নবী মুহাম্মদ। সর্বশেষ নবী। তারপরে কেয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নবী পৃথিবীতে আগমন করবেন না রেসালাতের দায়িত্ব নিয়ে। আল্লাহর কাছ থেকে তার আনীত বিধানই কেয়ামত অবধি চলবে। এছাড়া পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা তাকে গোটা জগতের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি কেয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মানুষের নবী। হাশরের মাঠের শ্রেষ্ঠ সুপারিশকারী। তাই তিনি মহানবী। তার গুণ ও বৈশিষ্ট্য জগতের সকল মানুষের গুণ ও বৈশিষ্ট্যের চেয়ে অনন্য, অতুলনীয়। তার গুণবিভায় যে নিজেকে উদ্ভাসিত করতে পারে, সে জগতের কালোত্তীর্ণ সেরা মানুষে পরিণত হয়। নিচে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কিছু গুণাবলি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
হাসিখুশি থাকা : মন মলিন করে থাকা বা রাগান্বিত হয়ে থাকা, মানুষকে কেউ পছন্দ করে না। পরিবেশ ও সমাজ যেমনই হোক না কেন, সর্বত্র হাসিখুশি ও ঠান্ডা মেজাজে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারাই সফলতা। নববি আখলাক। রাসুল (সা.) হাসিখুশি থাকতেন। ভদ্রোচিত আচরণ করতেন। মনের ভেতর কোনো কষ্ট বা জিদ পুষে রাখতেন না তিনি। আমরা বিনতে আবদুর রহমান থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি আয়েশা (রা.) কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসুলুল্লাহ (সা.) একান্তে কীভাবে কাটাতেন? তিনি বললেন, ‘তিনি ছিলেন সবচেয়ে পুণ্যবান ও ভদ্র এবং খুব হাসিখুশি ব্যক্তিত্ব।’ ( আখলাকুন্নবি : ২৩)।
লাজুকতা : যার লজ্জা নেই, তার ঈমান নেই। লজ্জাহীন মানুষের পক্ষে অনাকাঙ্ক্ষিত ও গর্হিত কাজসহ সবকিছুই করা সম্ভব। মানুষ পাপকাজ থেকে বিরত থাকার জন্য লজ্জা সহায়ক হয়। সামাজিক প্রচলনে, চোখশরম, মুখশরম বলতে একটা কথা আছে। এটা থাকা প্রয়োজন। নির্লজ্জ মানুষ ধীরে ধীরে অশালীন ও অনর্থক কাজে জড়িয়ে পড়ে। লজ্জা ঈমানদার বান্দার জন্য অতি আবশ্যক একটি বিষয়। এজন্য আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘লজ্জা ঈমানের অঙ্গ।’ যিনি এ কথা বলেছেন, তিনি তো অভাবনীয় লজ্জাশীল। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) হতে বর্ণিত, ‘তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) পর্দানশীন কুমারির চেয়েও বেশি লজ্জাশীল ছিলেন।’ (বোখারি : ৬১০২)।
অভাবীকে সাহায্য করা : রাসুল (সা.) দুঃখী, অসহায় ও দুর্বল মানুষকে সব সময় সাহায্য করতেন। তিনি ছিলেন দয়ালু, উদার ও দানশীল। তার উদারতা, বদান্যতা ও সহায়তার স্বীকৃতি দেন অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে তার স্ত্রী খাদিজা (রা.)। বোখারি শরিফে অহি অধ্যায়ের শুরুর দিকেই এ আলোচনা এসেছে। রাসুল (সা.) হেরা গুহায় ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। একদিন জিব্রাইল (আ.) অহি নিয়ে নিজের আকৃতিতে উপস্থিত হন।
সেদিন রাসুল (সা.) তাকে দেখে কিছুটা ভয় পান। সেখান থেকে চলে আসার পর তিনি কাঁপতে থাকেন আর তার স্ত্রীকে বলেন, আমাকে চাদরে আবৃত করো। তাকে চাদরে আবৃত করা হলে ভয় দূর হয়। তখন রাসুল (সা.) পুরো ঘটনা খুলে বলেন। বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি নিজের ওপর (প্রাণনাশের) আশঙ্কা বোধ করছি। তখন খাদিজা (রা.) প্রতিউত্তরে বলেন, ‘আল্লাহর কসম, কক্ষণো না। আল্লাহ আপনাকে কক্ষণো অপমানিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেন। অসহায় দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন। নিঃস্বকে সাহায্য করেন। মেহমানের মেহমানদারি করেন এবং দৃর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন।’ (বোখারি : ৩)।
দোষ না ধরা : পরিবারের সদস্যদের বা অধীনের লোকদের দোষ খুঁজে বেড়ানো একটি নিন্দনীয় কাজ। মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। ভুল হতেই পারে। তবে খামখেয়ালি করে বা সচেতনতার অভাবে বার বার ভুল করা অনুচিত। যা মানুষের গুণ ও মর্যাদা দুটোই নষ্ট করে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে কোনো ভুল হয়ে গেলে এজন্য তুলকালামকাণ্ড ঘটানো একেবারেই অনুচিত। রাসুল (সা.) তার অধীনের লোকদের, খাদেম ও সাথী-সঙ্গীদের ভুল ধরতেন না। রাসুল (সা.)-এর খাদেম ছিলেন আনাস ইবনে মালেক (রা.)। তিনি বলেন, ‘আমি ৯ বছর পর্যন্ত রাসুলের খেদমত করেছি। কিন্তু আমার জানা নেই, তিনি কখনো আমাকে বলেছেন, ‘তুমি এমন কেন করেছ? এবং তিনি কখনো আমার কোনো কাজে সামান্যতম দোষও ধরেননি।’ (আখলাকুন্নাবি : ১৬)।
