মহানবীর সবর ও প্রতিবাদ

আবু নাঈম ফয়জুল্লাহ

প্রকাশ : ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

নবীজি (সা.) ছিলেন পূর্ণাঙ্গ আদর্শ মানুষ। জীবনের যত অনুসঙ্গ হতে পারে সব দিকের অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত তাঁর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। সবর বা ধৈর্য জীবনের জন্য খুব জরুরি। অধৈর্য মানুষ জীবনে বড় কিছু করতে পারে না। সমাজের নানা অপরাধ, অন্যায়-অত্যাচার-নিপীড়ন এবং জুলুমণ্ডশোষণের ক্ষেত্রে সবসময় মুখ বুজে বসে থাকা যায় না। কখনো প্রতিবাদ করতে হয়। কখন সবর আর কখন প্রতিবাদ করতে হয়, এ বিষয়ে বিস্তর শিক্ষা রয়েছে নবী (সা.)-এর জীবনে। রাসুল (সা.) ধৈর্য ধারণ করে যেমন সবকিছু মুখবুজে সহ্য করেছেন, তেমনি অন্যায়ের প্রতিবাদে গর্জেও ওঠেছেন। তাই আমাদের বুঝতে হবে, কখন ধৈর্য এবং কখন প্রতিবাদ? এই দুয়ের মাঝে সুন্দর সমন্বয়ের মাধ্যমেই সুখ ও ছন্দময় জীবন এবং শান্তিময় সমাজ বিনির্মাণ হতে পারে। অন্যায় করা ও অন্যায় সয়ে যাওয়া দুটোই অপরাধ। সমাজ ও রাষ্ট্র নাগরিকদের সবর ও প্রতিবাদের ভারসাম্যপূর্ণ গুণের অধিকারী হওয়া বাঞ্ছনীয়। নবীজীবনের মক্কার জীবন সবরের জীবন। মদিনার জীবন প্রতিবাদের জীবন। তাই শুধু সবর কিংবা শুধু প্রতিবাদ প্রান্তিকতা। সবর ও প্রতিবাদের সমন্বিত জীবনাদর্শই রাসুল (সা.)-এর জীবনের প্রতিচ্ছবি। নবীজি (সা.) যেহেতু আমাদের আদর্শ, তাই নবীজীবন থেকে আমাদের সবর ও প্রতিবাদের ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষা নিতে হবে।

মহানবীর সবর : রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন ধৈর্যের আধার। তার জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে রয়েছে ধৈর্যের অসাধারণ শিক্ষা। মানসিক যন্ত্রণা, অর্থনৈতিক দৈন্য, পারিবারিক নানা সংকট, সামাজিক নিগ্রহ, কাফেরদের অত্যাচার ও নির্যাতনসহ হাজারো কষ্টের পাহাড় ডিঙিয়ে তাকে অগ্রসর হতে হয়েছে। শৈশব থেকেই তিনি একের পর এক পিতা, মাতা ও দাদার মৃত্যুর মতো মারাত্মক সব আঘাত সহ্য করে করে বড় হয়েছেন। এরপরআসে অর্থনৈতিক অনিরাপত্তা। যৌবনের কঠিন জীবনসংগ্রাম পাড়ি দিয়ে ৪০ বছরে শুরু হয় তার ধৈর্য ও সহনশীলতার মূল অধ্যায়। ইসলামের প্রকাশ্য ঘোষণার দিন থেকে ১৩ বছরের মক্কি জীবনের প্রতিটি দিন ছিল একেকটি স্বতন্ত্র সংগ্রাম। নামাজরত অবস্থায় মাথায় উটের পঁচা ভুড়ি চাপিয়ে দেওয়া, বাড়ির গেটে ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখা, ওপর থেকে মাথার ওপর ময়লা ফেলে দেওয়া, তায়েফের বাজারে রক্তে রঞ্জিত হওয়া, কাফেরদের অসংখ্য অপমানজনক কথাবার্তাসহ এমন কোনো কষ্ট ছিল না, যা তাকে সহ্য করতে হয়নি। সিরাতের গ্রন্থে নবী (সা.)-এর ধৈর্য ও কষ্ট স্বীকারের তালিকা খুব দীর্ঘ।

