মানব জন্মের সূচনা হতে নিয়ে সমাপ্তি পর্যন্ত যত মানুষ পৃথিবীতে আগমন করেছেন, করছেন ও করবেন- তাদের সবার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব, মাহাত্ম্য, পূর্ণতা, সফলতা, মহানুভবতা, গুণ, বৈশিষ্ট্য ও মান-মর্যাদার বিবেচনায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকে এমন কতিপয় গুণ ও বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছিলেন, যেগুলোর মাধ্যমে তিনি স্বতন্ত্র মর্যাদায় উন্নীত হয়ে মানবজাতির সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়ে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছিলেন। আল্লাহতায়ালা বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ও বিশেষণে বিশেষিত করেছিলেন, যেগুলো ইহ ও পরকালে অন্যসব নবী রাসুলের ওপর তার মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের জানান দেয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এমন কতিপয় বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করা হয়েছিল যেগুলোর মাধ্যমে তিনি অন্য সব নবী, রাসুল ও মানুষের ওপর স্বতন্ত্র মর্যাদা লাভ করেছিলেন। আমরা এখানে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য তুলে ধরছি।
ঈমান আনয়ন ও সাহায্যের অঙ্গীকার গ্রহণ : হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে নিয়ে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম পর্যন্ত যত নবী ও রাসুল পৃথিবীর বুকে আগমন করেছিলেন তাদের সকলের কাছ থেকে আল্লাহতায়ালা এই মর্মে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, তোমাদের জীবদ্দশায় যদি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীতে আগমন করেন, তাহলে তোমরা তার প্রতি ঈমান আনয়ন করবে ও তাকে সাহায্য করবে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া অন্য কোনো নবী ও রাসুলের প্রতি ঈমান আনয়ন ও তাকে সাহায্যকরণের জন্য নবী-রাসুলগণের কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়নি। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান আনয়ন ও তাকে সাহায্যকরণের প্রতিশ্রুতি গ্রহণের ব্যাপারে মহাগ্রন্থ আল কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর আল্লাহ যখন নবীগণের কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন যে, আমি যা কিছু তোমাদের দান করেছি কিতাব ও জ্ঞান, অতঃপর তোমাদের কাছে কোন রাসুল আসেন, তোমাদের কিতাবকে সত্য বলে দেওয়ার জন্য, তখন সে রাসুলের প্রতি ঈমান আনয়ন করবে ও তাকে সাহায্য করবে। তিনি বললেন, ‘তোমার কি অঙ্গীকার করছ এবং এই শর্তে আমার ওয়াদা গ্রহণ করে নিয়েছ? তারা বলল, ‘আমরা অঙ্গীকার করেছি’। তিনি বললেন, তাহলে এবার সাক্ষী থাক। আর আমিও তোমাদের সঙ্গে সাক্ষী রইলাম।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৮১)
চিরন্তন মুজেজা আল কোরআন প্রদান : মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগে যত নবী ও রাসুল আগমন করেছিলেন তাদের সকলের মাধ্যমেই মুজেজা (অভ্যাস পরিপন্থি অলৌকিক বিষয়) প্রকাশ পেয়েছিল। তবে সেসব মুজেজা ছিল ক্ষণিকের ও অল্প সময়ের। কিন্তু বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চিরন্তন মুজেজা আল কোরআন প্রদান করা হয়েছে। এই মুজেজা চিরকালের ও দীর্ঘ সময়ের। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ করে একে সংরক্ষণ করার দায়িত্ব নিজের জিম্মায় নিয়েছেন। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগে আগমনকারী নবী ও রাসুলগণের ওপর যেসব ধর্মগ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছিল সেগুলো বিকৃত, পরিবর্তিত ও রহিত হয়ে গিয়েছে। মানুষের পক্ষ থেকে সেগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের হ্রাস ও বর্ধন ঘটানো হয়েছে। সেসব আসমানি কিতাবে নানা প্রকার বাতিল বিষয় অনুপ্রবেশ করেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সেগুলোর আবেদন হারিয়ে গিয়েছে। কার্যকরিতা লোপ পেয়েছে। কেন না, সেসব কিতাব সংরক্ষণ করার দায়িত্ব মহান আল্লাহ নিজের জিম্মায় নেননি। কিন্তু মহাগ্রন্থ আল কোরআনকে সংরক্ষণ করার দায়িত্ব আল্লাহতায়ালা নিজের স্কন্ধে নিয়েছেন। এ মর্মে কোরআন শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।’ (সূরা হিজর, আয়াত : ০৯)।
