নবীদের রোজা পালন
জুনাইদ ইসলাম মাহদি
প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মানুষের হেদায়াতের জন্য যুগে যুগে নবী রাসুল এসেছেন পৃথিবীতে। মানুষকে আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়ার সব পথ ও পদ্ধতি বাতলে দিয়ে উম্মতকে চির শান্তির নিবাস জান্নাতের পথে এগিয়ে নিতে নবীরা ছিলেন বার্তাবাহক। আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়ার কিছু আমল আছে। যা যুগে যুগে চলমান ছিল। সেসব গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলোর মধ্যে রোজা একটি। রোজা প্রত্যেক যুগেই ছিল। প্রত্যেক নবীর শরিয়তে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে রোজা পালিত হত। নবীদের রোজা পালন কেমন ছিল- এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো :
আদি পিতা আদম (আ.) এর যুগে রোজা : আদি পিতা আদম (আ.) ও তার সন্তানরাও ৩০ রোজা রাখতেন। হাদিসের গ্রন্থাদির তথ্য মতে এমনটাই জানা যায়। ফতহুল বারি কিতাবে উদ্ধৃত হয়েছে, হজরত আদম আলাইহিস সালাস যখন আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে জান্নাতের ফল খেয়েছিলেন, তখন তিনি দীর্ঘ ৩০ দিনব্যাপী তওবা করেছিলেন। ৩০ দিন পর আল্লাহতায়ালা তার তওবা কবুল করেন। এরপর থেকে তার সন্তানদের জন্য ৩০টি রোজা ফরজ করে দেয়া হয়।
নুহ নবীর রোজা : নুহ আলাইহিস সালাম ছিলেন দুনিয়ার প্রথম রাসুল। তার আগে আর কেউ রাসুল ছিলেন না। নুহ (আ.)-এর সময়েও রোজার প্রচলন ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘ নুহ আলাইহিস সালাম শাওয়াল মাসের ১ তারিখ এবং জিলহজ মাসের ১০ তারিখ ছাড়া সারা বছর রোজা রাখতেন।’ (ইবনে মাজাহ)।
মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম নবীর যুগে রোজা : নুহ নবীর পর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ নবী ছিলেন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম। আল্লাহতায়ালা তাকে খলিল তথা অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেন। গ্রহণযোগ্য বিভিন্ন ইলমি উৎসের সূত্রে জানা যায়, তার যুগেও ৩০টি রোজা রাখা আবশ্যক ছিল।
তার পরের যুগকে বলা হতো বৈদিক যুগ। সে ধারাবাহিকতায় বেদের অনুসারী ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যেও ব্রত তথা উপবাস প্রথা চালু ছিল। তারা প্রত্যেক হিন্দি মাসের ১১ তারিখে ব্রাহ্মণদের ওপর একাদশী’র উপবাস করত।
মুসা আলাইহিস সালামের রোজা : মুসা নবী আল্লাহর প্রেরিত বিখ্যাত রাসুলদের একজন। আল্লাহতায়ালা তার ওপর তাওরাত কিতাব নাজিল করেন। তিনি ফেরাউনের সময়ের নবী ও রাসুল ছিলেন। আল্লাহতায়ালা তার প্রতি আসমানি কিতাব ‘তাওরাত’ নাজিল করার আগে ৪০ দিন রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। হজরত মুসা আলাইহিস সালাম তুর পাহাড়ে রোজা পালনে ক্ষুধা ও পিপাসায় ৪০ দিন অতিবাহিত করেছিলেন। সে হিসেবে মুসা আলাইহিস সালামের অনুসারীরা ৪০ দিন পর্যন্ত রোজা পালনকে উত্তম বলে বিবেচনা করতেন। ৪০তম দিনে রোজা রাখাকে তারা ফরজ মনে করতেন। আর সেটা ছিল তাদের সপ্তম মাসের (তাশরিন) দশম তারিখ। এ দশম দিন ছিল তাদের কাছে আশুরা। এ আশুরার দিনে আল্লাহতায়ালা হজরত মুসা আলাইহিস সালামকে ১০টি বিধান দান করেছিলেন। এ কারণেই তাওরাতে ১০ তারিখ রোজা পালনের জন্য জোর তাগিদ দেওয়া হয়। এছাড়াও ইয়াহুদিদের অন্যান্য ছহিফাগুলোতেও অন্যান্য দিনে রোজা পালনের হুকুম পাওয়া যায়।
দাউদ নবীর রোজা : দাউদ (আ.) ছিলেন একজন প্রতাপশালী নবী। তিনি বাদশা ছিলেন। তার ছিল রাজকীয় অবস্থান। হজরত মুসা আলাইহিস সালামের পর আসমানি কিতাবের অধিকারী ছিলেন তিনি। তার যুগেও ছিল রোজার প্রচলন। তিনি একদিন পর একদিন রোজা রাখতেন। (বোখারি ও মুসলিম)। সে হিসেবে তিনি বছরের অর্ধেক সময় রোজা রেখে অতিবাহিত করতেন।
