মহান আল্লাহ কেয়ামতের আগে দাজ্জালকে প্রেরণ করবেন। সে এসেই পৃথিবীতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করবে। ধোঁকা ও প্রতারণায় মানুষের ঈমানের ছিনিয়ে নেবে। তার ভয়াবহ ফেতনা সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, হজরত আদম (আ.) থেকে কেয়ামত কায়েম হাওয়া পর্যন্ত দাজ্জালের ফেতনা অপেক্ষা কোনো ফেতনা বৃহত্তর নয়। (মুসলিম : ২৯৪৬) সে হবে ইহুদিদের স্বপ্নের নায়ক। একত্রে ৭০ হাজার ইহুদি তার আনুগত্য মেনে নেবে। রাসুল (সা.) তার ফেতনা থেকে সতর্ক ছিলেন। উম্মতের জন্য দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন। দাজ্জাল সম্পর্কে জ্ঞান রাখা সবার জন্য জরুরি।
যুগে যুগে দাজ্জালের কথা : হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, পৃথিবীতে যত নবী রাসুল প্রেরিত হয়েছেন. তারা সবাই নিজ নিজ উম্মাতকে মিথ্যাবাদী কানা দাজ্জাল সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। দাজ্জাল কানাই হবে। আর তোমাদের রব অবশ্যই কানা নন। আর দাজ্জালের দুচোখের মাঝখানে লেখা থাকবে কাফিরুন। (বোখারি : ৬৫৯৮)।
দাজ্জালের গঠন আকৃতি : হজরত ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুল (সা.) বলেছেন, আমি নিদ্রিত অবস্থায় দেখতে পেলাম যে আমি কাবার তাওয়াফ করছি। হঠাৎ একজন লোককে দেখতে পেলাম ধূসর বর্ণের আলু থালু কেশধারী, তার মাথা থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে কিংবা টপকে পড়ছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইনি কে? লোকেরা বলল, ইনি মারিয়ামের পুত্র। এরপর আমি তাকাতে লাগলাম। হঠাৎ দেখতে পেলাম এক ব্যক্তি স্থূলকায়, লাল বর্ণের কোকড়ানো চুল তার, এক চোখ কানা। চোখটি যেন ফোলা আঙ্গুরের মতো। লোকেরা বলল, এ হলো দাজ্জাল। তার সঙ্গে অধিকতর সাদৃশ্যপূর্ণ লোক হলো ইবনে কাতান, বনি খুজায়ার এক ব্যক্তি। (বোখারি : ৬৬৪৩)।
দাজ্জাল কেয়ামতের আলামত : হজরত হুজাইফা ইবনে আসিদ আল গিফারি ( রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমরা আলোচনা করছিলাম। এমতাবস্থায় রাসুল (সা.) আমাদের কাছে আসলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন তোমরা কি নিয়ে আলোচনা করছ? তারা বললেন, আমরা কেয়ামত সম্পর্কে আলোচনা করছি। তখন তিনি বললেন, কেয়ামত কায়েম হবে না, যতক্ষণ না তোমরা ১০টি বিশেষ নিদর্শন দেখবে। অতঃপর তিনি ধুম্র, দাজ্জাল, পশ্চিম দিগন্ত থেকে সূর্য উদিত হওয়া, মারইয়াম তনয় ঈসা (আ.)-এর অবতরণ, ইয়াজুজ মাজুজ এবং তিনবার ভূমিধসে যাওয়া অর্থাৎ পূর্ব প্রান্তে একটি ভূমিধস, পশ্চিম প্রান্তে একটি ভূমিধস এবং আরব উপদ্বীপে একটি ভূমিধসের কথা উল্লেখ করলেন। এ নিদর্শনসমূহের পর এক আগুন প্রকাশিত হবে, ইয়ামান থেকে এবং মানুষকে তাড়িয়ে হাশরের ময়দানের দিকে নিয়ে যাবে। (মুসলিম : ৭০২১)।
দাজ্জাল এখন কোথায়? : হজরত ফাতেমা বিনতে কায়েস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে দাজ্জালের অবস্থানের কথা বর্ণিত হয়েছে। দীর্ঘ হাদিসের সারাংশ হলো, একদিন নামাজ শেষে রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত তামিম দারী (রা.)-এর সঙ্গে ঘটিত ঘটনা বর্ণনা করেন। তারা নৌ ভ্রমণে বের হয়ে ঘটনাচক্রে একটা দ্বীপে উপনীত হয়েছিল। সেখানে দাজ্জাল এবং তার গুপ্তচরের সঙ্গে কথোপকথন হয়েছিল। হাদিসের শেষাংশে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, মনে রেখো দাজ্জাল শাম কিংবা ইয়ামানের কোনো সাগরে নেই। সে আগের কোনো এক স্থানে আছে। এ কথাটি তিনি তিনবার বলেছেন। (মুসলিম : ৭১১৯)।
দাজ্জাল কোথায় আত্মপ্রকাশ করবে : হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সা.) আমাদের বলেছেন, দাজ্জাল পূর্বাঞ্চলীয় কোনো স্থান থেকে বের হবে। স্থানটির নাম হলো খোরাসান। কিছু কওম তার অনুসরণ করবে। তাদের চেহারা হবে স্তর বিশিষ্ট ঢালের মত। (তিরমিজি : ২২৩৭)।
দাজ্জাল চেনার সহজ উপায় : রাসূলুল্লাহ বলেছেন, তার চোখের উপর নখ পরিমাণ মোটা চামড়া থাকবে, চক্ষুদ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে লেখা থাকবে কাফের। প্রত্যেক শিক্ষিত ও অশিক্ষিত মোমেন তা পড়তে পারবে। (মুসলিম : ২৯৩৪)।
