প্রথম রোজার তারাবিতে পঠিত আয়াতের সারকথা

আলী ওসমান শেফায়েত

প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

১১ মার্চ ২০২৪ রোজ সোমবার মাগরিবের পর পশ্চিমাকাশে রমজানের নতুন চাঁদ দেখা যায়। তাই গত সোমবার দিবাগত রাতে শুরু হয় প্রথম রোজার তারাবি নামাজ। সর্বস্তরের মুসলমান পুরুষরা সাধারণত মসজিদে গিয়ে তারাবি নামাজ পড়ে থাকেন। মসজিদগুলোতে কোথাও সুরা তারাবি আবার কোথাও খতমে তারাবি অনুষ্ঠিত হয়। পুরুষরা মসজিদে জামাতের সঙ্গে তারাবি নামাজ পড়া সুন্নতে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়াহ অর্থাৎ কোনো মহল্লার কিছু সংখ্যক পুরুষ জামাতের সঙ্গে তারাবি নামাজ পড়লে তা বাকিদের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে জামাতে উপস্থিত হওয়ার দায়গত দিক থেকে। বাকিরা একাকী ঘরে তারাবি পড়ার কারণে গুনাহগার হবে না। সাধারণত দুই ধরনের তারাবি নামাজ পড়া হয়। সুরা তারাবি ও খতমে তারাবি। সুরা ফিল থেকে নাস পর্যন্ত দশটি সুরা দুই রাকাত দুই রাকাত নামাজে দুইবার পড়ে খুব সহজে বিশ রাকাত তারাবি পড়া যায়। পুরো রমজানে তারাবি নামাজে একবার পূর্ণ কোরআন শরিফ পড়ে খতম করা সুন্নাত। যারা খতমে তারাবি পড়ে তারা সাধারণত প্রতিদিন দেড় পারা নামাজে তিলাওয়াত করে থাকেন। সে হিসেবে প্রথম রোজায় পবিত্র কোরআনের প্রথম পারা এবং দ্বিতীয় পারার প্রথম অর্ধেকাংশ নিয়ে মোট দেড় পারা কোরআন তেলাওয়াত করা হয়। এই দেড় পারায় (সুরা বাকারার ১নং আয়াত থেকে ২০৩ নং আয়াত পর্যন্ত) যা তিলাওয়াত করা হয় তার সারকথা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :

কোরআন মুত্তাকিদের পথপ্রদর্শনকারী : আল্লাহ বলেন, এই সেই কিতাব (কোরআন) যাতে কোনোই সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী পরহেজগারদের জন্য, যারা অদেখা বিষয়ের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং নামাজ প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি তাদের যে রুজি দান করেছি, তা থেকে ব্যয় করে। (সুরা বাকারা : ২, ৩)।

মুনাফেকের আলামত : আর তারা যখন ঈমানদারদের সঙ্গে মিশে, তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি। আবার যখন তাদের শয়তানদের সঙ্গে একান্তে সাক্ষাৎ করে, তখন বলে, আমরা তোমাদের সাথে রয়েছি। আমরা তো (মুসলমানদের সঙ্গে) উপহাস করি মাত্র। (সুরা বাকারা : ১৪)।

নেককারদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ : হে নবী (সা.), যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজগুলো করেছে, আপনি তাদেরকে এমন বেহেশতের সুসংবাদ দিন, যার নিচ দিয়ে নহরগুলো প্রবহমান থাকবে। যখনই তারা খাবার হিসেবে কোনো ফল প্রাপ্ত হবে, তখনই তারা বলবে, এতো অবিকল সে ফলই যা আমরা এরআগেও লাভ করেছিলাম। বস্তুত, তাদের একই প্রকৃতির ফল প্রদান করা হবে এবং সেখানে তাদের জন্য শুদ্ধা সহধর্মিণীরা থাকবে। আর সেখানে তারা অনন্তকাল অবস্থান করবে। (সুরা বাকারা : ২৫)।

সত্য মিথ্যার মিশ্রণ না করা : সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশিয়ে দিও না এবং জানা সত্ত্বেও সত্যকে গোপন করো না। (সুরা বাকারা : ৪২)।

নামাজ ও জাকাত আদায়ের নির্দেশ : নামাজ কায়েম করো, জাকাত আদায় করো এবং নামাজে অবনত হও তাদের সঙ্গে, যারা অবনত হয়। (সুরা বাকারা : ৪৩)।

কেয়ামতের বিচারে ঘুষ চলে না : সে দিনকে (কেয়ামত দিবসকে) ভয় করো, যখন কেউ কারও সামান্য উপকারে আসবে না এবং তার পক্ষে কোনো সুপারিশও কবুল হবে না; কারও কাছ থেকে ক্ষতিপূরণও নেয়া হবে না এবং তারা কোনো রকম সাহায্যও পাবে না। (সুরা বাকারা : ৪৮)। তোমরা ভয় করো সেদিনকে, যে দিন এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তি বিন্দুমাত্র উপকৃত হবে না, কারও কাছ থেকে বিনিময় গৃহীত হবে না, কারও সুপারিশ ফলপ্রদ হবে না এবং তারা সাহায্য প্রাপ্তও হবে না। (সুরা বাকারা: ১২৩)।

বান্দার সব খবর আল্লাহ জানেন : আল্লাহ তোমাদের কাজকর্ম সম্পর্কে বেখবর নন। (সুরা: বাকারা: ৭৪)।

জান্নাত লাভের আমল : যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তারাই জান্নাতের অধিবাসী। তারা সেখানেই চিরকাল থাকবে। (সুরা বাকারাহ : ৮২)।

দীনকে প্রাধান্য না দেওয়ার পরিণতি : এরাই পরকালের বিনিময়ে পার্থিব জীবন ক্রয় করেছে। অতএব এদের শাস্তি লঘু হবে না এবং এরা সাহায্যও পাবে না। (সুরা বাকারা : ৮৬) আপনি তাদের জীবনের প্রতি সবার চাইতে, এমনকি মুশরিকদের চাইতেও অধিক লোভী দেখবেন।

তাদের প্রত্যেকে কামনা করে, যেন হাজার বছর আয়ু পায়। অথচ এরূপ আয়ু প্রাপ্তি তাদের শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না। আল্লাহ দেখেন যা কিছু তারা করে। (সুরা বাকারা : ৯৬)।

দয়া ও রাজত্বের মালিক আল্লাহ : আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিশেষভাবে স্বীয় অনুগ্রহ দান করেন। আল্লাহ মহান অনুগ্রহদাতা। (সুরা বাকারা : ১০৫) আল্লাহর জন্যই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের আধিপত্য। আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোনো বন্ধু বা সাহায্যকারী নেই। (সুরা বাকারা : ১০৭) পূর্ব ও পশ্চিম আল্লারই। অতএব, তোমরা যেদিকেই মুখ ফেরাও, সেদিকেই আল্লাহ বিরাজমান। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ। (সুরা বাকারা : ১১৫)।

বিপথগামী কে? : যে কেউ ঈমানের পরিবর্তে কুফর গ্রহণ করে, সে সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। (সুরা বাকারা: ১০৮)

আল্লাহ সব দেখেন : নামাজ প্রতিষ্ঠা করো ও জাকাত আদায় করো। তোমরা নিজের জন্যে আগে যে সৎকর্ম প্রেরণ করবে, তা আল্লাহর কাছে পাবে। তোমরা যা কিছু করো, নিশ্চয় আল্লাহ তা প্রত্যক্ষ করেন। (সুরা বাকারা : ১১০)।

মসজিদে যে বাধা দেয় : যে ব্যক্তি আল্লাহর মসজিদসমূহে তার নাম উচ্চারণ করতে বাধা দেয় এবং সেগুলোকে উজাড় করতে চেষ্টা করে, তার চাইতে বড় জালেম আর কে? এদের পক্ষে মসজিদসমূহে প্রবেশ করা বিধেয় নয়, অবশ্য ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায়। ওদের জন্য ইহকালে লাঞ্ছনা এবং পরকালে কঠিন শাস্তি রয়েছে। (সুরা বাকারা : ১১৪)।

