নারীদের কাফন দাফনের বিধান

শরিফ আহমাদ

প্রকাশ : ০৯ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মৃত্যু সবার জন্য অবধারিত। কার কখন কোথায় মৃত্যু হবে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। মৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো দ্রুত তার দাফন কাফনসম্পন্ন করা। কিন্তু এ সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষ উদাসীন থাকায় দাফন কাফন করতে অনর্থক বিলম্ব হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে গোসল দেওয়ার মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অথচ সামান্য সদিচ্ছা থাকলে কাফন দাফনের বিধানগুলো আয়ত্ত করে অর্জন করা যায় অফুরন্ত সওয়াব। এখানে নারীদের কাফন দাফনের বিধান সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

মুমূর্ষু অবস্থায় অন্যদের করণীয় : কোনো নারী বা পুরুষের মুমূর্ষু সংবাদ পৌঁছে গেলে স্বাভাবিকভাবে আত্মীয়-স্বজনরা দেখতে আসে। তখন তাদের এবং পাশে থাকা আত্মীয়-স্বজনের তিনটি বিষয় প্রধানত করণীয়।

এক. রোগীর জন্য দোয়া করা । হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি এমন কোনো রোগীকে দেখতে যায়, যার মৃত্যুর সময় উপস্থিত হয়নি, সে যেন তার কাছে বসে এ দোয়াটি সাতবার পাঠ করে। ‘আসআলুল্লাহাল আজিম রব্বাল আরশিল আজিম আই ইয়াশফিকা’ অর্থাৎ আমি মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করছি যেন তিনি তোমাকে মুক্ত করেন। এ দোয়ার ফলে অবশ্যই আল্লাহ তাকে রোগমুক্ত করবেন। (আবু দাউদ : ৩০৯২)।

দুই. কালিমা তায়্যিবার তালকীন করা। রোগীর সঙ্গে অবস্থানকারীদের উচিত তাকে বেশি বেশি কালিমা তায়্যিবার তালকীন করা। তালকীন মানে এই নয় যে, কালিমা পড়ার জন্য তাকে পীড়াপীড়ি করা। বরং তারা নিজেরাই পাশে বসে এমন আওয়াজে কালিমা পড়বে, যেন শ্রবণ করে মুমূর্ষু নারী-পুরুষ পাঠ করতে পারে। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুল (সা.) বলেন, তোমাদের মৃত্যুমুখীদের লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু পড়ে শোনাও। (তিরমিজি : ৯৭৬)। কেন না, যার সর্বশেষ উচ্চারিত বাক্য হবে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

তিন. সুরা ইয়াসিন পাঠ করা। মৃত্যুর সময় ফেরেশতারা হাজির হয়। ওই সময় আশপাশে সুগন্ধির ব্যবস্থা করে রাখা ভালো। মৃত্যুর যন্ত্রণা কমবেশি সবার হয়ে থাকে। এ যন্ত্রণা থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়ার জন্য পাশে বসে সুরা ইয়াসিন পাঠ করা উত্তম। এর মাধ্যমে মৃত্যু যন্ত্রণা কম হয়। হজরত মাকাল ইবনে ইয়াসার (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা তোমাদের মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তির কাছে সুরা ইয়াসিন পাঠ করবে। (আবু দাউদ : ৩১০৭, ইবনে মাজাহ : ১৪৪৮)।

মৃত্যুর পর করণীয় কাজ : নারী কিংবা পুরুষ যে কেউ হোক না কেন, ইন্তেকাল করার সঙ্গে সঙ্গে তার খবর ছড়িয়ে যায়। আত্মীয়-স্বজনের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। তখন শোক সংবাদ কানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে পাঠ করতে হয়- ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’ (মুসলিম : ৯১৮)। তখন মাইয়েতের পাশে থাকা ব্যক্তিদের প্রধান কর্তব্য হলো ইন্তেকাল হওয়া মাত্র তার হাত পা বাঁকা থাকলে সোজা করে দেওয়া। উভয় পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি ফিতা বা কাপড়ের টুকরা দ্বারা বেঁধে দেওয়া এবং চোখ মুখ বন্ধ করে দেওয়া। সম্পূর্ণ শরীর চাদর দ্বারা ঢেকে মাটি কিংবা ফ্লোরের ওপর না রেখে সরাসরি কোন খাটিয়ার ওপর তুলে রাখা। (আদ দুররুল মুখতার : ২/১৯৩)। অতঃপর আত্মীয়দের কাজ হলো কাফন দাফন করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

গোসল করানোর নিয়ম : পুরুষ এবং নারী মাইয়েতের গোসলের নিয়ম প্রায় একই রকম। পুরুষের গোসল নেককার পুরুষ ও নারীদের গোসল পরহেজগার নারীরা দিবে। পর্দা ঘেরা স্থানে মাইয়েতকে নিয়ে প্রথমে একটা লম্বা মোটা কাপড় দিয়ে সতর ঢেকে তার ভেতর থেকে শরীরের অন্যান্য কাপড় খুলে দিতে হয়। সতর না দেখে বাম হাতে কোনো কাপড় পেঁচিয়ে তা দ্বারা মাইয়েতকে ৩ বা ৫টি ঢিলা দ্বারা ইস্তেঞ্জা করাতে হয়। পানি দ্বারা ধৌত করাতে হয়। তারপর নাকে, মুখে ও কানে তুলা দিয়ে অজু করাতে হয়। তবে ফরজ গোসল অবস্থায় মৃত্যু কিংবা হাযেজ-নেফাস অবস্থায় মৃত্যু হলে মুখে এবং নাকে পানি দিয়ে বের করা জরুরি। অজুর সময় প্রথমে চেহারা, তারপর দুই হাত এবং মাথা মাসাহ করে উভয় পা ধুয়ে দিতে হয়। অতঃপর সাবান দ্বারা মাথা ধৌত করে মাইয়েতকে বাম কাতে শুইয়ে আগে করা বরই পাতার কুসুম কুসুম গরম পানি দ্বারা মাথা থেকে পা পর্যন্ত ডান পাশে তিনবার পানি ঢালতে হয়, যেন নিচের দিকে বাম পর্যন্ত পৌঁছে যায়। অনুরূপভাবে ডান কাতে শুইয়ে বাম পার্শে তিনবার পানি ঢালতে হয়। অতঃপর মাইয়েতকে নিজের শরীরের সঙ্গে ঠেস লাগিয়ে কিঞ্চিৎ বসিয়ে হালকাভাবে পেটের ওপর থেকে নিচের দিকে মালিশ করতে হয়। ময়লা বের হলে ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে দিতে হয়। অতঃপর গোলাপ জল এবং কর্পূর মেশানো পানি ডানেবামে নিচ পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হয়। গোসল শেষে শুকনো কাপড় দ্বারা শরীর মুছে কাফন পরাতে হয়। (আহকামে জিন্দেগী : ৫৩৭)।

