নবীজির প্রিয় মুয়াজ্জিন

শরিফ আহমাদ

প্রকাশ : ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

হজরত বেলাল (রা.) একজন বিখ্যাত সাহাবী। তিনি মসজিদে নববীর প্রধান মুয়াজ্জিন ছিলেন। ইসলামের জন্য তিনি অকথ্য জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছেন। ঈমানের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তিনি পৃথিবীর মানুষকে ত্যাগ এবং ধৈর্যের নমুনা উপহার দিয়েছেন। তার জীবনের অংশবিশেষ উলে¬খ করা হলো।

জন্ম ও পরিচয় : হজরত বেলাল (রা.) ৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা রাবাহ ছিলেন একজন ক্রীতদাস। তার মাতা হামামাহ ছিলেন বর্তমান ইথিওপিয়ার একজন রাজকুমারী। আসহাবুল ফিলের ঘটনায় তাকে বযন্দ করে দাসী বানানো হয়। বনু জুমাহ ছিল তাদের মনিব। হজরত বেলাল (রা.) ছোটবেলা থেকে প্রচুর পরিশ্রমী ছিলেন। অনুগত গোলাম হিসেবে যথেষ্ট সুনাম ছিল তার।

ইসলাম গ্রহণে নির্যাতন ভোগ : হজরত বেলাল (রা.)-এর বাহ্যিক রং কালো হলেও হৃদয় ছিল স্বচ্ছ। আর চরিত্র ছিল ফুলের মতো পবিত্র। রাসুল (সা.)-এর মুখে তাওহিদের বাণী শুনে ইসলাম গ্রহণ করেন। নির্ভয়ে ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সর্বপ্রথম যারা তাদের ইসলাম গ্রহণ করার কথা প্রকাশ করেন তারা হলেন ৭ জন। রাসুল (সা.), আবু বকর, আম্মার, তার মা সুমাইয়া, সুয়াইব, বেলাল ও মিকদাদ (রা.) অতঃপর রাসুল (সা.) কে আল্লাহপাক তাঁর চাচা আবু তালিবের মাধ্যমে হেফাজত করেন। আবু বকর (রা.) কে আল্লাহতায়ালা তাঁর স্বগোত্রীয় লোকদের মাধ্যমে হিফাজত করেন। আর অন্যান্যদের মুশরিকরা পাকড়াও করে এবং তাদের লোহার জামা পরিধান করিয়ে প্রখর রোদের মাঝে চিত করে শুইয়ে দিত। তাদের মাঝে এমন কেউ ছিল না, যাকে তারা তাদের ইচ্ছানুসারে নির্মম অত্যাচার করেনি। তবে হজরত বেলাল (রা.) নিজেকে আল্লাহর রাস্তায় সঁপে দিয়েছিলেন এবং লোকেরা তাকে অপমানিত করেছিল। তারা তাকে পাকড়াও করে বালকদের হাতে তুলে দিয়েছিল। তারা তাকে নিয়ে মক্কার অলিগলিতে ঘুরে বেড়াত। আর তিনি শুধু আহাদ, আহাদ। (আল্লাহ এক, আল্লাহ এক) বলতেন। (ইবনে মাজা : ১৫০) হজরত বেলাল (রা.) ছিলেন উমাইয়্যা ইবনে খালফের গোলাম। অত্যাচারী উমাইয়্যা নিত্যনতুন কলাকৌশল প্রয়োগ করে তাকে কষ্ট দিত। আবু বকর সিদ্দিক (রা.) মোটা অংকের বিনিময়ে তাকে ক্রয় করে আজাদ করে দেন।

জাতির শ্রেষ্ঠ মুয়াজ্জিন : রাসুল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম মদিনায় হিজরত করার পর মুসল্লির সংখ্যা বৃদ্ধি পেল। তখন রাসুল (সা.) সাহাবীদের সঙ্গে নামাজের আহ্বান পদ্ধতি সম্পর্কে পরামর্শ করেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আব্দুল্লাহ ইবনে জায়েদ (রা.)-এর স্বপ্নের মাধ্যমে হয়। জনৈক ফেরেশতা তাকে স্বপ্নে আজান ইকামাত শিক্ষা দেন। বেলাল (রা.) খুব স্পষ্টভাষী, উঁচু আওয়াজ এবং সুমিষ্ট স্বরের অধিকারী হওয়ার জন্য মুয়াজ্জিন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কৃতিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব গ্রহণ প্রসঙ্গে আব্দল্লাহ ইবনে জায়েদ (রা.) বর্ণনা করেন যে, সকাল হলে আমি রাসুল (সা.)-এর কাছে আসলাম এবং তাকে আমার স্বপ্নের কথা বললাম। তিনি বললেন এটি নিশ্চয়ই সত্য স্বপ্ন। তুমি বিলালের সঙ্গে দাঁড়াও। তার আওয়াজ তোমার চেয়ে উচ্চ এবং দীর্ঘ। তোমাকে স্বপ্ন যা বলে দেওয়া হয়েছে তাকে তা বলে দাও। সে সেই ভাবে ডাক দিবে। আব্দুল্লাহ ইবনে জায়েদ (রা.) বলেন, উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) যখন নামাজের জন্য বিলালের এই ডাক শুনতে পেলেন, তখন তিনি তার ইজার টানতে টানতে রাসুল (সা.)-এর কাছে ছুটে এলেন। বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন সেই সত্তার কসম! বেলাল যেভাবে ডাক দিয়েছেন আমিও তা স্বপ্ন দেখেছি। রাসুল (সা.) বললেন, আল্লাহর প্রশংসা আর এই যথোপযুক্ত পদ্ধতি। (আবু দাউদ : ৪৯৯, তিরমিজি : ১৮৯)।

