ঢাকা ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কেমন ছিল মহানবীর যুদ্ধরীতি?

আবু নাঈম ফয়জুল্লাহ
কেমন ছিল মহানবীর যুদ্ধরীতি?

যুদ্ধ মানেই ধ্বংস। ধ্বংসের মাঝেও টিকে মানবতা। এ কেমন রীতি! এমন রীতিই ছিল বিশ্বনবীর। যুদ্ধ মানেই সমূলে ধ্বংস নয়। এ বার্তা দিয়েছিলেন মুহাম্মদ (সা.)। আর আজকের পৃথিবী? মনে প্রশ্ন জাগে যুদ্ধ কি শান্তির জন্য হতে পারে? আধুনিক যুগে যারা শান্তির জন্য যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিল তারা হিরোশিমা-নাগাশাকি থেকে শুরু করে আজকের আফগান পর্যন্ত নিরপরাধ মানুষ হত্যার যে ফিরিস্তি পৃথিবীর সামনে পেশ করেছে, তাতে আমাদের এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, আর যাই হোক, যুদ্ধ কখনও শান্তির জন্য হতে পারে না। ইতিহাস খ্যাত যুদ্ধের সেনানায়করা এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো এ কথাই প্রমাণ করেছে যে, যুদ্ধ মানেই অন্যের জায়গায় নিজের ভাগ বসানো, অন্যের সম্পদ ও ভূমি দখল করা, দুর্বলকে হটিয়ে সবলের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, নতুন নতুন ভূখণ্ড দখল করে উপনিবেশ স্থাপন করা।

কিন্তু, না। ভিন্ন ইতিহাসও আছে। শান্তির জন্য যুদ্ধের নজিরও ইহিহাসে আছে। শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) প্রমাণ করে গেছেন, যুদ্ধ অরাজকতার জন্য নয়। যুদ্ধ শান্তির জন্যও হতে পারে এবং এটাই হওয়া উচিত। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু অহিংসার বাণী প্রচার করাই যথেষ্ট না। বরং একটা পর্যায়ে এসে শান্তিকে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত করার জন্য, সাধারণ ও অসহায় মানুষদের শান্তি ও নিরাপত্তার ছায়াতলে আশ্রয় দেয়ার জন্য যুদ্ধই একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়। দুষ্টের দমন ছাড়া প্রকৃতপক্ষে শিষ্টের লালন সম্ভব না।

ইসলাম ধর্মে যুদ্ধ কেন? : দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচারকে প্রতিহত করা, মানুষের হৃত অধিকার ফিরিয়ে দেয়া, সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা, মানুষকে অপর কিছু মানুষের গোলামী থেকে বের করে এক আল্লাহর আনুগত্যের পরিবেশ তৈরি করার জন্য ইসলামে জিহাদ ও যুদ্ধের বিধান রাখা হয়েছে। কোরআনে হাকিমে এরশাদ হচ্ছে, ‘আর তোমাদের কী হলো? তোমরা কেন আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করছ না? অথচ নির্যাচিত নারী-পুরুষ ও শিশুরা চিৎকার করে করে বলছে, হে আমাদের রব, আমাদের এই জনপদ থেকে বের করে নিয়ে যান যার অধিপতিরা অত্যাচারি। আমাদের জন্য একজন অভিভাবক নির্ধারণ করুন এবং আপনার পক্ষ থেকে একজন সাহায্যকারী প্রেরণ করুন। (সুরা নিসা : ৭৫) এই আয়াতে স্পষ্টভাবেই নির্যাতিত মানুষের মুক্তির জন্য যুদ্ধে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, আর তোমরা ওই সব কাফেরের সঙ্গে যুদ্ধ করো, যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসে। আর তোমরা সীমা লঙ্ঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না। (সুরা বাকারা : ১৯০)

মানুষের অধিকার, ইনসাফ, নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীতে এমন এক মাতাদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করা দরকার যা নিঃস্বার্থভাবে এসব অধিকারকে নিশ্চিত করতে পারে। আর এ কথা সুস্পষ্ট যে, মানব রচিত কোনো মতবাদই নির্ভুল ও সার্বজনীন হতে পারে না। সেটা কোনো না কোনো দিকে একমুখী হবেই। পৃথিবীর মানুষ, জীববৈচিত্র্য, প্রকৃতি, মানুষের সমাজ, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, সব কল্যাণের প্রতিষ্ঠা ও অকল্যাণ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারাসহ জানা-অজানা সব কল্যাণকর বৈশিষ্ট্যের অধিকারী শুধু স্রষ্টা প্রদত্ত মাতদর্শের মধ্যেই নিহিত আছে। আর শেষ নবী আসার পর স্রষ্টা প্রদত্ত মতাদর্শ বা জীবন বিধানের সর্বশেষ ও একমাত্র সংস্করণ হলো ইসলাম। এ জন্যই আল্লাহ পাক সুস্পষ্টভাবে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকো, যতক্ষণ না ফিতনা খতম হয়ে যায় এবং দ্বীন একমাত্র আল্লাহর হয়ে যায়। অতঃপর তারা যদি ক্ষান্ত হয়, তাহলে জালেমরা ছাড়া অন্য কারো প্রতি কোনো কঠোরতা নয়। (সুরা বাকারা : ১৯৩)।

অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, তিনি সেই সত্তা যিনি তার রাসুলকে সঠিক পথের দিশা ও সত্য দ্বীন দিয়ে পাঠিয়েছেন যাতে তিনি তার দ্বীনকে সব দ্বীনের উপর বিজয়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। (সুরা আসসাফ : ৯)।

