পশু জবাইয়ের নিয়মকানুন

মুফতি শাহাদাত হোসাইন

প্রকাশ : ১৩ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

জনৈক সাহাবি নবীজিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! কোরবানি কী? নবীজি বললেন, তোমাদের পিতা ইবরাহিমের সুন্নাত। সাহাবি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তাতে আমাদের উপকার কী? নবীজি বললেন, প্রত্যেক পশমণ্ডচুলের বিপরীতে এক-একটি সওয়াব অর্জন (বদরুল-মুনির ৯ : ২৭৪)। সেই সাওয়াব অর্জনের জন্য কোরবানির পশু শরিয়াহ মোতাবেক সহিহ-শুদ্ধরূপে জবাই করা আবশ্যক। নচেৎ, কাঙ্ক্ষিত সাওয়াব অর্জন সম্ভব হবে না। তাই পশু জবাইয়ের নিয়মণ্ডকানুন সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরি।

কোরবানির পশু জবাইয়ের সময় : নামাজ, রোজা, হজ ইত্যাদি যেমন নির্ধারিত সময়ে আদায় করতে হয়। তেমনি কোরবানির পশুকেও নির্দিষ্ট সময়ে জবাই করতে হয়। নয়তো, তা কোরবানি হিসাবে বিবেচিত হবে না। কোরবানির সময়, ঈদের নামাজের পর থেকে শুরু হয়ে ঈদের তৃতীয় দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত বাকি থাকে। বারা ইবনে আজেব (রা.) বর্ণনা করেন, নবীজি বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের কেবলার দিকে মুখ ফেরায় এবং আমাদের মতো নামাজ পড়ে ও কোরবানি করে। সে যেন ঈদের নামাজের আগে জবাই না করে (মুসলিম : ৮২৭০)। সময়ের আগে কেউ কোরবানি করলে তা সিদ্ধ হবে না। তাকে পুনরায় কোরবানি করতে হবে। নবীজি বলেছেন, যে ব্যক্তি নামাজের আগে কোরবানি করেছেন, সে যেন এর পরিবর্তে অন্য একটি কোরবানি করে। (মুসলিম : ৮২৭২)। এ হাদিস থেকে বোঝা গেল, তার কোরবানি হবে না।

পশু কে জবাই করবে? : কোরবানির পশু নিজে জবাই করা উত্তম, যদি উত্তমরূপে জবাই করা সম্পর্কে জ্ঞাত থাকেন। নবীজি নিজে তার কোরাবানির পশু জবাই করতেন। আনাস (রা.) বলেন, নবীজি সাদা-কালো রংয়ের শিং বিশিষ্ট দুটি মেষ কোরবানি করেন। তিনি ভেড়া দুটির গলার পার্শ্বে পা রেখে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে স্বহস্তে সেই দুটিকে জবাই করেন (বোখারি : ৫০৫৪)। অন্যকে দিয়েও জবাই করা যাবে। বিদায় হজের দিন নবীজি নিজে জবাই করে পরবর্তীতে আলী (রা.) কে জবেহ করতে আদেশ করেন। এ ক্ষেত্রে কোরবানি দাতা পুরুষ হলে জবাইর স্থানে নিজে উপস্থিত থাকা ভালো (ফাতোয়ায়ে শামি ৫ : ২৭২)। তবে কোনোভাবেই মুশরিক, অপ্রাপ্ত বয়স্ক, পাগল, মাতাল এবং বিধর্মী ব্যক্তির দ্বারা কোরবানি করা যাবে না (মুস্তাখরাজে আবি আওয়ানা ১৬ : ১৫)।

 