ধৈর্যের ফল : নবীজি নিজে যেমন ধৈর্য ধরেছেন তেমনি অন্যদেরও ধৈর্য ধরার সবক দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মুমিন যে ধরনের বিপদেই আক্রান্ত হোক না কেন, এমনকি কাঁটা ফুটলেও এর বিনিময়ে আল্লাহতায়ালা একটি নেকি দান করেন অথবা একটি গোনাহ মাফ করে দেন। (মুসনাদে আহমদ : ১৬৫৬০)। একবার নবীজি প্রচণ্ড জ্বরে কাঁপছিলেন। এমন সময় সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) নবীজির কাছে উপস্থিত হলেন। তখন নবীজি বললেন, ‘মোমিন যখন কোনো কষ্টে নিপতিত হয়, তখন আল্লাহতায়ালা-এর বিনিময়ে তার গোনাহগুলো মাফ করে দেন, যেমন শীতকালে গাছেরপাতা ঝরে পড়ে।’ (মুসলিম শরীফ : ৫৬৪৭) ।

মহানবীর প্রতিবাদ : রাসুল (সা.) সারাজীবন শুধু মানুষের নির্যাতন আর অত্যাচার সহ্য করে গেছেন বিষয়টা এমন নয়। বরং নবীজির প্রতিবাদমুখর জীবনও অনেক সমৃদ্ধ এবং অনুসরণীয়। তার প্রতিবাদের সর্বোচ্চ স্তর ছিল সরাসরি যুদ্ধ। তিনি জীবদ্দশায় ৬৩টি যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। এসব যুদ্ধ ছিল প্রতিরোধমূলক। আক্রমণাত্মক যুদ্ধও ছিল বেশকিছু। নবীজির জীবনের মূল মিশন ছিল সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা। এজন্য তিনি সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।

প্রতিবাদের স্তর : অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ইসলামে ঈমানের অন্যতম অনুসঙ্গ। নবীজি (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কেউ যখন কোনো অন্যায় প্রত্যক্ষ করে সে যেন তা হাত দিয়ে বাধা দেয়, যদি হাত দিয়ে বাধা দেওয়ার শক্তি না রাখে, তাহলে যেন মুখে প্রতিবাদ জানায়, আর যদি মুখে প্রতিবাদ জানানোর সক্ষমতাও না থাকে, তাহলে যেন অন্তত মনেমনে তা ঘৃণা করে। আর এটা সবচেয়ে দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক।’ (মুসলিম : ৭৮)। তারমানে, সবল ঈমারে পরিচয় হলো, অন্যায় দেখে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানানো। অন্যত্র নবীজি ইরশাদ করেন, মানুষ যখন সমাজে অন্যায় দেখার পরও প্রতিবাদ না করবে, তখন আল্লাহতায়ালা ওই সমাজের সবার ওপর সে অন্যায়ের শাস্তি চাপিয়ে দিবেন। (ইবনে মাজাহ : ৪০০৫)।

ধৈর্য ও প্রতিবাদ : ১. নবীজি (সা.) নিজের ব্যক্তি সত্তার ওপর যেসব বিপদ আপদ এসেছে তাতে তিনি চূড়ান্ত ধৈর্য ধারণ করেছেন। চাই তা শারীরিক অসুস্থতা হোক, ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে আক্রান্ত হওয়া শারীরিক নির্যাতন হোক, অপমানজনক কোনো কথা হোক, অথবা যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্রের আঘাত হোক। এক্ষেত্রে তিনি কখনো এমন কোনো কথা ও কাজ করেননি, যা ধৈর্যের পরিপন্থি। তায়েফের ঘটনাএর জ্বলন্ত সাক্ষী। তার শরীর থেকে রক্ত ঝরছে অথচ তিনি তায়েফবাসীর জন্য দোয়া করছেন। পাহাড়ের দায়িত্বরত ফেরেশতাকে আল্লাহ পাঠিয়ে দিলেন নবীজির পক্ষ হয়ে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য। কিন্তু তিনি অনুমতি দিলেন না। বরং উল্টো বলে দিলেন, এদের বংশধরদের মধ্যে এমন মানুষ হবে, যারা আল্লাহর ইবাদত করবে। (বোখারি : ৩২৩১)।