বিশ্ববাসীর রাসুল : মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া অন্য যত নবী ও রাসুল পৃথিবীর বুকে আগমন করেছিলেন তারা সবাই নির্দিষ্ট কোনো জাতি, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে সত্যের পথ প্রদর্শন করার জন্য আগমন করেছিলেন। তাদের নবুয়ত ও রিসালত বিশেষ কোনো জাতি ও সম্প্রদায়ের জন্য নির্ধারিত ছিল। কিন্তু বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ধরাপৃষ্ঠে নির্ধারিত কোনো জাতি বা গোষ্ঠীকে ইসলামের পথ প্রদর্শন করার জন্য প্রেরিত হননি। বরং তার নবুয়তকাল থেকে নিয়ে কেয়ামত পর্যন্ত যত জাতি, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় পৃথিবীতে আগমন করবে, যত মানুষ ও জিন জন্মগ্রহণ করবে তিনি তাদের সকলের নবী ও রাসুল। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্যে সুসংবাদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি।’ (সুরা সাবা, আয়াত : ২৮) আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া অন্য কোনো নবী বা রাসুল সমগ্র বিশ্বের জিন ও মানুষের নবী ও রাসুল ছিলেন না। একটি হাদিসে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব বৈশিষ্ট্যের একটি হলো আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদা ও কালো নির্বিশেষে বিশ্ববাসী সবার রাসুল। হযরত জাবির ইবনু আবদুল্লাহ আল আনসারি (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমাকে এমন পাঁচটি বিশেষ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য দান করা হয়েছে, যা অন্যকোনো নবীকে প্রদান করা হয়নি। প্রত্যেক নবীকে শুধু তার স্বজাতির জন্য পাঠানো হতো। কিন্তু আমাকে সাদা ও কালো সবার জন্য নবী করে পাঠানো হয়েছে। আমার জন্য যুদ্ধলব্ধ অর্থ-সম্পদ হালাল করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমার আগে আর কারো জন্য তা হালাল ছিল না। আমার জন্য গোটা পৃথিবী পাক, পবিত্র ও মসজিদ করে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং নামাজের সময় হলে যে কোনো লোক যে কোনো স্থানে নামাজ আদায় করে নিতে পারে। আমাকে এক মাসের পথের দূরত্ব পর্যন্ত অত্যন্ত শান শওকত সহকারে সাহায্য করা হয়েছে। আর আমাকে শাফাআতের সুযোগ দান করা হয়েছে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১০৫০)।
আল্লাহর দরবারে নিমন্ত্রণ : পৃথিবীতে যত নবী ও রাসুল শুভাগমন করেছেন তাদের মধ্য হতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া অন্য কাউকে আল্লাহতায়ালা নিজের দরবারে আমন্ত্রণ জানিয়ে সম্মানিত করেননি। কিন্তু শুধু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই অনন্য বৈশিষ্ট্য যে, আল্লাহতায়ালা তাকে আপন দরবারে নিমন্ত্রণ জানিয়ে নিজের নিদর্শনাবলি দেখিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। বড় কোন রাজা, বাদশাহ বা উচ্চতম পদণ্ডপদবির অধিকারী কোনো অভিজাত সত্তার দরবারে নিমন্ত্রিত হয়ে গমন করা নিশ্চয়ই সম্মানজনক ও গৌরবপূর্ণ। আর মহাপরাক্রমশালী, শাহানশাহ ও রাজাধিরাজ আল্লাহতায়ালার দরবারে যদি কেউ আহূত হয়, তাহলে তা কত সম্মানজনক ও মর্যাদাপূর্ণ তা ভাবতেও পুলক লাগে। এই মহা গৌরবের শিরোমুকুট শুধু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই পরিধান করেছিলেন। ঊর্ধ্বাকাশে ভ্রমণ করার প্রাক্কালে তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস তথা মসজিদে আকসায় সকল নবী ও রাসুলের ইমামতি করেছিলেন। এরপর ঊর্ধ্বজগৎ ভ্রমণ করার সময় সপ্তাকাশ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই ঐতিহাসিক ভ্রমণ প্রসঙ্গে আল কোরআনে এসেছে, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যান্ত-যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি যাতে আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ০১) বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তায়ালার মহামহিম দরবারে নিমন্ত্রিত হয়ে জান্নাত, জাহান্নাম, সিদরাতুল মুনতাহা, আরশে আজিম ও লৌহ কলমসহ আশ্চর্যজনক ও বিস্ময়কর সব নিদর্শনাবলি অবলোকন করেছিলেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় সে তাকে আরেকবার দেখেছিল, সিদরাতুল মুন্তাহার নিকটে, যার কাছে অবস্থিত বসবাসের জান্নাত। যখন বৃক্ষটি দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়ার, তদ্দ¡ারা আচ্ছন্ন ছিল। তার দৃষ্টিবিভ্রম হয়নি এবং সীমালংঘনও করেনি। নিশ্চয় সে তার পালনকর্তার মহান নিদর্শনাবলি অবলোকন করেছে।’ (সুরা নাজম, আয়াত : ১৩-১৮)।
প্রশংসিত স্থানে অধিষ্ঠিতকরণ : আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জান্নাতে এমন এক মর্যাদাপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত করবেন, যেখানে তার বান্দাদের মধ্য থেকে আর কেউ অধিষ্ঠিত হতে পারবে না। এই মর্যাদাপূর্ণ স্থানে শুধু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই অধিষ্ঠিত হবেন। এ সম্মানজনক স্থানকে আরবিতে ‘মাকামে মাহমুদ’ বলা হয়। বাংলায় এর অনুবাদ ‘প্রশংসিত স্থান’। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাকামে মাহমুদ বা প্রশংসিত স্থানে অধিষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে আল কোরআনে এসেছে, ‘রাত্রির কিছু অংশ কোরআন পাঠসহ জাগ্রত থাকুন। এটা আপনার জন্যে অতিরিক্ত। হয়তো বা আপনার পালনকর্তা আপনাকে মাকামে মাহমুদে পৌঁছাবেন।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৭৯) বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাকামে মাহমুদ বা প্রশংসিত স্থানে অধিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি হাদিস দ্বারাও প্রমাণিত। হযরত ইবনু উমর (রা.) বলেন, নিশ্চয়ই কেয়ামতের দিন লোকেরা ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়বে। প্রত্যেক নবীর উম্মত স্বীয় নবীর অনুসরণ করবে। তারা বলবে, হে অমুক নবী! আপনি সুপারিশ করুন। হে অমুক নবী! আপনি সুপারিশ করুন। কেউ সুপারিশ করতে চাইবেন না। শেষ পর্যন্ত সুপারিশের দায়িত্ব নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর পড়বে। আর এ দিনেই আল্লাহতায়ালা তাকে মাকামে মাহমুদে পৌঁছাবেন।’ (বোখারি : ৪৭১৮)।
সুপারিশ করার যোগ্যতম মহামানব : কেয়ামতের অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ ও বিভীষিকাময় হবে। কেয়ামতের সেই ভয়ংকর ও ভীতিপূর্ণ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে মানুষ হতাশা ও নিরাশায় বিচলিত হয়ে পড়বে। তখন তারা এমন একজন যোগ্যতম মহামানবকে খোঁজ করবে, যিনি আল্লাহতায়ালার কাছে সুপারিশ করে তাদের কেয়ামতের ভীতিপ্রদ অবস্থা হতে মুক্তি দান করতে পারেন। লোকেরা বিভিন্ন নবীর কাছে যাবে, কিন্তু তারা কেউই সুপারিশ করতে রাজি হবেন না। শেষ পর্যন্ত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুপারিশ করার যোগ্যতম মহামানব বলে স্বীকৃত হবেন। লোকেরা তার কাছে সুপারিশ করার আবেদন জানালে তিনি আল্লাহতায়ালার কাছে সুপারিশ করার জন্য সম্মত হবেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আনাস (রা.) বলেন, আমাদের কাছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন, কেয়ামাতের দিন মানুষ সমুদ্রের ঢেউয়ের মত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে। তাই তারা আদম (আ.)-এর কাছে এসে বলবে, আমাদের জন্য আপনার পালনকর্তার কাছে সুপারিশ করুন। তিনি বলবেন, এ কাজের যোগ্য আমি নই, বরং তোমরা ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে যাও। কারণ তিনি হলেন আল্লাহর খলিল। তখন তারা ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে আসবে। তিনি বলবেন, আমি এ কাজের যোগ্য নই, বরং তোমরা মুসা (আ.)-এর কাছে যাও। কারণ তিনি আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছেন। তখন তারা মুসা (আ.)