কোরআনুল কারিমের হেদায়াত
আল্লাহর প্রিয়তম বান্দার গুণাবলি
ড. আবুল হাসান সাদেক
প্রকাশ : ২৮ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
অনুবাদ : * তবে (তারা নয়) যারা তাওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে, আল্লাহ তাদের পাপকে পূণ্যে রূপান্তরিত করবেন। আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু। * যে ব্যক্তি তাওবা করে ও নেক আমল করে, সে আল্লাহর দিকে তেমনভাবে ফিরে আসে, যেভাবে ফিরে আসা উচিত। * যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না, আর যখন অনর্থক কোন কিছুর সম্মুখীন হয়, তখন সসম্মানে চলে যায়। * যাদেরকে তাদের প্রতিপালকের আয়াতগুলোর দ্বারা উপদেশ দেয়া হলে তারা অন্ধ ও বধিরের মতো আচরণ করে না। * যারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের এমন স্ত্রী ও সন্তান দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে। আর আমাদের মুত্তাকিদের নেতা বানিয়ে দিন। * তাদের প্রতিদান হিসেবে দেয়া হবে জান্নাতের সুউচ্চ স্থান, কারণ তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। সেখানে তাদের অভ্যর্থনা জানানো হবে অভিবাদন ও সালাম দিয়ে। * সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। আশ্রয় ও আবাস হিসেবে তা কতই না উৎকৃষ্ট! * (হে রাসূল) বলে দিন, তোমরা যদি তাকে না-ই ডাকো, তা হলে আমার প্রতিপালক তোমাদের কোনো পরোয়া করেন না। এখন তো তোমরা তা অস্বীকারই করলে। কাজেই অচিরেই আসবে অনিবার্য শাস্তি। (সুরা ফুরকান, ৭০-৭৭)।
মর্ম ও শিক্ষা : আগের পর্বে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের ৭টি গুণ উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে আলোচ্য আয়াতগুলোতে উল্লিখিত অন্যান্য গুণগুলো তুলে ধরা হচ্ছে :
৮. তারা তওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে : আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অষ্টম গুণ এই যে, তারা তাওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে। একজন মুমিন বান্দা পাপ করতেই পারে। পাপ থেকে কোনো মানুষই মুক্ত নয়। শুধু নবী রাসূলরাই মাসুম বা নিষ্পাপ। কিন্তু আল্লাহ চান, মুমিন বান্দারা যেনো পাপের মধ্যে ডুবে না থাকে বরং তারা যেনো পাপমুক্ত হতে পারে। তাই তিনি তাওবার ব্যবস্থা করেছেন। কোরআনে অপরাধের উল্লেখ করার পরপরই বার বার তাওবার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ মানুষ যেনো পাপ করে হতাশ না হয়। তার সামনে তাওবার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়ে তাকে হতাশামুক্ত করা হয়েছে। তাই তিনি বার বার তাওবার কথা বলেছেন, ক্ষমার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, হে আমার বান্দারা! তোমরা আমার রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না, আল্লাহ সকল গোনাহই মাফ করেন। তবে তা হওয়া উচিত প্রকৃত বা বিশুদ্ধ তাওবা বা তাওবাহ নাসূহা। এ জন্যে প্রয়োজন অতীত পাপের স্বীকারোক্তি, তার জন্য অনুতপ্ত হওয়া, পাপের জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা, ভবিষ্যতে আর পাপ না করার দৃঢ় প্রত্যয়, এবং বান্দার অধিকার নষ্ট করা হয়ে থাকলে তা সংশ্লিষ্টবান্দাকে ফেরত দেয়া অথবা তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
