হে আল্লাহর বান্দারা, আমি নিজেকে এবং আপনাদের আল্লাহকে ভয় করার উপদেশ দিচ্ছি। আল্লাহকে ভয় করুন এবং ভালো ও মন্দ সময়ে তার আনুগত্য করুন। কল্যাণ এবং শুভ পরিণাম লাভ করুন। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, হে ঈমানদাররা, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল, তাহলে তিনি তোমাদের আমল সংশোধন করবেন এবং তোমাদের পাপ ক্ষমা করবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করবে, সে অবশ্যই মহা সাফল্য লাভ করলো। (আল-আহযাব : ৭০-৭১)।
ইবাদতের উদ্দেশ্য : হে মুসলিম জাতি! ইবাদতের আচার-অনুষ্ঠানের সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো, আকিদা-বিশ্বাসগত দিক থেকে সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশুদ্ধ একত্ববাদ পোষণ করা এবং তাঁর প্রতি ভালোবাসার পূর্ণ মাত্রায় উপনীত হওয়া। একমাত্র তাঁর প্রতিই বশ্যতা ও আত্মসমর্পণের দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হওয়া। প্রভু ও উপাসনায় তাঁকে ছাড়া অন্য কারও প্রতি আসক্তি থেকে মুক্ত থাকা। যাতে সমস্ত ইবাদত শুধু এক আল্লাহর প্রতি নিবেদিত হয় এবং সম্পূর্ণরূপে শুধু তাঁর জন্যই হয়। তিনি ছাড়া আর কারো জন্য নয়। প্রভুত্ব তাঁর একার অধিকার; তিনি ওই সত্তা, যার আনুগত্য করা হয়। যার অবাধ্যতা হয় না। কারণ তার প্রতি আছে ভয়-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা নিবেদন এবং আশা-ভরসা ও প্রার্থনা-আবেদন।
তিনি মহামহিম। তিনি ওই সত্তা, যাকেই শুধু ভয় করা হয় এবং যিনি ছাড়া আশা করার মতো কোনো উপাস্য নেই। তিনিই তো সেই সত্তা, কষ্ট ও বিপদকালে যার প্রতি হৃদয় ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধাবিত হয়, দরকারে-প্রয়োজনে শুধু তাঁকেই ডাকে, তাঁর ওপরই নির্ভর করে। সুখে-দুঃখে, স্বচ্ছলতায় ও অস্বচ্ছলতায় হৃদয়-মন তাঁর দিকেই ফিরে, তাঁর স্মরণেই প্রশান্তি লাভ করে এবং তাঁর নৈকট্যে সান্ত¡না পায়।
রোজা ফরজ করার কারণ : রমজানে রোজা রাখা ফরজ করার মধ্যে মহান কিছু ধর্মীয় লক্ষ্য রয়েছে। রোজা বান্দা এবং তার রবের মধ্যে একটি গোপন বিষয়। বান্দা রোজা রাখে একমাত্র আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠভাবে, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা-শ্রদ্ধা নিবেদন করে এবং এর মাধ্যমে প্রতিদান লাভের আশা রাখে। কোরআন ও হাদিসের নুসুস এদিকেই ইঙ্গিত বহন করে। রোজার উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জনের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া, যার মূল হলো একত্ববাদ। মহান আল্লাহ বলেন: হে ঈমানদাররা, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো। (বাকার : ১৮৩)। রোজা সংশ্লিষ্ট পরের আয়াতে আল্লাহ বলেন: এবং (আল্লাহ চান) যাতে তোমরা রোজার সংখ্যা úূর্ণ করে নাও এবং আল্লাহ তোমাদের যেপথ দেখিয়েছেন, সেজন্য আল্লাহর তাকবির পাঠ করো এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (বাকারা : ১৮৫)।
হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ বলেন : ‘আদম সন্তানের প্রতিটি নেক আমল বহুগুণ বর্ধিত হবে। একটি নেক আমল তার সমান ১০ গুণ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বর্ধিত হবে, তবে রোজা ব্যতীত। কেন না, রোজা আমার জন্য রাখা হয় এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব। সে (রোজাদার) আমার জন্য তার কাম-বাসনা এবং তার পানাহার ত্যাগ করে।’ (বোখারি ও মুসলিম)। এই মহান লক্ষ্যের প্রতি সতর্ক করে নবী (সা.) অন্য হাদিসে বলেছেন : ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে এবং সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে, তার আগের সব গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে’। (বোখারি ও মুসলিম)। হে আল্লাহর বান্দারা! ইবাদতের সবচেয়ে বড় লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটি হলো, সর্বোত্তম আচরণের ওপর মানুষকে দীক্ষিত করা এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের লক্ষ্যে সবচেয়ে সুন্দর আচরণে উন্নীত করা। এই শরয়ি লক্ষ্যগুলো মানুষকে বাচনিক ও কার্যত উত্তম অবস্থান ও সুন্দরতম চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধন শেখানোর সঙ্গে বিশেষিত।
মানুষকে কথায় ও কাজে নিখুঁত আচরণের দীক্ষা দেওয়া, যাতে সে তার সমাজের সদস্যদের সঙ্গে এবং সকল সৃষ্টির সঙ্গে তার আচরণে নিষ্কলুষ ও পবিত্র থাকে। যখন ইবাদত করা হয় পরিশুদ্ধ ও পরিমার্জিত মনে এবং সমুদয় ইবাদতের সৌন্দর্য বজায় রেখে কথা ও কাজে পবিত্রতা রক্ষা করা হয়, তখন দ্বীনের নিদর্শনাবলি; ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান মানুষকে সবচেয়ে সুন্দর মূল্যবোধ, শুদ্ধতম কর্ম, বুদ্ধিদীপ্ত উত্তম আচরণ এবং সর্বোত্তম নৈতিকতার ওপর দীক্ষিত ও প্রতিপালিত করে। ফলে মানবসমাজ পুণ্যময় জীবন এবং সন্তুষ্টজনক জীবনপদ্ধতি অর্জন করে।
রোজা রাখার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, রোজা রাসুলের নির্দেশনা দ্বারা আলোকময় হয়।
রোজাদার সর্বোত্তম ও বিশুদ্ধ নৈতিকতা বজায় রাখতে এবং খারাপ ও নিকৃষ্ট আচার-আচরণ থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করে। আর রোজা ফরজ হওয়ার প্রকাশ্য হেকমত ও কারণ হলো, রোজাদারদের এ কথা শিক্ষা দেওয়া ইবাদত-বন্দেগি সৃষ্টিজীবকে কষ্ট দেওয়া এবং তাদের ক্ষতি করা হতে মুক্ত হওয়া। যে কোনো কথা বা কাজের মাধ্যমে সৃষ্টিকুলকে কষ্ট না দেওয়া এবং তাদের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকা। এগুলো সামগ্রিক উদ্দেশ্য, যা ব্যক্তি, সমাজ এবং বিশ্বের সবার জন্য সার্বিক কল্যাণ বয়ে আনে। তখন আমাদের রোজা হবে আমাদের সুন্দর আখলাক এবং শুদ্ধতম আমল লাভের কারণ। মন্দ গুণাবলি থেকে আমাদের রক্ষাকারী। অতএব আসুন, আমরা এই মাসে রোজা ফরজ হওয়ার উচ্চ লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হই এবং এর বিশুদ্ধ ফজিলত দ্বারা সুশোভিত হই। আর মনে রাখি রাসুল (সা.) এর বাণী। তিনি বলেন : ‘যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা বর্জন করে না, মিথ্যাশ্রিত কাজ ছেড়ে দেয় না, ছেড়ে দেয় না অজ্ঞতাও, তার খাদ্য ও পানীয় ত্যাগ করাটা আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বোখারি)।