ছুরি ধার করে নেওয়া : আল্লাহ অনুগ্রহশীল, তিনি অনুগ্রহকে পছন্দ করেন। সুরা বাকারায় এসেছে, আর তোমরা অনুগ্রহ করো। কেন না, আল্লাহ অনুগ্রহকারীকে পছন্দ করেন (আয়াত : ১৯৫)। পশু জবাইর ক্ষেত্রেও অনুগ্রহের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা দরকার। যত কম কষ্ট দিয়ে পশুকে জবাই করা যায়, তত উত্তম। তাই কোরবানির পশুকে জবাই করার আগে ছুরিটি ভালোভাবে ধার দিয়ে নেওয়া আবশ্যক। তাতে প্রাণীর কষ্ট অনেকাংশে লাঘব হবে। শাদ্দাদ ইবনে আউস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রতিটি জিনিসের জন্য অনুগ্রহকে আবশ্যক করেছেন। অতএব, যখন তোমরা হত্যা (যুদ্ধে) করো, তা উত্তম পন্থায় করো। আর যখন জবাই করবে, তাও উত্তমরূপে করো। তোমাদের প্রত্যেকে যেন নিজ নিজ ছুরি ধারালো করে নেয় এবং কোরবানির পশুকে আরাম পৌঁছায় (ইবনু মাজাহ : ৩১৭০)।

পশুকে উত্তমরূপে শোয়ানো : জবাই করার আগে প্রাণীকে কোনো প্রকার আঘাত পৌঁছানো ব্যতীত শুইয়ে দিতে হবে। নবীজি বলেছেন, যে প্রাণীকে জবাই করবে সেটাকে শুয়ে দিবে এবং যেটাকে নহর করবে, সেটাকে দাঁড়িয়ে রাখবে (মুস্তাখরাজে আবি আওয়ানা ১৬ : ১৫)। অনেকেই কোরবানির পশুকে নির্দয়ভাবে ফেলে দেয়। কেউবা প্রাণীর পেটের ওপর চড়ে বসেন কিংবা কান ধরে টান দেন, যা সম্পূর্ণ অমানবিক এবং নববী শিক্ষার বিপরীত। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, নবীজি একজন ব্যক্তির পার্শ্ব দিয়ে অতিক্রম করতে গিয়ে দেখলেন, সে বকরির কান ধরে টেনে নিচ্ছে। নবীজি তাকে বললেন, তার কান ছেড়ে দাও এবং তার গলার দু’পার্শ্ব ধর (ইবনে মাজাহ : ৩১৭১)।

জবাইর শুরুতে বিসমিল্লাহ পাঠ করা : কোরবানি হোক কিংবা সাধারণ জবাই হোক, সকল ক্ষেত্রে শুরুতে বিসমিল্লাহ পাঠ করা অবশ্যক। বিসমিল্লাহ বলা ছাড়া জবাই করলে তা খাওয়া হালাল হবে না। আল্লাহ বলেন, আর যাতে আল্লাহর নাম নেয়া হয়নি, তার কিছুই তোমরা খেয়ো না (সুরা আনআম : ১২১)। নবীজি কোরবানি করতে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলতেন, হাদিসে এসেছে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে নবীজি স্বহস্তে পশু জবাই করেছেন (বোখারি : ৫০৫৪)।

জবাইর ক্ষেত্রে কে কে বিসমিল্লাহ পাঠ করবে? : পশু জবাইকারীর জন্য বিসমিল্লাহ বলা আবশ্যক। যদি দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি জবাইকারীকে জবাই কাজে সাহায্য করে এবং উভয়ের শক্তিতে মূল রগগুলো কাটা হয়। তাহলে উভয়ের জন্য বিসমিল্লাহ পাঠ করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে সাহায্যকারী বিসমিল্লাহ না বললে তা খাওয়া জায়েজ হবে না। আর যদি জবাইকারী অধিকাংশ রগ কেটে ফেলে, তাহলে সাহায্যকারী ব্যক্তির বিসমিল্লাহ পাঠ করা আবশ্যক নয়। মনে রাখবেন, পশু জবাইয়ের জন্য এমন শক্তিশালী ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া বাঞ্ছনীয় যে, একাই পরিপূর্ণ জবাই সম্পন্ন করতে পারে। (সুরা আনআম : ১২১, আদ্দুররুল মুখতার ৬ : ৩৩৪)। সতর্কতাস্বরূপ, জবাই কাজে সাহায্যকারী হিসেবে জবাইকালে পশুকে যারা ধরবে, তারা সবাই বিসমিল্লাহ বলবে।

কোন কোন রগ কাটা আবশ্যক? : পশু জবাইর ক্ষেত্রে এমন কিছু রগ আছে, যা কর্তন করা অত্যন্ত জরুরি। যেগুলো কর্তন ব্যতীত পশু জবাই শুদ্ধ হবে না তা হলো, খাদ্যনালি, কণ্ঠনালি এবং শাহরগদ্বয়। যার মধ্যে যে কোনো তিনটি কর্তন করা আবশ্যক। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবীজি শয়তানের নিয়মে জবাই করা থেকে বারণ করেছেন। আর শয়তানের নিয়ম হলো, জবাইর সময় রগ না কেটে শুধু শরীরের চামড়া কেটে পশুকে রেখে দেওয়া এবং এভাবেই পশুটি মারা যায় (আবু দাউদ : ২৮২৬)।

জবেহকৃত পশুর চামড়া কখন ছাড়াবেন? : জবেহ সম্পন্ন হলে, পশুটিকে নিজ অবস্থায় ছেড়ে দেবেন এবং সম্পূর্ণরূপে জীবন চলে যাওয়ার অপেক্ষা করবেন। দ্রুত নিস্তেজ করার জন্য ছুরি দ্বারা গলায় আঘাত করবেন না। জবাইর সঙ্গে সঙ্গে কোরবানির পশুর পায়ের খুঁড়ের উপরের অংশ কেটে দেবেন না। এই কাজের দ্বারা পশুর অধিক কষ্ট হয়। এমনটা করা উচিত নয়। পূর্ণরূপে জীবন চলে যাওয়ার আগে চামড়া খসানো যাবে না।

কোরবানির পশুর চামড়ার হুকুম : কোরবানির পশুর চামড়া পরিশোধন করে কোরবানি দাতা নিজে ব্যবহার করতে পারবে এবং অন্যকে উপহার-উপঢৌকন হিসাবেও দিতে পারবে (শামি ৬ : ৩২৮)। তবে দান করে দেওয়া উত্তম। আলী (রা.) বলেন, নবীজি আমাকে তার কোরবানির পশুর পার্শ্বে দাঁড়াতে আদেশ করেন এবং এগুলোর গোশত, চামড়া এবং পিঠের চাদরসহ সব কিছু বিতরণের আদেশ দেন (বোখারি : ১৭১৭)। যদি কেউ কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করে, তাহলে তার সমস্ত মূল্য জাকাত খাতভুক্ত এতিমণ্ডমিসকিনদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে (রদ্দুল মুহতার ৬ : ৩২৮)।

চামড়ার মূল্য দিয়ে কসাইয়ের পারিশ্রমিক দেওয়া : কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করে কিংবা আস্ত চামড়াটিই কসাইয়ের পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া যাবে না। আলী (রা.) বলেন, নবীজি আমাকে তার কোরবানির পশুর পার্শ্বে দাঁড়াতে আদেশ করেন এবং এগুলোর গোশত, চামড়া এবং পিঠের চাদরসহ সব কিছু বিতরণের আদেশ দেন এবং তা হতে যেন কসাইয়ের পারিশ্রমিক হিসাবে কোনো কিছু দেওয়া না হয়, সেই আদেশও দেন (বোখারি : ১৭১৭)।

কোরবানির গোশতের বিধান : কোরবানির গোশত নিজে খেতে পারবে, আত্মীয়-স্বজনদের খাওয়াতে পারবে এবং দুস্থ-অসহায় ও ফকির মিসকিনদেরকে দানও করতে পারবে। কোরবানির গোশত তিনভাগ করা মুস্তাহাব। নিজের জন্য একভাগ। আত্মীয়-স্বজনের জন্য এক ভাগ এবং ফকির-মিসকিনদের জন্য এক ভাগ। কোরবানির গোশত সম্পর্কে নবীজি বলেছেন, তোমরা খাও, জমা কর এবং সাদাকাহ কর (মুসলিম : ৪৯৪২)। কোরবানির গোস্ত, চর্বি বা অন্য কোনো অঙ্গ বিক্রি করা যাবে না এবং পারিশ্রমিক হিসাবেও কাউকে দেওয়া যাবে না। তবে হাদিয়া হিসাবে দেওয়া যেতে পারে এবং এটা সুন্নাত বটে।

লেখক : খতিব-বাইতুল আজিম জামে মসজিদ, রংপুর