২. আদর্শিক ক্ষেত্রে তিনি কখনো আপস করেননি। মক্কি জীবনে দুর্বিষহ জীবনযাপনের সময় যখন চাচা আবু তালেব নবীজিকে শিথিলতা অবলম্বন করতে বলেন তখন তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘ওরা যদি আমার এক হাতে সূর্য, আরেক হাতে চন্দ্রও এনে দেয়, তবুও আমি এ পথ থেকে পিছ পা হব না।’ (ইবনে ইসহাক)।

আর মাদানিজীবন তো সত্যের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মধ্যদিয়েই অতিবাহিত করেছেন। ইসলামের জন্য তিনি জীবনবাজি রেখে লড়েছেন। নিজের আদর্শকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন।

৩. অন্যের জান, মাল ও ইজ্জত আবরুর নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও নবীজি ছিলেন প্রতিবাদী। তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম, ওই ব্যক্তি মোমিন নয়, ওই ব্যক্তি মোমিন নয়, ওই ব্যক্তি মোমিন নয়।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন,ইয়া রাসুলাল্লাহ, কে সে ব্যক্তি? নবীজি বললেন, ‘যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়।’ (বোখারি : ৬০১৬)। তিনি আরো বলেছেন, ‘অত্যাচারী রাজার সামনে দাঁড়িয়ে ন্যায়ের পক্ষে কথা বলা সবচেয়ে বড় জিহাদ।’ (তিরমিজি : ২১৭৪)। যেখানেই মুসলমানদের জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে সেখানেই নবীজি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।

৪. ইসলামি রাষ্ট্রের ওপর কোনো আঘাত এলে নবীজি তা কখনো সহ্য করতেন না। যেকোনো মূল্যে তা প্রতিহত করতেন। বদরযুদ্ধ থেকে শুরু করে যতযুদ্ধ নবীযুগে সংঘটিত হয়েছে তার প্রত্যেকটার কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, মদিনা কেন্দ্রীক ইসলামি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার আশঙ্কা থেকেই এসব যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ইসলামি রাষ্ট্রকে নির্মূল করা মানে ইসলামকেই নির্মূল করা। কারণ, রাষ্ট্র ছাড়া ইসলাম অপূর্ণাঙ্গ। তাই নবীজি কুরাইশ গোত্র থেকে শুরু করে শক্তিশালী রোমান সম্রাজ্যের বিরুদ্ধেও যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেছেন ইসলামি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধানের জন্য। নবীজি (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর পথে একদিন (ইসলামি রাষ্ট্রের) সীমানা পাহারা দেওয়া দুনিয়া ও দুনিয়ায় যা কিছু আছে সবকিছু থেকে উত্তম।’ বোখারি : ২৮৯২) ।

নবীজীবন থেকে শিক্ষা : আসলে ধৈর্য মানেই হলো, সত্যের পথে চলতে গিয়ে বা সত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যত চ্যালেঞ্জ আসবে তা গ্রহণ করাএবং যতবিপদ আসবে তা মাথা পেতে মেনে নেওয়া। প্রয়োজনে ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে শহীদী মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া। ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদ না করে সুস্থ সমাজ ও আদর্শ রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়।

একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকদের জানমাল ও ইজ্জতের ওপর নিপীড়ন দেখে যে মানসিক কষ্ট হয় তা নিজে গা বাঁচানোর জন্য নীরবে সহ্য করে যাওয়ার নাম ধৈর্য নয়। বরং অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে যে কষ্ট, দুঃখ, দুর্দশা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়, তা মাথা পেতে মেনে নিয়ে সত্যের পথে অটল ও অবিচল থাকার নাম ধৈর্য ও সবর। অফিস আদালতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতিকে না বলা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা ক্ষমতার অপপ্রয়োগ না করা, সাধারণ মানুষ দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণবিরোধী কাজ থেকে বিরত থাকাও সবর। শুধু মার খাওয়ার নাম সবর নয়, অন্যায় ও দুর্নীতি থেকে বেঁচে থাকাও সবর। সবরের এ শিক্ষা নবী (সা.)-এর জীবনে ঝলমলে উজ্জ্বল ও ব্যাপ্তময়।