আল্লাহ আসমান জমিনের স্রষ্টা : তিনি নভোমন্ডল ও ভূমণ্ডলের উদ্ভাবক। যখন তিনি কোনো কার্য সম্পাদনের সিন্ধান্ত নেন, তখন সেটিকে একথাই বলেন, ‘হয়ে যাও’ তৎক্ষণাৎ তা হয়ে যায়। (সুরা বাকারা : ১১৭)।

মুহাম্মদ (সা.) ও তার ধর্ম সত্য : নিশ্চয় আমি আপনাকে (রাসূল সা.) সত্যধর্মসহ সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারীরূপে পাঠিয়েছি। (সুরা বাকারা : ১১৯)।

আল্লাহর রঙে রঙিন হওয়ার নির্দেশ : আমরা আল্লাহর রং গ্রহণ করেছি। আল্লাহর রং এর চাইতে উত্তম রং আর কার হতে পারে? আমরা তারই এবাদত করি। (সুরা বাকারা : ১৩৮)। তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ রাখব এবং আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো; অকৃতজ্ঞ হয়ো না। (সুরা বাকারা : ১৫২)।

ধৈর্য ও পরীক্ষা : ধৈর্যের সঙ্গে নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। অবশ্য তা যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু সে সব বিনয়ী লোকদের পক্ষেই তা সম্ভব। (সুরা বাকারা : ৪৫)। হে মোমেনরা! তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চিয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে রয়েছেন। (সুরা বাকারা : ১৫৩)। অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করবো কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের। (সুরা বাকারা : ১৫৫)।

শহীদরা জীবিত : যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদের মৃত বলো না। বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা বুঝ না। (সুরা বাকারা : ১৫৪)।

আল্লাহর লানত কাফেরদের ওপর : নিশ্চয় যারা কুফরী করে এবং কাফের অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করে, সেসব লোকের প্রতি আল্লাহর ফেরেশতাদের এবং সমগ্র মানুষের লানত। (সুরা বাকারা : ১৬১)।

হালাল-হারাম : পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তুসামগ্রী ভক্ষণ করো। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। সে নিঃসন্দেহে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (সুরা বাকারা : ১৬৮)।

তিনি তোমাদের ওপর হারাম করেছেন, মৃত জীব, রক্ত, শুকর মাংস এবং সেসব জীব-জন্তু যা আল্লাহ ব্যতীত অপর কারো নামে উৎসর্গ করা হয়। (সুরা বাকারা : ১৭৩)।

সৎকর্ম ও সৎলোকের পরিচয় : সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমদিকে মুখ করবে। বরং বড় সৎকাজ হলো এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর ওপর, কেয়ামত দিবসের ওপর, ফেরেশতাদের ওপর এবং সব নবী-রাসুলদের ওপর; আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্মীয়-স্বজন, এতিমণ্ডমিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে। আর যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য্য ধারণকারী তারাই হলো সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই পরহেযগার। (সুরা বাকারা : ১৭৭)।

রোজার বিধিবিধান : হে ঈমানদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পারো। (সুরা বাকারা: ১৮৩)। রমজান মাসই হলো সে মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ-যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ, আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোজা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না যাতে তোমরা গণনা পূরণ করো এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহতায়ালার মহত্ত্ব বর্ণনা করো, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো। (সুরা বাকারা : ১৮৫)।

রোজার রাতে তোমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সহবাস করা তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ। আল্লাহ অবগত রয়েছেন যে, তোমরা আত্মপ্রতারণা করছিলে, সুতরাং তিনি তোমাদের ক্ষমা করেছেন এবং তোমাদের অব্যাহতি দিয়েছেন। অতঃপর তোমরা নিজেদের স্ত্রীদের সঙ্গে সহবাস করো এবং যা কিছু তোমাদের জন্য আল্লাহ দান করেছেন, তা আহরণ করো। আর পানাহার করো যতক্ষণ না কালো রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রোজা পূর্ণ করো রাত পর্যন্ত। আর যতক্ষণ তোমরা এতেকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান করো, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সঙ্গে মিশো না। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেওয়া সীমানা। অতএব, এর কাছেও যেও না। এমনিভাবে বর্ণনা করেন আল্লাহ নিজের আয়াতগুলো মানুষের জন্য, যাতে তারা বাঁচতে পারে। (সুরা বাকারা : ১৮৭)।