দাজ্জালের নিষিদ্ধ এলাকা : হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মক্কা মদিনা ছাড়া পৃথিবীর সমস্ত জনপদে দাজ্জাল বিচরণ করবে। কেন না, এই দুই শহরের প্রতিটি রাস্তায় ফেরেশতারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে পাহারাদারিতে নিয়োজিত থাকবে। অবশেষে দাজ্জাল মদিনার নিকটবর্তী এক স্থানে অবতরণ করবে। তখন মদিনাতে তিন বার ভূকম্পন হবে। যার ফলে প্রত্যেক মুনাফিক ও কাফির মদিনা থেকে বের হয়ে তার কাছে চলে যাবে। (মুসলিম : ৭১২৩)।
দাজ্জালের আগুন পানির রহস্য : হজরত হুজাইফা ইবনে ইয়ামান (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যখন দাজ্জাল আভির্ভূত হবে তার সাথে পানি ও আগুন থাকবে। কিন্তু মানুষ যাকে পানি দেখবে সেটা হবে দহনশীল আগুন। আর যেটাকে মানুষ আগুন দেখবে, সেটা হবে সুমিষ্ট ঠান্ডা পানি। কাজে তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ সময়কাল পায়, সে যেন দৃশ্যত যাকে আগুন দেখা যাচ্ছে তাতে প্রবেশ করে। কেন না, প্রকৃতপক্ষে সেটাই হবে সুপেয় সুমিষ্ট পানি। (মুসলিম : ৭১০৩)।
দাজ্জালের জান্নাত জাহান্নাম : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুল (সা.) বলেছেন, আমি দাজ্জাল সম্পর্কে তোমাদের এমন বিষয় বলতে যাচ্ছি, যা কোনো নবী তার উম্মতকে আজ পর্যন্ত বলেননি। শোনো, দাজ্জাল কানা হবে এবং তার সঙ্গে জান্নাত ও জাহান্নামের প্রতিকৃতি ন্যায় কিছু বস্তু থাকবে। সে যেটিকে জান্নাত বলবে, সেটি (আসলে হবে) জাহান্নাম। দেখো, দাজ্জালের ব্যাপারে আমি তোমাদের সতর্ক করছি। যেমন নূহ (আ.) তার সম্প্রদায়কে ভীতি প্রদর্শন করেছিলেন। (মুসলিম : ৭১০৫)।
দাজ্জালের দখলে খাদ্য পানীয় : হজরত মুগিরা ইবনে শুবা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী করীম (সা.) কে দাজ্জাল সম্পর্কে যত বেশি প্রশ্ন করতাম, সেরূপ আর কেউ করেনি। তিনি আমাকে বললেন, তার থেকে তোমার কি ক্ষতি হবে? আমি বললাম, লোকেরা বলে যে তার সাথে রুটির পাহাড় ও পানির নহর থাকবে! তিনি বললেন, আল্লাহর কাছে তা অতিতুচ্ছ। (বোখারি : ৬৬৩৭)।
দাজ্জালের ভয়ে মানুষের পলায়ন : উম্মে শারিক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবীজি (সা.) কে বলতে শুনেছি যে, লোকেরা দাজ্জালের ভয়ে পাহাড়ে পালিয়ে যাবে। একথা শুনে উম্মু শারিক (রা.) বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! সেদিন আরবের লোকেরা কোথায় থাকবে? উত্তরে তিনি বলেন, তখন তারা সংখ্যায় কম হবে। (মুসলিম : ৭১২৬)।
দাজ্জালের অনুসারী নারী পুরুষ : হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুল (সা.) বলেছেন, দাজ্জাল এসে জুরুফের এক অনুর্বর লবণাক্ত ভূমিতে অবতরণ করবে এবং এখানেই সে তার শিবির স্থাপন করবে। যার ফলে প্রত্যেক মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক মহিলা তার কাছে চলে যাবে। (মুসলিম : ৭১২৪)।
দাজ্জাল ইহুদিদের স্বপ্ন-পুরুষ : হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ইস্পাহানের ৭০ হাজার ইহুদি দাজ্জালের অনুসারী হবে। তাদের গায়ে থাকবে সবুজ বর্ণের চাদর বা জুব্বা। (মুসলিম : ৭১২৫)।
দাজ্জালের রাজত্বের মেয়াদ : হজরত নাওয়াস ইবনে সামআন (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসুল (সা.) দাজ্জাল পৃথিবীতে কতদিন অবস্থান করবে? উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ৪০ দিন পর্যন্ত। এর প্রথম দিনটি এক বছরের সমান। দ্বিতীয় দিন এক মাসের সমান এবং তৃতীয় দিন এক সপ্তাহের সমান হবে। অবশিষ্ট দিনগুলো তোমাদের দিনসমূহের মতোই হবে। (মুসলিম : ৭১০৬)।
দাজ্জালের নিহত হওয়ার স্থান : হজরত মুজাম্মা ইবনে জারিয়া আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, ইবনে মারিয়াম (ঈসা আ.) দাজ্জালকে লুদণ্ডএর ফটকে হত্যা করবেন। (তিরমিজি : ২২৪৪)।
দাজ্জাল থেকে বাঁচার আমল : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সা.) এই দোয়া করতেন, আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন আজাবিল কাবরি, ওয়া মিন আজাবিন্নারি, ওয়া মিন ফিতনাতিল মাহইয়া ওয়াল মামাতি, ওয়া মিন ফিতনাতিল মাসিহিদ্দাজ্জাল। (বোখারি : ১৩৭৭)।