প্রতিবেশীর পরিচয় : নিজের ঘরের পাশে যে বসবাস করে সাধারণত সেই প্রতিবেশী। তবে প্রকৃত ও ব্যাপক অর্থে প্রতিবেশী বলতে বুঝায় মুসলিম অমুসলিম, নেককার, বদকার, শত্রুমিত্র, দেশি-বিদেশি, আত্মীয়-অনাত্মীয়, কাছে দূরের, স্থায়ী-অস্থায়ী সবাইকে। পাশের ঘরের লোকজনই শুধু প্রতিবেশী বিষয়টা এমন নয়। অফিসের কলিগ প্রতিবেশী, বাসের সহযাত্রী প্রতিবেশী, সহপাঠী প্রতিবেশী, অধীনস্থ ব্যক্তিরা প্রতিবেশী। সুতরাং যে প্রতিবেশীর সঙ্গে ভালো আচরণ করে এবং তাদের যথাযথ হক আদায় করে এবং প্রতিবেশী তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন সেই উত্তম প্রতিবেশী। রাসুল (সা.) বলেছেন, যে নিজ প্রতিবেশীর দৃষ্টিতে ভালো সেই সর্বোত্তম প্রতিবেশী। (মুসনাদে আহমাদ : ৬৫৬৬)। আমরা ভালো প্রতিবেশী হবো মন্দ প্রতিবেশী হবো না। মন্দ প্রতিবেশী থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইব। কারণ মন্দ প্রতিবেশী নিজেও খারাপ কাজ করে এবং অন্যকেও খারাপের দিকে নিয়ে যায়। রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা মন্দ প্রতিবেশী থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাও। (সুনানে নাসায়ী : ৫৫০২)। দুই প্রতিবেশী নারীর ঘটনা হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি এসে রাসুল (সা.) কে বলল, এক নারীর ব্যাপারে প্রসিদ্ধ, সে বেশি বেশি (নফল) নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, দুই হাতে দান করে। কিন্তু মুখের কথায় নিজ প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়।(তার অবস্থা কী হবে?)। রাসুল (সা.) বললেন, সে জাহান্নামে যাবে। আরেক নারী বেশি (নফল) নামাজও পড়ে না, খুব বেশি রোজাও রাখে না আবার তেমন দান সদকাও করে না; সামান্য দু-এক টুকরা পনির দান করে। তবে সে মুখের কথায় প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না (এই নারীর ব্যাপারে কী বলেন?)। রাসুল (সা.) বললেন, সে জান্নাতি। (বোখারি : ১১৯)।
হাদিসে প্রতিবেশীর গুরুত্ব : রাসুল (সা.) অসংখ্য হাদিসে প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে আলোকপাত করেছেন। এমনকি রাসুল (সা.) বলেছেন, জিবরাইল (আ.) আমাকে প্রতিবেশীর হকের ব্যাপারে এত বেশি তাগিদ দিয়েছেন যে, আমার কাছে মনে হয়েছে প্রতিবেশীকে মিরাছ (মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পত্তি) এর অংশীদার বানিয়ে দেয়া হবে। বোখারি : ৬০১৪)। হালে প্রতিবেশীর হকের ব্যাপারে আমাদের মধ্যে উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়। আত্মীয়তা বা প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি অবহেলার শিকার। বিশেষ করে অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একচ্ছত্র সয়লাবের যুগে অফ লাইনের প্রতিবেশীরা চরম অবেহলার শিকারে পরিণত হয়ে অনলাইনের অনাত্মীয় ও দূর থেকে দেখা লোকদের গুরুত্ব অপরিসীম হয়ে উঠেছে। যা হওয়ার কথা ছিলো সম্পূর্ণ উল্টো। অথচ কাছের বা দূরের আত্মীয় ও প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণ করা, তাদের কষ্ট না দেয়া, তাদের খোঁজখবর রাখা এবং বিভিন্ন কাজে সাহায্য সহযোগিতা করাকে ঈমানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের উপর ঈমান রাখে, সে যেন প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণ করে। (মুসলিম : ১৮৫)। অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, যে আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। (মুসলিম : ১৮৩)।
প্রতিবেশীর প্রতি মহানবী : রাসুল (সা.) প্রতিবেশীর প্রতি কতোটা সদয় ও যত্নবান ছিলেন তা রাসুলের হাদিসের দিকে লক্ষ্য করলে সুস্পষ্ট বুঝা যায়। রাসুলের সীরাত পাঠ করলেও ভেসে আসে তাঁর আখলাকের অনুপম দৃষ্টান্তের ছবি। প্রতিবেশীর সঙ্গে কী কী আচরণ করতে হবে। আর কী করা যাবে না। কোনো আচরণ দ্বারা প্রতিবেশীর মাঝে সুসম্পর্ক বজায় থাকবে এবং মুহাব্বত বৃদ্ধি পাবে, সেসব কথাও তিনি উম্মাহর জন্য বলে গিয়েছেন। যদি হাদিসের প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য করা হয়, তাহলে আঁচ করা যায় রাসুল (সা.) প্রতিবেশীর প্রতি কতটা দরদি ও মানবিক ছিলেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ওই ব্যক্তি মুমিন নয়, যে পেটপুরে খায় অথচ তার পাশের প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে। (আল আদাবুল মুফরাদ : ১১২)। রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা হাদিয়া আদান-প্রদান কর। এর মাধ্যমে তোমাদের মাঝে মুহাব্বত বৃদ্ধি পাবে। (আল আদাবুল মুফরাদ : ৫৯৪)। রাসুল (সা.) হজরত আবু যর (রা.) কে বললেন, হে আবু যর তুমি ঝোল (তরকারি) রান্না করলে তার ঝোল বাড়িয়ে দিও এবং তোমার প্রতিবেশীকে তাতে শরিক করো। (মুসলিম : ২৬২৫)। রাসুল (সা.) বলেছেন, কেয়ামতের দিন প্রথম বাদী ও বিবাদী হবে দুই প্রতিবেশী। (মুসনাদে আহমাদ : ১৭৩৭২)। মউল্লিখিত হাদিসের বর্ণনা থেকে আমরা বুঝতে পারি প্রতিবেশীর হক অত্যধিক। তাদের সঙ্গে সদাচরণ মুমিনের বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া সমাজকে সুসংগঠিত ও সুন্দর রাখার জন্যও প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্প্রীতি সদ্ভাব বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। এতে সমাজ সুন্দর ও শান্তিময় হয় এবং পার্থিব জীবনের পাশাপাশি পরকালীন জীবনেও অনেক লাভবান হওয়া যায়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রতিবেশীর হকের ব্যাপারে যত্মবান হওয়ার তৌফিক দান করুন।
লেখক : শিক্ষক