শান্তি ও নিরাপত্তার প্রয়োজনে যুদ্ধ : পৃথিবীতে যুদ্ধ অপরিহার্য। যুদ্ধহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখা মানে, পৃথিবীকে শয়তানের রাজ্যে পরিণত হতে দেয়ার মৌন সমর্থন দেয়া। কারণ, শয়তান আল্লাহর সামনে শপথ করে এসেছিল, সে পৃথিবীকে তার রাজত্বে পরিণত করবে। এখন যদি ভালো মানুষরা ভালোর জন্য সংগ্রাম না করে তাহলে শয়তান ও তার দোসররা পৃথিবীকে তাদের অভয়ারণ্যে পরিণত করবে। এ জন্যই স্মরণাতীত কাল থেকেই যুদ্ধ আছে। যুদ্ধহীন পৃথিবী কখনো কেউ দেখেনি। তাই ইসলাম সত্যের পক্ষে যুদ্ধ করতে বলেছে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, দুষ্ট ও শয়তানি শক্তির কবল থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করার জন্য, কর্তৃত্ববাদী মানুষদের কবল থেকে সাধারণ জনতাকে রক্ষা করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন আমাদের নবীজি (সা.) এবং তার সাহাবীরা।

তদুপরি যুদ্ধ করতে গিয়ে যেন মানুষ আবেগ তাড়িত হয়ে নিরপরাধ কোনো মানুষের জান, মাল ও ইজ্জতের ক্ষতি করে না বসে, সে জন্য ইসলাম দিয়েছে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা। সীমা লঙ্ঘনের সব পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। নিম্নে কিছু বিষয় পয়েন্ট আকারে পেশ করা হলো-

১. বেসামরিক নাগরিক হত্যা করা ইসলামে হারাম। যুদ্ধের ময়দানে যারা শুধু যুদ্ধ করতে আসবে তাদের সঙ্গেই যুদ্ধ হবে। শত্রুকবলিত এলাকায় গিয়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করার অনুমতি ইসলাম দেয়নি। যুদ্ধের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক নেই এমনকি শত্রু বাহিনীর সেনাদের স্ত্রী সন্তানদেরও হত্যা করা যাবে না। হাদিসে এসেছে, নবীজি (সা.)-এর যুগে কোনো এক যুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে একজন মহিলাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। নবীজি খুব বিরক্তি প্রকাশ করলেন। তৎক্ষণাৎ তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে মহিলা ও শিশুদের হত্যা করতে নিষেধ করে ফরমান জারি করলেন। (বোখারি : ৩০১৫)।

২. শত্রুরা যদি যুদ্ধ না করে সন্ধির প্রস্তাব করে, তাহলে সন্ধির দিকেই যেতে হবে। কোরআনে এরশাদ হচ্ছে, ‘আর তারা যদি সন্ধির দিকে ঝঁুঁকে পড়ে, তবে তুমিও সেদিকে ঝুঁকে পড়ো এবং আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। নিশ্চয় তিনি সব কথা শোনেন, সবকিছু জানেন’। (সুরা আনফাল : ৬১)।

৩. যুদ্ধকবলিত এলাকায় কোনো ব্যক্তি যদি ইসলাম গ্রহণ করেছে বলে স্বীকার করে এবং সালাম দেয় তাহলে তাকে এই বলে হত্যা করা যাবে না যে, সে প্রাণের ভয়ে সালাম দিচ্ছে। বরং তাকে নিরাপত্তা দিতে হবে। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদাররা, যখন তোমরা যখন আল্লাহর পথে (জিহাদের জন্য) সফর করবে, তখন যাচাই-বাছাই করে দেখবে। কেউ তোমাদের সালাম দিলে পার্থিব জীবনের উপকরণ লাভের আশায় তাকে বলবে না যে, তুমি মোমিন নও। আল্লাহর কাছে প্রচুর গনিমতের সম্পদ রয়েছে।’ (সুরা নিসা : ৯৪)।

৪. যুদ্ধের সময় অনেক ক্ষেত্রে এমন হয় যে, কোনো একটা সংবাদ যাচাই না করেই বিরোধীদের উপর চড়াও হয়। ফলে নিরপরাধ মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়ে। ইসলামে এটাও নিষেধ করা হয়েছে। আগে সংবাদ যাচাই করতে হবে। কোনো কিছু শুনেই আক্রমণ করা যাবে না। ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে ঈমানদাররা, যখন কোনো পাপাচারি ব্যক্তি তোমাদের কাছে সংবাদ নিয়ে আসে, তখন তোমরা তা ভালোভাবে যাচাই করো। যাতে তোমরা অজ্ঞতা বশত কোনো সম্প্রদায়ের উপর চড়াও না হও, ফলে পরবর্তীতে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য আফসোস করতে হয়।’ (সুরা হুজুরাত : ৬)।

মোটকথা, ইসলাম যুদ্ধের অনুমতি দিয়েছে। তবে সেই যুদ্ধ শুধু কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, স্বার্থ হাসিল, সম্পদ অর্জন, উপনীবেশ প্রতিষ্ঠা বা এ জাতীয় কোনো উদ্দেশ্যে না। বরং সেই যুদ্ধ হতে হবে মজলুমের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। মানুষকে কর্তৃত্ববাদী মানুষের গোলামি থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য। পৃথিবীকে শয়তানি শক্তির কবল থেকে মুক্ত করে পৃথিবীকে ভালো মানুষের বসবাসের উপযোগী করার জন্য। এবং এসব উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করতে গিয়েও সব সীমালঙ্ঘন থেকে বেঁচে থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, যুদ্ধ মানেই নির্বিচারে হত্যা নয়। যুদ্ধ মানেই কোনো জাতিকে সমূলে উপড়ে ফেলা নয়।

লেখক : খতিব ও শিক্ষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত