কোরবানি নিয়ে আপত্তি নয়, চাই ত্যাগের শিক্ষা। ত্যাগের মাধ্যমে নিজেকে পরিশুদ্ধ করাই কোরবানির অন্যতম উদ্দেশ্য। আর এ উদ্দেশ্যে পশু জবাই করা একটি স্বতন্ত্র আমল। কোরবানি করা আল্লাহপাকের নির্দেশ। যুগে যুগে এ নির্দেশ বিধানরূপে পালিত হয়ে আসছে। কোরবানি করার নির্দেশ পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামাজ আদায় করুন এবং কোরবানি করুন।’ (সুরা কাওসার : ২)। আয়াতে বর্ণিত ওয়ানহার শব্দ থেকে কোরবানির আবশ্যকতা প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু প্রতিবছর কোরবানির সময় ঘনিয়ে এলে কিছু কিছু বুদ্ধিজীবীর আগমন ঘটে। তারা মুখরোচক কিছু স্লোগানের মাধ্যমে পশুপ্রেম জাহির করে। এ স্লোগানের মধ্য দিয়ে কোরবানির আমল থেকে জাতিকে দূরে সরাতে চায়। মানুষের মনে সারা বছরের এ একটা মুহূর্তেই পশুপ্রেম জাগিয়ে তুলতে চায়। বাকি সারা বছর তারা নিজেরাও পশু বধ করে শখের বশে কিংবা ভোজনবিলাসে মত্ত থেকে। সেটা আপত্তিজনক নয়। আপত্তি শুধু কোরবানির বেলায়। তবুও এ ক্ষেত্রে তাদের প্রধান তিনটি আপত্তি আছে। এ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
প্রথম আপত্তি ও জবাব : জীব হত্যা মহাপাপ অথচ মুসলমানরা লাখ লাখ প্রাণী একই দিনে খতম করে। এতে কি তাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়ে না? বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম বুদ্ধের বিখ্যাত উক্তি জীবহত্যা মহাপাপ। চমৎকার স্লোগানের মাধ্যমে তিনি বিশ্বে মানবতাবাদী হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন। কিন্তু তার অনুসারীরা মিয়ানমারে জুলুমণ্ডনির্যাতন করে রোহিঙ্গা মুসলমানদের জীবন থেকে সুখের প্রদীপ কেড়ে নিয়েছে। ফিলিস্তিনে ইসরাইলরা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। এতে করে কি তাদের পাপ হচ্ছে না! বৌদ্ধ ধর্মের সমর্থক ইসরাইলরা সৃষ্টির সেরা জীব মুসলমানকে হত্যা করে কি মহাপূণ্য অর্জন করছে? এ ব্যাপারে কী জবাব দেবে কথিত বুদ্ধিজীবীরা! তাছাড়া মুসলমানরা জীবহত্যা করে না বরং কোরবানি করে। মনের পশুবৃত্তিকে পরাজিত করার জন্য এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মুসলমানরা কোরবানি করে থাকেন। পশু হলো কোরবানির একটি প্রতীক। এই প্রতীক আল্লাহপাক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, তিনি যা কিছু করেন, সেজন্য কারো কাছে তার জবাবদিহি করতে হবে না; কিন্তু সকলকেই তার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। (সুরা আম্বিয়া : ২৩)। ঈদের তিন দিনে লাখ লাখ প্রাণী জবাই করা সত্ত্বেও প্রাণীর ঘাটতি দেখা যায় না। কারণ আল্লাহ এখানে প্রচুর বরকত রেখেছেন। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কোরবানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুতরাং নাস্তিক ও ইসলাম বিদ্বেষীদের কোরবানির বিপক্ষে অবস্থান মানেই খোদাই বিধানের নাফরমানী বৈ কিছুই নয়। এছাড়া হিন্দু ধর্মেও তো পাঠা বলি হয়, এ নিয়ে তো কাউকে সরব হতে দেখা যায় না যে, ওরে বাবা কী নিষ্ঠুর বিধান! এককোপে প্রাণী বধ!