সম্মান ও গৌরবের মুকুট : বেলাল (রা.) সম্মান ও গৌরবের মুকুট অর্জন করেছিলেন । রাসুল (সা.) জান্নাতে তার পদচারণার আওয়াজ শুনেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী কারিম (সা.) একদিন ফজরের নামাজের সময় বেলাল (রা.) কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে বেলাল!

ইসলাম গ্রহণের পর সর্বাধিক আশাব্যঞ্জক যে আমল তুমি করেছ তার কথা আমার কাছে ব্যক্ত করো। কেন না, জান্নাতে আমি আমার সামনে তোমার পাদুকার আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। বেলাল (রা.) বললেন, দিন-রাতের যে কোনো প্রহরে আমি তাহারাত ও পবিত্রতা অর্জন করেছি, তখন ওই সে তাহারাত দ্বারা (তাহিয়্যাতুল অজুর ) নামাজ আদায় করেছি, যে পরিমাণ নামাজ আদায় করা আমার তাকদিরে লেখা ছিল। আমার কাছে-এর চাইতে (অধিক) আশাব্যঞ্জক হয়, এমন কোনো বিশেষ আমল আমি করিনি। (বোখারি : ১০৮২) বেলাল (রা.) সাহাবীদের কাছে প্রিয় পাত্র ছিলেন। সবাই তাকে হৃদয় থেকে ভালোবাসতেন। নেতা হওয়ার স্বীকৃতি দিয়েছেন। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, উমর (রা.) বলতেন, আবুবকর (রা.) আমাদের নেতা এবং মুক্ত করেছেন আমাদের আর একজন নেতা বেলাল (রা.) কে। (বোখারি : ৩৪৮২)।

প্রকৃত এক আশেকে রাসুল : বেলাল (রা.) একজন প্রকৃত আশেকে রাসুল ছিলেন। রাসুল (সা.) ওফাতের পর মদিনায় বসবাস করা, তার স্থান শূন্য দেখা ভীষণ কষ্টকর ছিল। বুকে শূন্যতা অনুভব করছিলেন সদা। এজন্য তিনি অবশিষ্ট জীবন জিহাদে কাটিয়ে দেওয়ার মনস্থ করেন। তিনি আবুবকর (রা.)-এর কাছে গিয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসুলের খলিফা! আমি শুনেছি মোমিনদের সবচেয়ে উত্তম আমল হলো আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। অতএব, আমি মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় থাকার নিয়ত করেছি। তিনি বললেন, হে বেলাল আমি তোমাকে আল্লাহর, আমার ইজ্জতের ও আমার হকের দোহাই দিয়ে বলছি, আমার বয়স অধিক হয়ে গিয়েছে, আমার শক্তি কমে গিয়েছে এবং আমার মৃত্যুর সময় নিকটবর্তী হয়ে গিয়েছে। এজন্য তুমি যেও না। তখন তিনি তার সঙ্গে থাকতে লাগলেন। আবুবকর (রা.)-এর ইন্তেকালের পর খলিফা উমর (রা.) কাছে গিয়ে তিনি জিহাদে যাওয়ার অনুমতি কামনা করেন। তিনি আবুবকর (রা.)-এর মতো উত্তর দিলেন। কিন্তু বেলাল (রা.) বিরত থাকতে অস্বীকার করলেন। তখন উমর (রা.) বললেন, আজান দেওয়ার জন্য কাকে নির্ধারণ করব? তিনি বললেন, সাদ (রা.) কে। কারণ তিনি রাসুল (সা.)-এর যুগে কোবাতে আজান দিতেন। সুতরাং উমর (রা.) সা’দ (রা.) কে আজান দেওয়ার জন্য নিযুক্ত করে দিলেন এবং এই ফয়সালা দিলেন যে, তার পর তার বংশধররা আজান দিবে। (তাবারানী, হায়াতুস সাহাবা : ২/১০৬) খলিফার অনুমতি ক্রমে তিনি সিরিয়া অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। সেখানকার সবুজ, শস্য-শ্যামল ভূমি তার ভীষণ পছন্দ হয়। খাওলান নামক শহরে তিনি বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়ে বসতি স্থাপন করেন। প্রকৃত এই রাসুল প্রেমিক ২ মার্চ ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে, হিজরী ২০ সনে প্রায় ৬০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। দিমাশকের বাবুস সাগীরের কাছে তাকে দাফন করা হয়।