জীবন-মরণ আল্লাহর হাতে

জুনাইদ ইসলাম মাহদি

প্রকাশ : ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সব ক্ষমতার মালিক আল্লাহ। তিনি পুরো জগতের স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা জীবন দান করেন। আর যাকে ইচ্ছা মৃত্যু দান করেন। তার ইচ্ছায়ই সব চলে। বাতাস বয়, পাতা নড়ে। পাখি ডাকে, মেঘমালা উড়ে। কোরআনে এসেছে, আল্লাহর জন্যই নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের স্বত্বাধিকারী, তিনি জীবন দেন এবং মৃত্যু দেন (সুরা তাওবা : ১১৬)। তাই মোমেন ব্যক্তির উচিত একমাত্র আল্লাহর শক্তিতে বিশ্বাস রাখা। তাকেই ভয় করা। বিপদে তাকে স্মরণ করা। সুখে তার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা। জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নে একমাত্র তাঁর ওপরেই আস্থা রাখা। কারণ, তিনি যাকে বাঁচাতে চাইবেন, তাকে কেউ মারতে পারবে না। আর তিনি যাকে মারতে চাইবেন তাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। নবীদের জীবনে এমন বাস্তব ঘটনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে। যা মোমেনের ঈমান বৃদ্ধি করে। মুসা নবীর (আ.) জীবনী পাঠ করলে দেখা যায় তাকে পৃথিবীতে আসার পথ রোধ করার পরিকল্পনাসহ বেঁচে থাকার সবপথ বন্ধ করে দিয়েছিল পাপিষ্ঠ ক্ষমতালোভী ফেরাউন। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনার কাছে বান্দার পরিকল্পনা ব্যর্থ।

ফেরাউনের মুসা নবীকে হত্যার পরিকল্পনা : আল্লাহ যাকে হেফাজত করে কেউ তার ক্ষতি করতে পারে না। তার জন্য আগুনও পুষ্পোদ্যানে পরিণত হয়। ইতিহাস পাঠে দেখা যায়, মুসাকে হত্যা করা ফেরাউনের জীবনের অন্যতম প্রচেষ্টা ছিল। এর পেছনে কারণ একটাই ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়ার ভয়। তাই ফেরাউন সারা জীবন, বিশেষত তিনবার মুসাকে হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। কিন্তু প্রত্যেকবার ব্যর্থ হয়েছে। কারণ জীবনের মালিক আল্লাহ মুসাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। কোরআনের ভাষায়- তারা চক্রান্ত করেন আর আল্লাহতায়ালাও পরিকল্পনা করেন। আর আল্লাহ-ই উত্তম পরিকল্পনাকারী (সুরা আলে-ইমরান : ৫৪)। এটাকেই প্রবাদে বলে ‘রাখে আল্লাহ মারে কে?’

শিশু মুসাকে হত্যার পরিকল্পনা : ফেরাউন একটি ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেন। যার ব্যাখ্যায় জ্যোতিষীরা বলেন, বনি ইসরাঈলে এমন একটি ছেলের জন্ম হবে, যে আপনার সিংহাসনচ্যুতির কারণ হবে। তাই সে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে ইসরাঈলি ঘরে জন্ম নেয়া ছেলে সন্তানদের হত্যার আদেশ দেন। আদেশ কার্যকরে কঠোর হৃদয়ের জনবল নিয়োগ দেন। যারা ইসরাঈলি সদ্য ভূমিষ্ঠ ছেলে সন্তানদের হত্যা করতে থাকে। কোরআনে এসেছে-যারা তোমাদের মর্মান্তিক শাস্তি দিত, তোমাদের পুত্রদের খুন করত আর নারীদের জীবিত রাখত (সুরা ইবরাহিম : ৬)।

দুনিয়ায় মুসা (আ.) এর আগমন : এমন কে আছেন, যে আল্লাহর কার্যে বাধা দেবেন? ফেরাউনও আল্লাহর হুকুম কার্যকরে বাঁধা হতে পারেনি। মায়ের গর্ভে মুসা কিন্তু তার পেট স্বাভাবিক। যার কারণে ফেরাউন বাহিনী তা বুঝতে ব্যর্থ হল। নির্ধারিত সময়ে ভূমিষ্ঠ হলে ছেলের নিরাপত্তার চিন্তায় মা চিন্তিত হয়ে যান। আল্লাহতায়ালা তার চিন্তিত মনকে প্রশান্ত করেন। তাকে (ইলহাম) নির্দেশ দেন। তুমি শিশুটিকে স্তন্য দান করতে থাক। তার সম্পর্কে আশঙ্কা করলে, তাকে দরিয়ায় নিক্ষেপ কর এবং ভয় কর না (সুরা কাসাস : ৭)। দরিয়া তাকে ডোবাতে পারেনি। হত্যা করতে সক্ষম হয়নি।