ক্ষমা করা : নবী মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন এক মহামানব। যার মহানুভবতা, উদারতা ও বদান্যতার খরস্রোতে ভেসে যেত অন্যের দেওয়া সব কষ্ট যাতনা। তিনি বড় বড় অপরাধীকেও ক্ষমা করে দিতেন। তিনি ছিলেন নরম মেজাজ ও রহম দিলের অধিকারী। ক্ষমা ছিল তার চরিত্রের সৌন্দর্য। তিনি রেগে যেতেন না খুব সহজে। ক্ষমা, ইনসাফ, ধৈর্য ও ভালোবাসার মাধ্যমে তিনি মানুষকে কল্যাণের পথে ডেকেছেন। মানুষ তার আচরণ ও চরিত্রে মুগ্ধ ছিল। তার সততা, আমানতদারি ও সত্যবাদিতার ছিল না কোনো জুড়ি। তিনি মনুষ্যত্বের গুণে অনন্য। দয়া ও ক্ষমার ক্ষেত্রে দরাজ দিল। যুদ্ধে ও যুদ্ধের বাইরেও যথাসম্ভব তিনি ক্ষমা করে দিতেন অপরাধীকে। আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) কখনো কোনো স্ত্রীকে মারেননি। কখনো কোনো খাদেমকেও মারেননি। কারো ওপর কখনো তিনি নিজের হাত তোলেননি। তবে তিনি যখন আল্লাহর পথে জিহাদ করতে বের হতেন, তখনকার কথা ভিন্ন। আর এমনও কখনো হয়নি যে, কেউ তাকে কষ্ট দিয়েছে আর তিনি তার প্রতিশোধ নিয়েছেন। তবে কেউ যদি দ্বীনের বিধিনিষেধ অমান্য করত, তিনি তার প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন।’ (কিতাবুল আখলাক : ৪৪)।
শিশুকে স্নেহ করা : শিশুকে হেলা করা বা কাছে এলে ধমক দিয়ে দূরে সরিয়ে দেওয়া এক প্রকার অমানবিকতা। রাসুল (সা.) শিশুদের স্নেহ করতেন। তাদের সঙ্গে খোশগল্প করতেন। শিশুদের প্রতি মমত্ববোধ আচরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতেন। আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মদিনার ছোট্ট মেয়েদের মধ্য হতে কোনো এক মেয়ে রাসুল (সা.)-এর কাছে আসত এবং তার হাত ধরত। তিনি মেয়েটির হাত থেকে নিজের হাত গুটিয়ে নিতেন না। সে যেখানে ইচ্ছা তাকে হাত ধরে নিয়ে যেত।’ (আখলাকুন্নবি : ২৬)।
স্ত্রীর মন জয় করা : স্বামীর জীবনাচার ও রুচিবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে বউয়ের আচরণ ও কথায়। বউয়ের মেজাজ ও চালচলনে। একজন সচেতন ও রুচিশীল স্বামী কখনো তার বউকে অযথা কষ্ট দেয় না। বউয়ের প্রতি দায়িত্বশীল এবং স্নেহ ও শ্রদ্ধাশীল হওয়া রাসুলের দাম্পত্য জীবনের অনন্য শিক্ষা। রাসুল (সা.) যথাসম্ভব তার স্ত্রীদের হাশিখুশি রাখার চেষ্টা করতেন। জাবির (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা.) অত্যন্ত শিষ্ট নবী ছিলেন। আয়েশা (রা.) যখন কোনো কিছু কামনা করতেন, তখন তিনি তা পূরণ করতেন।’ (আখলাকুন্নবি : ৪১)।
আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা : আপনজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেওয়া। তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা নবী (সা.)-এর চরিত্রের অন্যতম অংশ। তিনি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে চলতে জোর নির্দেশ দিয়েছেন। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘জনৈক ব্যক্তি বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আমার আত্মীয়-স্বজন আছেন। আমি তাদের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করি; কিন্তু তারা আমার সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে রাখে। আমি তাদের উপকার করি; কিন্তু তারা আমার অপকার করে। আমি তাদের সঙ্গে সহনশীলতার ব্যবহার করি, আর তারা আমার সঙ্গে মূর্খতার আচরণ করে। তখন তিনি বললেন, ‘তুমি যা বলেছ, যদি প্রকৃত অবস্থা তাই হয়, তাহলে তুমি যেন তাদের ওপর গরম ছাই নিক্ষেপ করছ। সর্বদা তোমার সঙ্গে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের বিপক্ষে একজন সাহায্যকারী (ফেরেশতা) থাকবে, যতক্ষণ তুমি এই অবস্থায় বহাল থাকবে।’ (মুসলিম : ৬২৯৪)।
হিংসা ও শত্রুতা না করা : রাসুল (সা.) কারো সঙ্গে হিংসাবিদ্বেষ ও শত্রুতা করতেন না। সাহাবিদের পরস্পরে হিংসাবিদ্বেষ করতে বারণ করতেন। আনাস ইবনে মালেক থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পর হিংসা করবে না, বিদ্বেষ করবে না। পেছনে একে অপরের শত্রুতা করবে না। তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা হিসেবে ভাই ভাই হয়ে থাকবে।’ (মুসলিম : ৬২৯৫)। হিংসাবিদ্বেষ মানুষের মনের শান্তিকে পুড়ে ছাই করে দেয়। পরিবার ও সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। সম্পর্ক ও বন্ধনকে শিথিল করে দেয়। রাসুল (সা.) আমাদের আদর্শ। অনুসরণীয় ও পথিকৃৎ। তার আদর্শে আমরা নিজেদের গড়ে তোলতে পারলে আমাদের ব্যক্তিক, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন সুখময় ও ছন্দময় হবে।