দ্বিতীয় আপত্তি ও জবাব : ইসলামে গরুর গোশত বৈধ অথচ শুকরের গোশত হারাম কেন? এটাও প্রাণী ওটাও প্রাণী? কারণ তো অবশ্যই আছে। আল্লাহপাক গরুর মধ্যে অনেক উপকারিতা রেখেছেন। এই গরুসহ কোরবানি যোগ্য অন্যান্য পশু নির্ধারণ করে দিয়েছেন। বাহিমাতুল আনআম শব্দে গৃহপালিত উট, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বাকে বুঝিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছি। যাতে আল্লাহ তাদের যে চতুষ্পদ জন্তুগুলো দিয়েছেন, তাতে তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। তোমাদের মাবুদ একই মাবুদ। সুতরাং তোমরা তারই আনুগত্য করবে, আর সুসংবাদ দাও বিনীতদের। (সুরা হজ : ৩৪)। পক্ষান্তরে আল্লাহপাক শুকরের গোশত খাওয়া হারাম করে দিয়েছেন। কেন না, শুকরের গোশতে এক প্রকার ধ্বংসাত্মক ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস বিদ্যমান। যা মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। শুকরের গোশত মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টিতে সহায়ক বলে বিজ্ঞানীরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বোঝা গেল মানুষের কল্যাণেই কোরআনে শুকরের গোশত হারাম করা হয়েছে। বর্ণিত হয়েছে, তিনি তো তোমাদের জন্য কেবল মৃত জন্তু, রক্ত ও শুকরের গোশত হারাম করেছেন এবং সেই জন্তুও, যার প্রতি আল্লাহ ছাড়া অন্যের নাম উচ্চারণ করা হয়। (সুরা বাকারা : ১৭৩)।
তৃতীয় আপত্তি ও জবাব : ইসলামিক পশু জবাই বিজ্ঞানসম্মত নয়। এর ফলে পশুকে অমানবিক কষ্ট দেওয়া হয়। মূলত পশুজবাই পদ্ধতি নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন। তাদের আবিষ্কৃত পদ্ধতিতে জবাই করার মাধ্যমে পশুর শরীরের সব রক্ত বের হয় না। অনেক রক্ত গায়ে জমাট বেঁধে রয়ে যায়। এটা ভোক্তার স্বাস্থ্যের পক্ষে নিরাপদ নয়। আর ইসলামিক পদ্ধতিতে পশু জবাই করা হলে দ্রুত প্রধান প্রধান রগগুলো কেটে গিয়ে সব রক্ত বের হয়ে যায়। এতে পশুর কোনো কষ্ট হয় না। এটাই পশু এবং ভোক্তার জন্য সবচেয়ে উপকারী পদ্ধতি। জবাই করার সময় পশুর যেন কোনো প্রকার কষ্ট না হয়, এজন্য ছুরি ভালোভাবে ধার দিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ইসলামে। শাদ্দাদ ইবনে আওস (রহ.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সা.) থেকে আমি দুটি কথা স্মরণ রেখেছি। তিনি বলেছেন, আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক বিষয়ে তোমাদের ওপর ইহসান (যথাসাধ্য সুন্দর রূপে সম্পাদন করা) অত্যাবশ্যক করেছেন। সুতরাং তোমরা যখন কাউকে হত্যা করবে, তখন উত্তম পন্থার সঙ্গে হত্যা করবে।? আর যখন জবেহ করবে, তখন উত্তম পন্থার সঙ্গে জবেহ করবে। তোমাদের প্রত্যেকে যেন তার ছুরি ধার করে নেয় এবং তার জবেহকৃত জন্তুকে শাস্তি প্রদান না করে (অহেতুক কষ্ট না দেয়)। (মুসলিম : ৪৮৯৭)।
লেখক : কবি ও শিক্ষক