শত্রুর ঘরে বেড়ে ওঠা : মুসা (আ.)-এর মা আল্লাহর নির্দেশে সিন্দুকে করে শিশু মুসাকে দরিয়ায় ভাসিয়ে দেন। (সুরা ত্বহা : ৩৯)। ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া সেই সিন্দুক উত্তোলন করে এবং তাতে ফুটফুটে মুসাকে দেখলে তার প্রতি মহব্বত সৃষ্টি হয় এবং তাকে সন্তান হিসাবে প্রতিপালনের ইচ্ছা প্রকাশ করে। ফেরাউন স্ত্রীর মনোবাসনা পূরণে সাধারণ শিশু ভেবে শিশু মুসা হত্যা থেকে বিরত থাকে। ফেরাউন এত বছর থেকে যাকে হত্যার মানসে ইসরাঈলি সন্তানদের নির্মম হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত ছিল, আজ সেই সন্তান তার ঘরে। তার পরিবারের লালন-পালনে। যাকে হত্যার পরিকল্পনায় এত কিছু সেই আজ ফেরাউনের কোলে খেলেধুলে প্রতিপালিত হচ্ছে। এটাই আল্লাহর কুদরত। যার ইচ্ছা ব্যতীত কোনো কিছুই ঘটে না।

 

যৌবনে মুসাকে হত্যার পরিকল্পনা : মুসা (আ.) রাজকীয় আদর-আপ্যায়নে প্রতিপালিত হয়ে যৌবনে পদার্পন করলেন। সুঠামদেহী, শক্তিশালী পুরুষে পরিণত হলেন। জানতে পারনেল তিনি ইসরাঈলি। স্ব-জাতীর প্রতি অত্যাচার-অনাচার দেখলে তার প্রতিবাদ করতেন দৃঢ়ভাবে। একদিন দেখলেন, ফেরাউন বংশীয় একজন লোক ইসরাঈলি এক ব্যক্তিকে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে।

ইসরাঈলি ব্যক্তি মুসাকে দেখে তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। তাকে সাহায্যার্থে মুসা (আ.) কিবতীকে সজোরে চড় কষালেন। চড়ের প্রচণ্ডতায় সে মারা যায়। এই ঘটনা প্রকাশ পেলে ফেরাউন সভাসদস্যদের নিয়ে দ্বিতীয়বার মুসাকে হত্যার ফরমান জারি করেন। মুসা (আ.) সেই খবর পেয়ে মিশর ত্যাগ করেন। এবারও ফেরাউন তাকে ধরতে ও মারতে ব্যর্থ হয়। কেন না, আল্লাহ যাকে মরতে দেবেন না, দুনিয়ার কোনো শক্তিই তাকে মারতে পারবে না।

ফেরাউনের দরবারে নবী মুসা (আ.) : মিশর থেকে পালায়ন করে মুসা (আ.) মাদায়েনে গমন করেন। সেখানে দীর্ঘদিন অবস্থান করেন। প্রত্যাবর্তনকালে নবুওয়াতপ্রাপ্ত হন। আল্লাহর পয়গাম নিয়ে ফেরাউনের কাছে আসার প্রত্যাদেশ পান। তিনি ফেরাউনকে আল্লাহর একত্ববাদের পয়গাম পৌঁছান। কিন্তু ফেরাউন তা মানতে অস্বীকৃতি জানায় এবং নিজেকে বড় রব বলে দাবি করে। কোরআনে এসেছে- সে (ফেরাউন) বলল, আমিই তোমাদের শ্রেষ্ঠ রব (সুরা নাযিয়াত : ২৪)। যখন ফেরাউন কোনোভাবেই আল্লাহকে মানতে চাইল না। তখন মুসা (আ.) তাকে বললেন, বনি ইসরাঈলকে আমার সঙ্গে যেতে দেও। কিন্তু সে এতেও রাজি হলো না।

মুসাসহ বনি ইসরাঈলকে হত্যার পরিকল্পনা : আল্লাহর আদেশে মুসা (আ.) বনি ইসরাঈলকে নিয়ে বের হলেন মিশর ত্যাগের উদ্দেশ্যে। এই খবরে ফেরাউনও সৈন্য-সামান্ত নিয়ে মুসাসহ সকলকে হত্যা করতে পিছু নেয়। নীলনদের তীরে দু’দলের সাক্ষাৎ হলে, বনি ইসরাঈল ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। মুসা (আ.) আল্লাহর আদেশে লাঠির আঘাতে নদীর বুকে রাস্তা সৃষ্টি করেন। যা দিয়ে বনি ইসরাঈল নীলনদ অতিক্রম করে। অহংকারী ফেরাউন আল্লাহর তৈরি রাস্তাকে নিজের তৈরি বলে দাবি করে, সৈন্যদের চলতে বলেন। মাঝ দরিয়ায় পৌঁছলে আল্লাহর হুকুমে পানি মিলে যায়। রাস্তা অদৃশ্য হয়ে যায়। ফলে সবাই সমুদ্রে ডুবে মারা যায়। ধ্বংস হয় ফেরাউনের। অন্যকে মারতে এসে সে নিজেই মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। আল্লাহর অবাধ্য ফেরাউন আল্লাহর শিকারে পরিণত হয়। কথায় আছে, আল্লাহ ছাড় দেন; কিন্তু ছেড়ে দেন না।