কাফন পরানোর সুন্নাত : নারীদের পূর্ণ শরীরই সতর। আর তার পূর্ণ শরীর সুন্দরভাবে আবৃত করার জন্য পাঁচটি কাপড় দেওয়া সুন্নাত। কাপড়গুলো হলো, ইজার, লেফাফা, কোর্তা-জামা, সীনাবন্দ ও সারবন্ধ-ওড়না। হজরত লায়লা বিনতে কায়েফ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে মহিলারা হজরত উম্মে কুলসুম (রা.)কে তার ইন্তেকালের পর গোসল দিয়েছিল আমিও তাদের একজন ছিলাম। তার গোসল সম্পন্ন হওয়ার পর রাসুল (সা.)তার কাফনের জন্য সর্বপ্রথম আমাদের তহবন্দ প্রদান করেন। এরপর জামা, সিরবন্দ, চাদর এবং শেষে এমন একটা কাপড় প্রদান করেন, যা ওপরে জড়িয়ে দেওয়া হয়। (আবু দাউদ : ৩১৪৩ )। মাইয়েতকে কাপড় পড়ানোর সুন্নাত নিয়ম হলো, প্রথমে লেফাফা, তারপর ইজার, তারপর সীনাবন্দ ও জামা বিছাতে হয়। অতঃপর মাইয়েতকে কাফনের ওপর চিত করে শোয়াতে হয়। এ বিষয়ে আল্লামা ফখরুদ্দীন ঝাইলাই (রহ.) বলেন, প্রথমে জামা পরাতে হবে। অতঃপর চুলগুলো দুটি গুচ্ছ করে (দুদিক থেকে) জামার ওপর দিয়ে সিনায় রাখবে। এরপর (মাথা ঢেকে) ওড়নার উভয় পাশ সিনার চুলের ওপর লিফাফার ভেতরে রাখবে। এরপর ইজার অতঃপর লিফাফা গুটিয়ে নিবে যেভাবে পুরুষের কাফন গুটানো হয়। অর্থাৎ আগে বাম পাশ উঠাবে তারপর ডান পাশ উঠিয়ে তার ওপরে রাখবে। এরপর কাফনের ওপরে একটি কাপড়ের টুকরা (সিনাবন্দ) পেঁচিয়ে দিবে যেন কাফন সরে না যায়। এ কাপড় চওড়া হবে সিনা থেকে নাভি পর্যন্ত। আবার সিনা থেকে হাঁটু পর্যন্ত প্রশস্ত হওয়ার কথাও বলা হয়েছে, যাতে লাশ নিয়ে চলার সময় রান দোল খাওয়ার কারণে কাফন খুলে না যায়। (তাবঈনুল হাকায়েক : ১/২৩৮)।

দাফনের সময় সতর্কতা : মহিলা মাইয়েতের খাট আলাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া উত্তম। যেন বেগানা পুরুষের দৃষ্টি লাশের ওপর না পড়ে। মহিলা মাইয়েতকে কবরে রাখার সময় অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। কাপড় বা চাদর দিয়ে ঢেকে কবরের প্রাথমিক কাজগুলো সম্পন্ন করতে হয়। হজরত আবু ইসহাক (রহ.) বলেন, আমি হজরত হারিস (রহ.)-এর জানাজায় উপস্থিত হলাম। লোকজন তার কবর কাপড় দিয়ে ঢেকে দিল।

তখন হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াজিদ কাপড়টি টেনে সরিয়ে দেন এবং বলেন, তিনি তো পুরুষ। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা : ১১৭৮৫)। মহিলার লাশ তার মাহরাম ব্যক্তিরাই কবরে নামাবে। মাহরাম না থাকলে অন্যান্য আত্মীয়রা, তারা না থাকলে কোনো পরহেজগার ব্যক্তি লাশ কবরে নামাবে (আলমগিরী : ১/১৬৬)। দাফনের সময় আরো অন্যান্য নিয়ম আছে। সেগুলো মেনে মাটি দেওয়ার সময় এই দোয়া পাঠ করতে হয়। হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন রাসুল (সা.)-এর মেয়ে উম্মে কুলসুম (রা.)-কে কবর রাখা হয়, তখন রাসুল (সা.) পড়েন, মিনহা খালাকনাকুম ওয়াফিহা নুয়ীদুকুম ওয়ামিনহা নুখরিজুকুম তারাতান উখরা। (মুসনাদে আহমাদ : ২২১৮৭, মুস্তাদরাকে হাকেম : ৩৪৩৩)।

লেখক : শিক্ষক ও খতিব।