৯. মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান না করা : আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের নবম গুণ এই যে, তারা মিথ্যা সাক্ষ্য সাক্ষ্য দেয় না। মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান হারাম। মিথ্যা সাক্ষের ফলে নির্দোষ ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হয়, আর অপরাধী খালাস পেয়ে যায়। এর কারণে ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হয়। জাহিলি যুগে টাকার বিনিময়ে মানুষ আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতো। আল্লাহর বান্দাদের চরিত্রে এ নৈতিক ত্রুটি কাম্য নয়। তাই আল্লাহ মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করাকে হারাম করেছেন।
১০. অনভিপ্রেত কাজ এড়িয়ে চলা : আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের দশম গুণ এই যে, তারা যখন অনর্থক কোন কিছুর সম্মুখীন হয়, তখন সসম্মানে চলে যায় (আয়াত ৭২)। সমাজে অনেক অন্যায় এবং অনভিপ্রেত কর্মকাণ্ড চলতে পারে, কোনো কোনো মানুষ অনর্থক, ইসলামবিরোধী ও সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকে। আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের পক্ষে এই সমাজ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে মুমিন বান্দারা সে কর্দমাক্ত কলুষিত দুর্গন্ধময় পরিবেশে বসবাস করা সত্ত্বেও তার ময়লা-আবর্জনা ও কলঙ্ক তাদের স্পর্শ করতে পারে না। অন্যায়, অনর্থক কর্মকাণ্ড, গান-বাজনা ও অপসংস্কৃতি মুমিনদের প্রভাবিত করতে পারে না। তারা বেহুদা মজলিস ও সমাবেশ, ইসলাম পরিস্থি অসামাজিক কার্যক্রম, অনৈতিক অনুষ্ঠান ও সমাবেশে যোগ দেয় না। কেন না, এগুলোতে যোগদানের অর্থ হলো- এসব অন্যায়কে সমর্থন দেয়া, সহযোগিতা করা। তারা তাদের ব্যক্তিত্ব এবং গাম্ভীর্যতা অক্ষুণ্ণ রেখে এসব অসামাজিক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকে। বরং তারা যথাসম্ভব মানুষকে এগুলো থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করে।
১১. মনোযোগ দিয়ে কোরআন শ্রবণ, অনুধাবন এবং উপদেশ গ্রহণ : আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের একাদশ গুণ এই যে, যখন তাদের প্রতিপালকের আয়াতগুলো দ্বারা উপদেশ দেয়া হয়, তখন তারা অন্ধ ও বধিরের মতো আচরণ করে না (আয়াত ৭৩)। আল-কোরআনের বাণী মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ, অনুধাবন এবং তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। আল্লাহর কোরআন এমন এক বাণী যা অনেকের হৃদয়কে স্পর্শ করে এবং এর উপদেশ বাস্তবায়ন করে তারা মানবতার উচ্চ শিখরে পৌঁছে যায়, আবার অনেকে কোরআন শোনার পরও তা নিয়ে বিদ্রূপ করে, তাচ্ছিল্য করে, অনুধাবনের চেষ্টা করে না এবং উপদেশ গ্রহণ করে না। কোরআন শুধু তিলাওয়াতের জন্য নয়, বরং কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে মানবতার হিদায়াতের জন্য। এ হিদায়াত পেতে হলে শর্ত হলো অন্ধ ও বধিরের মতো আচরণ না করা, বরং কোরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা এবং তা অনুধাবন ও অনুসরণ করা। আল্লাহর প্রিয় বান্দারা তা করে।