মিথ্যা কথা বলতে বোঝায়, প্রতিটি নিষিদ্ধ বক্তব্য এবং মিথ্যাশ্রিত আমল দ্বারা বোঝায়, প্রতিটি হারাম কাজকে। মূর্খতাপূর্ণ অজ্ঞতা মানে মানুষকে কষ্ট দিয়ে বড়াই করা। যেমন : মানুষের ওপর জুলুম করা, মিথ্যা বলা, গিবত ও পরচর্চা করা, এসবই মূর্খতার অন্তর্ভুক্ত।
ইবাদতের কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্যের ব্যবহারিক প্রয়োগ হওয়া চাই। যাতে আমরা বাস্তবিকপক্ষেই ইবাদতের বাহ্য ও অভ্যন্তরীণ মাকসাদগুলো লাভ করতে পারি। জীবনযাত্রার পথে এর প্রকৃত মূল্য অনুধাবন করে এর বাস্তবায়ন করতে পারি। যাতে আমরা দুনিয়া ও আখেরাতে সৌভাগ্যবান হতে পারি। শরিয়ত পুরোটাই উত্তম চরিত্র ধারণ করার মতো। আর উত্তম চরিত্র সে তো দ্বীনের সামগ্রিক বিষয়। এমনটাই বলেছেন আলেমগণ। জনৈক আলেম বলেছেন, ‘উত্তম চরিত্রই পূর্ণ দ্বীন। চরিত্রে যে তোমার চেয়ে এগিয়ে দ্বীনের বিষয়ে সে তোমার চেয়ে এগিয়ে। ইবনু তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য হলো চরিত্রের সৌন্দর্য ও পূর্ণতা।
হে মুসলিম জাতি! সিয়াম সাধনার মধ্যদিয়ে তোমরা কাজকর্মের সৌন্দর্য গুণে গুণান্বিত হও। ব্যবহার ও পারস্পরিক আচরণবিধির ক্ষেত্রে সর্বোত্তম চরিত্র দ্বারা সুশোভিত হও। জীবনের সর্বক্ষেত্রে নানান কাজকর্মে এসব গুণাবলির ওপর অবিচল থাক। তাহলে পূর্ণ কল্যাণ ও বিশাল সফলতা লাভ করবে। নবী (সা.) বলেছেন, সিয়াম হলো ঢালস্বরূপ। সুতরাং তোমাদের কেউ যদি রোজাদার হয়, সে যেন অশ্লীল কথা না বলে এবং মূর্খতাসুলভ আচরণ না করে। যদি কোনো লোক তার সঙ্গে ঝগড়া করে বা তাকে গালি দেয়, সে যেন বলে আমি রোজাদার। (বোখারি ও মুসলিম)।
রোজাদারকে ইফতার করানো : হে আল্লাহর বান্দারা! রমজানের রোজার মাকসাদগুলোর মধ্যে একটি হলো, ইহসান প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার জন্য তারবিয়্যত করা এবং বিভিন্নভাবে দানসদকা করা। সুতরাং তোমরা প্রত্যেক কল্যাণকর বস্তু দ্বারা দান কর।
তোমরা সৃষ্টিকূলের প্রতি ইহসান করো, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের প্রতি ইহসান করবেন এবং তোমাদের সওয়াব ও প্রতিদান দেবেন। নবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে রোজাদারের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে। তবে রোজাদারের প্রতিদান থেকে কিছু কমাবে না। (তিরমিজি)। রাসুল (সা.) কল্যাণকর বস্তু অধিক পরিমাণে দান করতেন। রমজানে রাসুল (সা.) অধিক পরিমাণে দান করতেন।
(৫ রমজান ১৪৪৫ হিজরি (১৫-০৩-২০২৪ খ্রি.) তারিখে প্রদত্ত মদিনার মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- মুফতি দিদার শফিক।)