে যতটা উৎসাহিত করা হয়েছে তা সূর্যের মতো উজ্জ্বল সবার কাছে।
শিক্ষক হিসেবে যেমন ছিলেন : জীবনে চলার পথে একজন মুমিনের আদর্শ হবে রাসুল (সা.)। সর্বক্ষেত্রেই তার অনুসরণ-অনুকরণ করে চলবে। তার সুন্নতের পুরোপুরি পাবন্দি করবে। আর এটাই আল্লাহতায়ালার নির্দেশ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসুলের অনুসরণের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আহজাব : ২১)। এ আয়াত থেকে এ কথা প্রমাণিত হয়, মুমিনের আদর্শ হবে একমাত্র রাসুল (সা.)। তিনি ছাড়া অন্য কেউ মুমিনের আদর্শ বা আইডল নন। যেকোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই তাকে বিবেচনা করা হোক না কেন! তার চেয়ে উত্তম আদর্শ আর কেউ হতে পারে না। আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য পিতৃতুল্য। তোমাদের আমি দ্বীন শিক্ষা দিয়ে থাকি। তোমাদের কেউ পায়খানায় গেলে কেবলামুখী হয়ে বসবে না এবং কেবলার দিকে পিঠ দিয়েও বসবে না। আর ডান হাত দিয়ে শৌচকার্য সম্পাদন করবে না। তিনি ঢিলা ব্যবহারের নির্দেশ দিতেন এবং গোবর ও হাড় দ্বারা শৌচকার্য সম্পাদন করতে নিষেধ করতেন।’ (সুনানে আবু দাউদ : ৮)। রাসুল (সা.) হলেন মোমিনের জন্য পিতৃতুল্য। অর্থাৎ একজন পিতা যেমন তার সন্তানদের বিভিন্ন আদব-শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়ে থাকেন, ঠিক তেমনই রাসুল (সা.) ও আমাদের মাসআলা-মাসায়েল, ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব ইত্যাদি বিষয়াবলি শিক্ষা দেন। এমনকি মলমূত্র ত্যাগ ও টয়লেট নির্বাচনে স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিও তিনি শিক্ষা দিতেন।
হাদিসে শিক্ষক রাসুল (সা.) : হাদিস শরিফে রাসুল (সা.)-এর শিক্ষাদানের সুনিপুণ পদ্ধতি ফুটে উঠেছে চমৎকারভাবে। একজন শিক্ষকের মধ্যে কী কী গুণাবলি থাকা উচিত। কোনো কোনো বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে শিক্ষক তরবিয়ত দিবেন। হাদিসে এসব বিষয়ের কিছু নমুনা আমরা দেখব, মুআবিয়া ইবনে হাকাম (রা.) বর্ণনা করেন, একদা আমি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে নামাজরত ছিলাম। হঠাৎ এক ব্যক্তি (নামাজের মধ্যে) হাঁচি দিল। প্রতিউত্তরে আমি ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বললাম। লোকজন তখন আমার দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে। আমি বলে উঠলাম, আপনাদের কী হয়েছে? আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছেন কেন? লোকজন তাদের উরুতে হাত চাপড়িয়ে আমাকে শান্ত ও চুপ হতে ইঙ্গিত করল। আমি চুপ হয়ে গেলাম। রাসুল (সা.) সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করলেন। আমার পিতামাতা তাঁর প্রতি উৎসর্গিত হোন, তার মতো এত উত্তম ও সুন্দর শিক্ষাদানকারী কোনো শিক্ষক তার আগেও কাউকে দেখিনি এবং তার পরেও দেখিনি। আল্লাহর কসম! তিনি আমাকে না প্রহার করলেন, না তিরস্কার করলেন, না ধমক দিলেন; তিনি বললেন, আমাদের এই নামাজ মানুষের কথাবার্তার উপযোগী নয়। (অর্থাৎ নামাজে এ ধরনের কথা বলা যায় না।) বরং এ তো হল তাসবিহ, তাকবির ও তেলাওয়াতে কোরআন। (মুসলিম : ৫৩৭)। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, নবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই মানুষ তোমাদের অনুসারী হবে। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন দ্বীন শেখার জন্য তোমাদের কাছে আগমন করবে। যখন তারা আগমন করবে, তোমরা তাদের হিতকাঙ্ক্ষী হবে এবং তাদের সদুপদেশ দিবে। (তিরমিজি : ২৬৫০)। আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, তোমরা শিক্ষাদান কর, সহজ ও কোমল আচরণ কর; কঠোর আচরণ কর না। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাক। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাক। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাক (এ কথা তিনবার বললেন)। (মুসনাদে আহমদ : ২৫৫৬)। রাসুল (সা.)-এর শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল মানবিক ও বাস্তবিক জীবন ঘনিষ্ঠ। মানুষের মৌলিক অধিকার অর্জন, অজ্ঞতা দূরকরণ, জীবনের বিবিধ প্রয়োজন পূরণ ও চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধন এবং বান্দা ও রবের মাঝে প্রেমের সেতু বন্ধন রাসুলের শিক্ষাদানের অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল। যা যুগ যুগ ধরে আলোকিত সমাজ ও ব্যক্তিত্ব গঠনে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখবে।
লেখক : আলেম শিক্ষক ও মিডিয়াকর্মী