পৃথিবীর ঊষালগ্ন থেকে ভ্রমণ চলে আসছে। নবী রাসুলগণ দাওয়াতের কার্যক্রম এগিয়ে নিতে বিভিন্ন শহর ও লোকালয় ভ্রমণ করেছেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্য মানুষ কাফেলা বেঁধে দূর বহুদূর সফর করত। তবে হজরত মুসা (আ.) একবার ইলম অর্জন করার লক্ষ্যে সফর করেছিলেন। যার বর্ণনা কোরআন হাদিসে গুরুত্বের সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন, একবার মুসা (আ.) বনী ইসরাঈলের এক সমাবেশে ভাষণ দেয়ার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কোনো ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী? তিনি বললেন, আমি। মুসা (আ.)-এর এ উত্তরে আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। কেন না, তিনি জ্ঞানকে আল্লাহর দিকে সম্পর্কিত করেননি। আল্লাহ তাকে বললেন, বরং দুই নদীর সংযোগ স্থলে আমার একজন বান্দা আছে, সে তোমার চেয়ে বেশি জ্ঞানী। মুসা (আ.) আরজ করলেন, হে আমার রব! আমি তার সঙ্গে কীভাবে সাক্ষাৎ করব?...। (বোখারি : ৩১৬২)।
কোরআনের বর্ণনায় শিক্ষাসফর : আল্লাহর অনুমতিক্রমে হজরত মুসা (আ.) ইউশা ইবনে নূনকে সঙ্গে নিয়ে সফর শুরু করেন। গন্তব্য দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থল। সেখানে আছেন আল্লাহর প্রিয় বান্দা হজরত খিজির (আ.)। তাদের সঙ্গে খাদ্যের জন্য রাখা মাছ চিহ্ন এঁকে তার নির্ধারিত ঠিকানায় নিয়ে যায়।
বড় একটি মুজেজা প্রকাশিত হয়। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, যখন মুসা (আ.) তার যুবক (সঙ্গী) কে বললেন : দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে না পৌঁছা পর্যন্ত আমি আসব না অথবা আমি যুগ যুগ ধরে চলতে থাকব। অতঃপর যখন তারা দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে পৌঁছালেন,তখন তারা নিজেদের মাছের কথা ভুলে গেলেন। অতঃপর মাছটি সমুদ্রে সুড়ঙ্গ পথ সৃষ্টি করে নেমে গেল। যখন তারা সে স্থানটি অতিক্রম করে গেলেন, মুসা (আ.) সঙ্গীকে বললেন, আমাদের নাশতা আন।
আমরা এই সফরে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছি। সে বলল : আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, আমরা যখন প্রস্তর খণ্ডে আশ্রয় নিয়েছিলাম, তখন আমি মাছের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। শয়তানই আমাকে একথা স্মরণ রাখতে ভুলিয়ে দিয়েছিল। মাছটি আশ্চর্যজনকভাবে সমুদ্রে নিজের পথ করে নিয়েছে। মুসা (আ.) বললেন, আমরা তো এ স্থানটিই খুঁজছিলাম। অতঃপর তারা নিজেদের চিহ্ন ধরে ফিরে চললেন। অতঃপর তারা আমার বান্দাদের মধ্যে এমন একজনের সাক্ষাৎ পেলেন, যাকে আমি আমার পক্ষ থেকে রহমত দান করেছিলাম ও আমার পক্ষ থেকে দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান। (সুরা কাহফ : ৬০-৬৫)।
শিক্ষার জন্য সময় ও ধৈর্য জরুরি : হজরত মুসা (আ.) হজরত খিজির (আ.)এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কুশল বিনিময় করেন এবং তার কাছে ইলম শেখার আবেদন করেন। তিনি বলেন কিছুতেই আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না। তখন মুসা (আ.) ধৈর্য ধারণের ওয়াদা করেন। অতঃপর একত্রে রওনা করেন। কোরআনের ভাষ্য এরকম- অতঃপর তারা চলতে লাগল। অবশেষে যখন তারা নৌকায় আরোহণ করল, তখন তিনি তাতে ছিদ্র করে দিলেন।
মুসা (আ.) বললেন : আপনি কি এর আরোহীদের ডুবিয়ে দেয়ার জন্য এতে ছিদ্র করে দিলেন? নিশ্চয়ই আপনি একটি গুরুতর মন্দ কাজ করলেন। তিনি বললেন : আমি কি বলিনি যে, আপনি আমার সঙ্গে কিছুতেই ধৈর্য ধরতে পারবেন না? মুসা (আ.) বললেন : আমাকে আমার ভুলের জন্য অপরাধী করবেন না এবং আমার কাজে আমার ওপর কঠোরতা আরোপ করবেন না। অতঃপর তারা চলতে লাগল। অবশেষে যখন একটি বালকের সাক্ষাৎ পেলেন, তখন তিনি তাকে হত্যা করলেন। মুসা (আ.) বললেন? আপনি কি একটি নিষ্পাপ জীবন শেষ করে দিলেন প্রাণের বিনিময় ছাড়াই? নিশ্চয়ই আপনি তো এক গুরুতর অন্যায় কাজ করলেন। তিনি বললেন : আমি কি বলিনি যে, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধরে থাকতে পারবেন না। মুসা (আ.) বললেন : এরপর যদি আমি আপনাকে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করি, তবে আপনি আমাকে সঙ্গে রাখবেন না। আপনি আমার পক্ষ থেকে অভিযোগ মুক্ত হয়ে গেছেন। অতঃপর তারা চলতে লাগল, অবশেষে যখন একটি জনপদের অধিবাসীদের কাছে পৌঁছে তাদের কাছে খাবার চাইল, তখন তারা তাদের আতিথেয়তা করতে অস্বীকার করল। অতঃপর তারা সেখানে একটি পতনোন্মুখ প্রাচীর দেখতে পেলেন, সেটি তিনি সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলেন। মুসা (আ.) বললেন : আপনি ইচ্ছা করলে তাদের কাছ থেকে এর পারিশ্রমিক আদায় করতে পারতেন। তিনি বললেন : এখানেই আমার ও আপনার মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হলো। এখন যে বিষয়ে আপনি ধৈর্য ধরতে পারেননি তার তাৎপর্য বলে দিচ্ছি। (সুরা কাহফ : ৭১-৭৮)।
পূর্ণ ঘটনার বিবরণ দিয়ে রাসুল (সা.) বলেন, মুসা (আ.) যদি আরো কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরতেন, তবে আরো কিছু জানা যেত। (বোখারি : ১২২, মুসলিম : ২৩৮০)। বোঝা গেল শিক্ষার জন্য সময় ও ধৈর্য্য জরুরি।
সফরের অর্জিত শিক্ষা : হজরত খিজির (আ.) নবী নাকি অলি ছিলেন এ নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে গ্রহণযোগ্য আলেমদের মতে তিনি একজন নবী ছিলেন। মহান আল্লাহ তাকে বিশেষ জ্ঞান দান করেছিলেন। যা হজরত মুসা (আ.) কে দেওয়া হয়নি। তাই তার উপরোক্ত ওই কাজগুলো বাহ্যিক দৃষ্টিতে মন্দ হলেও আসলে তা ছিল কল্যাণকর। হজরত মুসা (আ.)-এর আপত্তির জবাবে তিনি বলেন, নৌকাটি ছিল কয়েকজন দরিদ্র ব্যক্তির। তারা সমুদ্রে জীবিকা অন্বেষণ করত। আমি ইচ্ছা করলাম যে, সেটিকে ত্রুটিযুক্ত করে দিই। কারণ তাদের অপরদিকে ছিল এক জালিম বাদশাহ। সে বল প্রয়োগ করে প্রত্যেকটি নৌকা ছিনিয়ে নিত। বালকটির ব্যাপার হলো তার পিতা-মাতা ছিল ঈমানদার। আমি আশঙ্কা করলাম যে, সে অবাধ্যতা ও কুফর দ্বারা তাদের প্রভাবিত করবে। অতঃপর আমি ইচ্ছা করলাম যে, তাদের পালনকর্তা তাদের মহত্তর, তার চাইতে পবিত্রতায় ও ভালোবাসায় ঘনিষ্ঠতর একটি শ্রেষ্ঠ সন্তান দান করুক। আর প্রাচীরের ব্যাপার, সেটি ছিল নগরের দুজন পিতৃহীন বালকের। এর নিচে ছিল তাদের গুপ্তধন এবং তাদের পিতা ছিল সৎকর্মপরায়ণ। সুতরাং আপনার পালনকর্তা দয়াবশত ইচ্ছা করলেন যে, তারা যৌবনে পদার্পন করুক এবং নিজেদের গুপ্তধন উদ্ধার করুক। আমি নিজ মতে এটা করিনি। আপনি যে বিষয়ে ধৈর্যধারণ করতে অক্ষম হয়েছিলেন, এই হলো তার ব্যাখ্যা। (সুরা কাহফ : ৭৯-৮২)।
ঐতিহাসিক সফরের সারকথা : আল্লাহতায়ালার দুজন প্রিয় বান্দার এই ঐতিহাসিক ভ্রমণের সারাংশ হলো-
এক. আল্লাহর কাছে সুশাসক ও তার শাসন বড় পছন্দ। ন্যায়পরায়ণ শাসককে তিনি কেয়ামতের ময়দানে আরশের ছায়ার নিচে স্থান দেবেন। আর জালিম শাসকের পরিণতি হবে ভয়ংকর। জালিমের অত্যাচার থেকে তিনি মাঝি ও তার পরিবারের সদস্যদের বাঁচিয়েছেন দুজন নবীর মাধ্যমে।
দুই. যিনি গচ্ছিত দ্রব্য যথাযথ হেফাজতে রাখেন এবং তার মালিককে ফেরত দেন তিনি প্রকৃত আমানতদার। সমাজের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সততা ও আমানতদারিতা খুব প্রয়োজন। এজন্য ইসলাম আমানতদারিতার প্রতি সমধিক গুরুত্বারোপ করেছে। সম্মানিত দুজন ব্যক্তির মাধ্যমে আমানতদার ব্যক্তির সম্পদ তার ওয়ারিশদের জন্য হেফাজতের সুব্যবস্থা করেছেন।
তিন. সন্তান আল্লাহর দেওয়া বড় নেয়ামত। সন্তানকে আদর্শবান হিসেবে গড়ে তোলা পিতা-মাতার নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। যথাযথ দায়িত্ব পালনেই সন্তান নেককার হিসাবে গড়ে ওঠে। সুসন্তান পিতা-মাতার গৌরব। দেশ ও জাতির প্রকৃত বন্ধু। ওই ঈমানদারকে কুসন্তানের বদৌলতে আল্লাহ সুসন্তান দান করেছিলেন। যাদের বংশবাতির মধ্যে অনেকেই নবী-রাসুল হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। মোটকথা, এ সফর থেকে যা শেখা হলো তা সংক্ষেপে বলা যায়, আমানতদারি রক্ষা করা, এতিমকে সহায়তা করা, নিরীহকে শক্তিশালী জালেমের জুলুম থেকে রক্ষা করার কৌশল অবলম্বন করা, আর নেক সন্তান গড়ে তোলার প্রয়াস অব্যাহত রাখা।