-এর কাছে আসবে। তিনি বলবেন, আমি এ কাজের উপযুক্ত নই। তোমরা ঈসা (আ.)-এর কাছে যাও। কারণ তিনিই আল্লাহর রূহ ও বাণী। তখন তারা ঈসা (আ.)-এর কাছে আসবে। তিনি বলবেন, আমি এ কাজের যোগ্য নই। তোমরা বরং হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যাও। এরপর তারা আমার কাছে আসবে। আমি বলব, আমিই এ কাজের যোগ্যতম ব্যক্তি। আমি তখন আমার রবের কাছে অনুমতি চাইব। আমাকে অনুমতি দেওয়া হবে। আমাকে প্রশংসাসূচক বাক্য ইলহাম করা হবে যা দিয়ে আমি আল্লাহর প্রশংসা করব, যেগুলো এখন আমার জানা নেই। আমি সেসব প্রশংসা বাক্য দিয়ে প্রশংসা করব এবং সেজদায় পড়ে যাবো। তখন আমাকে বলা হবে, ইয়া মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। তুমি বলো, তোমার কথা শোনা হবে। চাও, দেওয়া হবে। সুপারিশ কর, গ্রহণ করা হবে। তখন আমি বলব, হে আমার প্রতিপালক! আমার উম্মত! আমার উম্মত!! বলা হবে, যাও, যাদের হৃদয়ে যবের দানা পরিমাণ ঈমান আছে, তাদের জাহান্নাম থেকে বের করে দাও। আমি গিয়ে এমনই করব। তারপর আমি ফিরে আসব এবং পুনরায় সেসব প্রশংসা বাক্য দ্বারা আল্লাহর প্রশংসা করব এবং সেজদায় পড়ে যাব। তখন বলা হবে, হে মুহাম্মদ! মাথা উঠাও। তোমার কথা শোনা হবে। চাও, দেওয়া হবে। সুপারিশ কর, গ্রহণ করা হবে। তখনো আমি বলব, হে আমার রব! আমার উম্মত! আমার উম্মত! তখন বলা হবে, যাও! যাদের এক অণু কিংবা সরিষা পরিমাণ ঈমান আছে তাদের জাহান্নাম থেকে বের কর। আমি গিয়ে তাই করব। আমি আবার ফিরে আসব এবং সেসব প্রশংসা বাক্য দিয়ে আল্লাহর প্রশংসা করব। আর সেজদায় পড়ে যাব। আমাকে বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। বল, তোমার কথা শোনা হবে। চাও, দেওয়া হবে। সুপারিশ কর, গ্রহণ করা হবে। আমি তখন বলবো, হে আমার রব্ব, আমার উম্মত! আমার উম্মত! এরপর আল্লাহ বলবেন, যাও, যাদের অন্তরে সরিষার দানার চেয়েও অতি ক্ষুদ্র পরিমাণ ঈমান আছে, তাদের জাহান্নাম থেকে বের করে আন। আমি যাব ও তাই করব।’ (সহিহ বোখারি, হাদিস : ৭৫১০)।
সর্বশেষ নবী : আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সকল নবী ও রাসুলকে নবুয়ত ও রিসালতের যে দায়িত্ব ও বার্তা দিয়ে এই ধরাপৃষ্ঠে প্রেরণ করেছিলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করার মাধ্যমে তা পূর্ণ করে দিয়েছেন। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের আগে যত নবী ও রাসুল আগমন করেছিলেন তাদের পর আরো নবী ও রাসুল আগমন করার সুযোগ ছিল। কিন্তু বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেরিত হবার মাধ্যমে নবুয়ত ও রিসালতের এই ধারার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। তাই হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর আর কোনো নবী ও রাসুলের আগমন ঘটবে না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে। এ মর্মে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত : ৩) হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী মর্মে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘মুহাম্মাদ তোমাদের কোনো ব্যক্তির পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসুল ও শেষ নবী। আল্লাহ সব বিষয়ে জ্ঞাত।’ (সুরা আহযাব, আয়াত : ৪০) স্বয়ং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও নিজেকে সর্বশেষ নবী বলে আখ্যায়িত করে তার পর আর কোনো নবী ও রাসুলের আগমন না ঘটার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি এবং আমার পূর্ববর্তী নবীগণের অবস্থা এমন, এক ব্যক্তি যেন একটি গৃহ নির্মাণ করল; তাকে সুশোভিত ও সুসজ্জিত করল, কিন্তু এক পাশে একটি ইটের জায়গা খালি রয়ে গেল। অতঃপর লোকজন এর চারপাশে ঘুরে আশ্চর্য হয়ে বলতে লাগল ওই শূন্যস্থানের ইটটি লাগানো হলো না কেন? নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমিই সে ইট। আর আমিই সর্বশেষ নবী।’ (বোখারি : ৩৫৩৫)।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা-১২১১