১২. নেক সন্তান ও শান্তির পরিবারের জন্য দোয়া করা : আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের দ্বাদশ গুণ এই যে, তারা শান্তির পরিবার চায়, তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে এবং তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করে (আয়াত ৭৪)। নেক সন্তান হলো এমন সন্তান যাকে দেখলে পিতামাতার চোখ জুড়ায়, মন খুশী হয়, হৃদয়ে প্রশান্তি আসে। সন্তানের সুস্বাস্থ্য, সুন্দর আমল-আখলাক, শিক্ষা-দীক্ষা, বিদ্যা-বুদ্ধি, দীনদারী, ইসলামী চরিত্র ইত্যাদি সবই নেক সন্তানের গুণাবলির অন্তর্ভুক্ত, সবই পিতামাতার হৃদয়ের প্রশান্তির কারণ। এমন নেক সন্তানই মৃত্যুর পর পিতামাতার জন্য দোয়া করে এবং পিতামাতার জন্য সাদগায়ে জারিয়া হয়ে থাকে। নেক স্ত্রী হলো এমন- যাকে দেখে স্বামীর হৃদয়ে প্রশান্তি আসে, যে হয় দ্বীনদার, বিশ্বাসী এবং একটি শান্তির নিবাস তৈরির নেত্রী স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে থাকে প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা। এমন স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানাদী নিয়ে একটি শান্তির পরিবার গঠিত হয়। এছাড়া আরও কাম্য, যেনো তারা মানুষের জন্য আদর্শ হয় এবং সমাজে আদর্শের নেতৃত্ব দিতে পারে, যেনো তারা মুত্তাকীদের নেতা হিসেবে গণ্য হয়। আল্লাহর খাঁটি বান্দারা সে দোয়া করে এবং তেমন হওয়ার চেষ্টা করে।
১৩. মুমিনের সবচেয়ে বড় গুণ সবর ও ধৈর্য ধারণ : আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের ত্রয়োদশ গুণ এই যে, তারা সবর করে ও ধৈর্যধারণ করে। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের মুমিন মুত্তাকীনদের জান্নাতে প্রতিদান প্রদানের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, তারা সবর করেছিল। দুনিয়াতে আল্লাহর সন্তুষ্টির অনেক নেক কাজ আছে। কিন্তু এখানে অন্য কোনো আমল উল্লেখ না করে শুধু সবরের কথা বলা হয়েছে, যা থেকে সবরের গুরুত্ব বুঝা যায়। সবর মানে ধৈর্য, কষ্ট সহ্য করা, মেনে নেয়া, বিরত থাকা, অটল থাকা, অবিচল থাকা। সকল নিষিদ্ধ কর্ম থেকে বিরত থাকতে হলে প্রবৃত্তিকে দমন করতে হয়, অন্যায় কামনা-বাসনা থেকে বিরত থাকতে হয়, যার জন্য ধৈর্য অনিবার্য। আদিষ্ট ইবাদত সম্পাদনের জন্য কষ্ট স্বীকার করতে হয়, সত্যের সংগ্রাম ও দাওয়াতি কাজে বাতিলের নির্যাতন সহ্য করতে হয়। সবকিছুর জন্যই ধৈর্য প্রয়োজন। এক কথায় আল্লাহর সন্তুষ্টির অনেক আমল থাকলেও কোনোটাই সবর ও ধৈর্য ছাড়া সম্ভব নয়।
আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের জন্য মহাপুরস্কার এবং বিপরীতে বাতিলপন্থিদের করুণ শাস্তি: আলোচ্য আয়াতগুলোতে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের গুণাবলি বর্ণনার পর তাদের মহাপুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে যে, তাদের প্রতিদান হিসেবে দেয়া হবে জান্নাতের সুউচ্চ স্থান, সেখানে তাদের অভ্যর্থনা জানানো হবে অভিবাদন ও সালাম দিয়ে, সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। এরপর সূরাটির শেষ আয়াতে এমন সব মানুষের করুণ পরিণামের ঘোষণা দেয়া হয়েছে, যারা এতো কিছুর পরও সত্য প্রত্যাখ্যান করে এবং আল্লাহকে ডাকার পরিবর্তে বাতিলের পথে চলে। আল্লাহ তাদের কোনো পরোয়া করে না। তাদের আনুগত্যে আল্লাহর কোনো লাভ নেই, বরং এতে তাদের নিজেরই কল্যাণ ছিল। তাদের অহংকার ও অবাধ্যতার কারণে তারা চিরস্থায়ী কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে।