কোরআনুল কারিমের হেদায়াত

আল্লাহর রাস্তায় দান

ড. আবুল হাসান সাদেক

প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

অনুবাদ : (২৬১) যারা নিজ ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে তার উদাহরণ হলো একটা শস্যবীজ, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়, যার প্রত্যেকটি শীষে আছে একশত শস্য-দানা। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বহুগুণে বাড়িয়ে দেন। আল্লাহ হলেন প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। (২৬২) যারা আল্লাহর পথে নিজ সম্পদ ব্যয় করে, অতঃপর এই দানের ব্যাপারে খোঁটা দেয় না এবং কষ্ট দেয় না, তাদের জন্যই তাদের রবের কাছে প্রতিদান রয়েছে। তাদের না আছে দুঃখ, আর না দুশ্চিন্তা।

(২৬৩) যে দানের পর কষ্ট দেয়া হয়, তার চেয়ে একটা ভালো কথা ও ক্ষমা উত্তম। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন, তিনি পরম ধৈর্যশীল। (সুরা বাকারাহ, ২৬১-২৬৩)।

মর্ম ও শিক্ষা : সূরা বাকারায় ঈমান ও আমলসহ পরিবার, সমাজ ও সামষ্টিক জীবনের বিভিন্ন দিক বর্ণিত হয়েছে। দীর্ঘ সূরাটির শেষ পর্যায়ে জাতীয় জীবনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে, আল্লাহর পথে প্রচেষ্টা (জিহাদ) এবং সম্পদ ব্যয়। এখানে এ মর্মে বেশ কয়েকটি আয়াত বিবৃত হয়েছে।

ইসলামের অর্থনৈতিক দর্শন : সম্পদের প্রতিনিধিত্বমূলক মালিকানা : ইসলামের অর্থনৈতিক দর্শন হলো এই যে, ধন-সম্পদসহ দুনিয়ার সবকিছুর মালিক আল্লাহ। তিনি রিয্ক হিসেবে মানুষকে জীবন-ধারণের সকল প্রয়োজনীয় জিনিস দান করেন, যার অন্তর্ভুক্ত হলো ধন-সম্পদ। মানুষকে প্রতিনিধিত্ব ও আমানত-মূলক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, একচ্ছত্র মালিকানা নয় (হাদীদ : ৭)। সূচনাতেই এ বিষয়টির সম্যক উপলব্ধি করতে পারলে উপার্জন ও ব্যয়ের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। উপার্জনের যে বৈধ উপায় দেয়া আছে, তার বাইরে যাওয়া যাবে না। আর ব্যয়ের ক্ষেত্রে ভোগবাদকে অর্থনৈতিক দর্শন হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না।

ভোগবাদ নয়, সামাজিক ও আদর্শিক দায়িত্ব পালনই মূল : পশ্চিমা ভোগবাদ (Consumerism)-এর সারকথা হলো এই যে, ভোগের উদ্দেশ্যেই জীবন, আর সম্পদ হলো ভোগের উপকরণ। ভোগ ছাড়া সম্পদের আর কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই। ইসলামের সাথে ভোগবাদের এখানেই সংঘাত। ইসলামী জীবন-দর্শনে সম্পদসহ দুনিয়ার সবকিছুর উদ্দেশ্য হলো মানব-কল্যাণ। দুনিয়াতেও কল্যাণ, আখিরাতেও কল্যাণ, অর্থাৎ উদ্দেশ্য হলো উভয় জীবনে কল্যাণ। সুতরাং সম্পদ ব্যয়েও দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ বিবেচনায় রাখতে হবে। আর তার সঙ্গে তার জন্য প্রয়োজন নিজের জন্য পরিমিত খরচ এবং সমাজ ও আদর্শিক উদ্দেশ্যে খরচ, যাকে আল্লাহর পথে ব্যয় বলা হয়। আলোচ্য প্রথম আয়াতে আল্লাহর পথে তথা সমাজ ও আদর্শিক খাতে ব্যয়ের ৭০০ গুণ বা তার চাইতে অধিক প্রতিদানের কথা বলা হয়েছে। সামাজিক খাতে ব্যয় হলো- অনাথ-দরিদ্র্য ও অস্বচ্ছলদের দুঃখ লাঘব করার জন্যে দান। আর আদর্শিক খাতে ব্যয় হলো আল্লাহ-প্রদত্ত কল্যাণময় জীবন-ব্যবস্থা এবং সত্য-দ্বীন বাস্তবায়নে সার্বিক প্রচেষ্টা চালানোর জন্য ব্যয় করা। তা না হলে আল্লাহর সম্পদ আল্লাহর কাজে ব্যয় হলো না। কাজেই কেয়ামতের দিন জবাব দিতে হবে।

অর্থ ও সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় এবং আখেরাতের ব্যবসা : অর্জিত সম্পদ বা অর্থ ব্যবহারের চারটি পদ্ধতি আছে। প্রথম, নিজের জন্য ব্যয় করা। দ্বিতীয়, মুনাফার জন্য উৎপাদন বা ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করা (দুনিয়ার অর্থনৈতিক লাভ)। তৃতীয়, আল্লাহর পথে ব্যয় করা (আখেরাতের কল্যাণ)। চতুর্থ, অর্থ-সম্পদ অব্যবহৃত রাখা, অর্থাৎ সম্পদ মজুত রাখা যাতে হ্রাস-বৃদ্ধি বা লাভ-ক্ষতি কিছুই নেই। নিজের জন্য ব্যয়, ব্যবসায়ে বিনিয়োগ, এবং অর্থ-সম্পদ মজুত রাখার বিষয় তো পরিষ্কার। এখানে আল্লাহর পথে ব্যয়ের বিষয়টি ভালোভাবে উপলব্ধি করা উচিত। আলোচ্য প্রথম আয়াতে আল্লাহর পথে ব্যয় করাকে উচ্চফলনশীল কৃষি উৎপাদন আখ্যায়িত করে বলা হয়েছে, এর ফলন ৭০০ গুণ হয় বা তার চেয়েও বেশি হতে পারে। তার মাত্রা নির্ভর করে নিয়্যত ও নিষ্ঠার উপর। অন্যত্র আল্লাহ্ অর্থ-সম্পদ দ্বারা ব্যবসা (অর্থাৎ আখেরাতের জন্য উৎপাদন ও ব্যবসা) করতে বলেছেন, যা ব্যবসায়ীকে কঠিন দোযখের আগুন থেকে রক্ষা করবে। রাসূল (সা.) বলেছেন, মানুষ যা ভোগ করে তা শেষ হয়ে যায়, যা দান করে তা-ই তার জন্য থেকে যায়, আর যা রেখে যায় তা চলে যায় অন্যের হাতে। কাজেই বুদ্ধিমান মানুষের পক্ষে নিজের জন্যও কিছু রাখা প্রয়োজন, যা হলো আখেরাতের ব্যবসা। সুতরাং আখেরাতের ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করা তথা আল্লাহর পথে ব্যয় করা উচিত।

আখেরাতের ব্যবসায়ে লাভ পাওয়ার শর্ত : আলোচ্য আয়াতসমূহে শুধু আল্লাহর পথে ব্যয় তথা আখেরাতের ব্যবসায়ের প্রেরণাই দেয়া হয়নি, বরং সে ব্যবসায়ে লাভ হওয়ার বা সে দান কবুল হওয়ার শর্তও বলা হয়েছে (আয়াত-২৬৫)। এর শর্ত হলো ‘নিষ্ঠার সাথে ও খাঁটি নিয়্যতে (আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য)’ দুস্থ’ মানবতার কল্যাণ ও দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যয় করা, আল্লাহ-প্রদত্ত কল্যাণময় জীবন-ব্যবস্থা তথা সত্য-দ্বীন বাস্তবায়নের জন্য ব্যয় করা, ইসলাম ও মুসলিমের প্রতিরক্ষার জন্য অর্থ ব্যয় করা ইত্যাদি। তবে মূল লক্ষ্য হলো এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। অপরপক্ষে কেউ যদি লোক-দেখানো, জন-সমর্থন, সুনাম অর্জন, ক্ষমতা লাভ, দান-গ্রহীতা থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সুবিধা গ্রহণ, খোঁটা দিয়ে কষ্ট দেয়া, অন্যের কাছে দানের কথা বলে দান-গ্রহীতাকে লজ্জা দেয়া, এ ধরনের নিয়্যত রাখে এবং আচরণ করে, তার দান নষ্ট হয়ে যায়। আলোচ্য আয়াতে অত্যন্ত কঠিন কথা বলা হয়েছে যে, এরূপ দান না করে দান প্রার্থনাকারীকে ফেরত দেয়া ভালো, তবে সে ক্ষেত্রেও ধমক না দিয়ে বরং সুন্দর কথা দিয়ে ফেরত দিতে হবে। কঠিন কথা বলা যাবে না। (বনি ইসরাইল, ২৮) রাসূল (সা) হাদীসে কুদসীতে বলেন, কেয়ামতের দিন আল্লাহ এক বিরাট দান-বীরকে বলবেন, তুমি সুনামের জন্য দান করেছ, আর দুনিয়াতেই সেই সুনাম পেয়ে গেছ। সুতরাং আজ আর কিছু পাওয়ার নেই। এই বলে তাকে জাহান্নামে ফেলে দেয়া হবে। সুতরাং এমন নিয়্যতেই দান করা উচিত যেনো দান নষ্ট না হয়, যাতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন, যেনো আখেরাতে কাঙ্ক্ষিত পুরস্কার পাওয়া যায়।

আত্মণ্ডতৃপ্তি নয়, সতর্কতা কাম্য : আল্লাহর দেয়া সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করলে আল্লাহ সীমাহীন প্রতিদান দিতে পারেন এবং দেন। কিন্তু যারা ভুল নিয়্যত ও উদ্দেশ্যে দান করে, তাদের অনর্থক আত্মতৃপ্তি পেয়ে কোনো লাভ নেই।

কেন না, যারা লোক দেখানো ও সুনামের জন্য দান করে, এবং এভাবে জনসমর্থন ও ক্ষমতা লাভের মাধ্যমে স্বার্থসিদ্ধি করতে চায়, অথবা দান-গ্রহীতা থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সুবিধা গ্রহণ করতে চায়, অথবা খোঁটা দিয়ে দান-গ্রহীতাকে কষ্ট দিতে চায়, তাদের দান নষ্ট হয়ে যায়। আলোচ্য আয়াতে লু হাওয়ায় বৃদ্ধের ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার উদাহরণ দিয়ে আল্লাহ সতর্ক করে দিয়েছেন যে, এভাবে মানুষের সারা জীবনের দানও নষ্ট হয়ে যেতে পারে, যদি নিয়্যত ঠিক না থাকে। সুতরাং নিয়ত ঠিক রাখা উচিত এবং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই দান করা উচিত।