হাদিসের কিতাবগুলোতে রোজার অধ্যায়ে দাউদ (আ.)-এর এক দিন পরপর রোজা রাখার এ নিয়ম বর্ণিত হয়েছে খুব প্রশংসার সঙ্গে।
ঈসা নবীর রোজা : আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগে নবী ও রাসুল হিসেবে ঈসা নবী পৃথিবীতে এসেছিলেন। তার প্রতি ইঞ্জিল কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে। খ্রিষ্টানরা আজকাল যাকে বাইবেল বলে।
তিনি নিজেকে আসমানি কিতাবের ধারক হিসেবে তৈরি করতে কিতাব নাজিল হওয়ার আগে দীর্ঘ ৪০ দিন পর্যন্ত তিনি রোজা রেখেছিলেন। ৪০ দিন রোজা পালনের পর আল্লাহতায়ালা তাকে আসমানি গ্রন্থ ইঞ্জিল দান করেন। রোজা আত্মাকে শক্তিশালী করে। শরীরকে সতেজ ও মনকে প্রাণবন্ত করে। তাই ইতিহাসে দেখা যায় যে, আসমানি কিতাব নাজিল হওয়ার আগে রোজা রাখার নির্দেশ ছিল নবীদের প্রতি।
ইয়াহইয়া আলাইহিস সালামের রোজা : হজরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম ছিলেন ঈসা আলাইহিস সালামের সমসাময়িক নবী। ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম নিজে রোজা রাখতেন এবং তার অনুসারীগণের মধ্যেও রোজা রাখার রীতি বিদ্যমান ছিল।
ঈসা নবীর বর্ণনায় রোজার গুরুত্ব : ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে তার অনুসারীরা জিজ্ঞেস করতো, আমরা আমাদের অপবিত্র অন্তরগুলোকে পূতঃপবিত্র করতে কী করতে পারি? বা কীভাবে অন্তরগুলোকে অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করতে সক্ষম হব?
ঈসা আলাইহিস সালাম তাদের বলেছিলেন, ‘অন্তরসমূহের কলুষতা ও অপবিত্রতাকে পবিত্র রাখতে রোজা এবং দোয়ার বিকল্প নেই। অন্তর পবিত্র করতে রোজা রাখার নসিহত করেছিলেন তিনি তার অনুসারীদের।
জাহেলিযুগে রোজা : প্রাক ইসলামি যুগে আরববাসীরাও রোজা সম্পর্কে ওয়াকিব হাল ছিল এবং তা পালনে সক্রিয় ছিল। মক্কার কুরাইশরা জাহেলিয়াতের যুগে ১০ মহররম রোজা রাখত। এ দিনে পবিত্র কাবায় নতুন কিসওয়া বা গিলাফ পরিধান করানো হতো। (মুসনাদে আহমদ)। প্রাক ইসলামি যুগে মদিনার ইয়াহুদিরাও পৃথক পৃথকভাবে আশুরার উৎসব ও রোজা পালন করত। (বোখারি) তাদের রোজা পালনের দিনক্ষণ ছিল তাদের নিজেদের গণনার সপ্তম মাসের ১০ম দিন।
কোরআনের ঘোষণা : যুগে যুগে নবী-রাসুল রোজা পালনের মাধ্যমে নিজেদের আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে তৈরি করেছিলেন। এ কারণেই আল্লাহতায়ালা রোজা ফরজ হওয়ার আয়াতে পূর্ববর্তী লোকদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছিল এ কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের ওপর রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেভাবে তোমাদের আগের লোকদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে তোমার পরহেজগার হতে পার।’ (সুরাবাকারা : আয়াত ১৮৩)।
উম্মতে মুহাম্মদির রোজা : আখেরি নবীর উম্মতের জন্য আরবি মাস রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হয়েছে। এর আগে আশুরার রোজা রাখা ফরজ ছিল। রমজানের রোজা ফরজ করার পর আশুরার রোজা রাখা নফল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। হাদিসের কিতাবগুলোতে এর বিশদ বর্ণনা রয়েছে।
রোজা রাখার নিয়ম হলো, সওয়াবের নিয়তে ঈমানের সঙ্গে রোজা রাখা অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা রমজানের রোজা রাখাকে বান্দার জন্য ফরজ করেছেন তা বিশ্বাস রেখে রোজা পালন করা।
মূলত, রোজার নিয়তের সঙ্গে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সম্ভোগ থেকে বিরত থাকাকে রোজা বলে। রোজার মাধ্যমে বান্দা তাকওয়া লাভ করে। দেহমনকে আধ্যাত্মিক শক্তিতে বলীয়ান করে। কুরিপু দমন করে মনুষ্যত্বের বিকাশ ও রবের সন্তুষ্টি লাভ করে প্রিয় বান্দা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করার জন্য মানসিকতা তৈরি করা দীর্ঘ ১ মাস সিয়াম সাধনার অন্যতম লক্ষ্য ও উপকারিতা।