ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দ্বীনের জন্য সাহাবিদের আত্মত্যাগ

জুবায়ের বিন মামুন
দ্বীনের জন্য সাহাবিদের আত্মত্যাগ

১. হজরত আবু বকর (রা.) : একবার রাসুল (সা.) সাহাবিদের দান-সদকার প্রতি উৎসাহিত করলেন। তখন হজতর আবু বকর (রা.) ঘরে যা ছিল সব নিয়ে এলেন। নবীজি (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন : তুমি পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছ? তিনি বললেন : আমি তাদের জন্য আল্লাহ ও তার রাসুলকে রেখে এসেছি। (জামে তিরমিযী-৩৬৭৫)।

২. হজরত ওমর ফারুক (রা.) : তিনি ইসলাম গ্রহণপূর্ব জীবনে মুসলিমদের বিরুদ্ধে কঠোর ছিলেন। পরবর্তীতে মুসলিম হওয়ার পর পুরো কুরাইশে হইচই পড়ে যায়। একদিন তিনি কুরাইশের সংবাদ প্রচারক জামিল ইবনে মা’মারকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জানো, আমি মুসলমান হয়ে গেছি এবং মুহাম্মদের (সা.)-এর দ্বীন গ্রহণ করেছি? জামিল উত্তর না দিয়ে তৎক্ষণাৎ ওমর (রা.) থেকে কেটে পড়লেন এবং কা’বা চত্বরে গিয়ে ঘোষণা করলেন, হে কুরাইশ! ইবনুল খাত্তাব ‘সাবী’ হয়ে গেছে। উমর (রা.) পেছন থেকে প্রতিবাদী কণ্ঠে বললেন : সে মিথ্যা বলেছে। আমি বরং ইসলাম গ্রহণ করেছি এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে বিশ্বাস করি। অমনি কুরাইশরা তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এবং সূর্য মধ্যাকাশে উঠা পর্যন্ত লড়াই চলল। একপর্যায়ে উমর (রা.) ক্লান্ত হয়ে বসে গেলে তারা তাঁর মাথার ওপর দাঁড়িয়ে রইল। এমতাবস্থায় তিনি বললেন : তোমাদের যা ইচ্ছা কর। আল্লাহর কসম! আমরা যদি ৩০০ লোক হতাম, তাহলে তোমাদের মক্কা ছেড়ে চলে যেতে হত। নতুবা আমরা মক্কা ছেড়ে চলে যেতাম। (সহিহ হিব্বান-৬৮৭৯)।

৩. হজরত বিলাল (রা.) : তিনি উমাইয়া ইবনে খালফ জুমাহির ক্রীতদাস ছিলেন। যে ছিল ইসলামের ঘোরবিরোধী। ইসলামের কথা শুনলেই যেন তার দেহমন জ্বলে উঠতো। এজন্য হজরত বেলাল (রা.) ইসলাম গ্রহণ করার পর তার ওপর শুরু করে অমানবিক নির্যাতন। কখনো গলায় রশি ঝুলিয়ে মক্কার অলি-গলিতে ঘুরাত।

আবার কখনো ছোট বাচ্চাদের তাঁর পেছনে লেলিয়ে দিত। এমনকি সারাদিন কাজ-কর্ম করার পর ক্ষুধার্ত অবস্থায়ই তাঁর রাত কাটাতে হতো। একদা হজরত আবু বকর (রা.) হাঁটছিলেন। পথিমধ্যে তিনি দেখলেন, তাকে তপ্ত রোদের উত্তপ্ত বালুতে শুইয়ে বুকে পাথর চাপা দিয়ে রাখা হলো। তিনি এই দুরবস্থা দেখে ২০০ দিরহামের বিনিময়ে তাকে ক্রয় করে আযাদ করে দেন। ঐতিহাসিক বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়, তাকে উত্তপ্ত বালুতে শুয়িয়ে রেখে বুকে পাথর চাপা দেওয়া হত। আর বলা হত মুহাম্মদের ধর্ম ত্যাগ কর। তিনি তখনও একটি কথাই বলতেন: আহাদ, আহাদ। অর্থাৎ আল্লাহ একজন। তার কোনো শরিক নেই। একমাত্র আল্লাহই ইবাদতের উপযুক্ত। এ বিশ্বাস ও ঈমানের দৃঢ়তা হাবশি বেলালকে ইতিহাসে এক চিরস্মরণীয় ব্যক্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি ঈমান ও তাওহিদ রক্ষার এক জ্বলন্ত প্রতীক। সর্বকালের উপমা।

৪. হজরত সুমাইয়া (রা.) : তিনি এবং তাঁর স্বামী ইয়াসির (রা.) ইসলামের প্রথম যুগেই ইসলাম গ্রহণ করেন। যার ফলে তাদের ওপরও কুরাইশরা চালায় অমানবিক জুলুমণ্ডনির্যাতন। একদা আবু জাহেলের নেতৃত্বে দুপুরের প্রখর রৌদ্রতাপে মরুভূমির কঙ্করময় বালুকারাশিতে তাদের শুইয়ে রাখা হলো। যার ধকল সইতে না পেরে একদিন হজরত ইয়াসির (রা.) ইন্তেকাল করেন। পরবর্তীতে এক দিবসে পাষাণ আবু জাহেল নির্যাতনের এক পর্যায়ে হজরত সুমাইয়া (রা.)-এর নারী অঙ্গে বর্শা বিদ্ধ করলে তিনিও রবের ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি জমান। সুমাইয়া (রা.) প্রথম মহিলা শহিদ। তিনি ইসলামের ইতিহাসে ধর্মের জন্য জীবন উৎসর্গকারী প্রথম নারী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন।

৫. সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) : ইসলাম গ্রহণপূর্ব জীবনে থেকেই মায়ের প্রতি যত্নবান ছিলেন। কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করলে তাঁর মা বলল, তুমি কী দ্বীন গ্রহণ করেছ? তুমি যদি তা ত্যাগ না করো, তাহলে আমি পানাহার ছেড়ে দেব। ফলে আমি মারা গেলে মানুষ তোমাকে মাতৃহন্তা বলবে। তখন সা’দ (রা.) বললেন: আম্মা! আপনি এমন করবেন না। আমি আমার দ্বীনের ওপরই আটল থাকবো। তবুও তাঁর মা সন্তানের কথার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দুই দিন না খেয়ে কাটাল। এতে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ল এবং ভাবল, এই অবস্থা দেখলে তার ছেলের অন্তরে ‘দয়া’ সৃষ্টি হবে এবং মাকে বাঁচানোর জন্য সে ইসলাম বর্জন করবে! কিন্তু সা’দ (রা.) এবার আরো পরিষ্কার ভাষায় বললেন: আম্মা! জেনে রাখুন,আল্লাহর কসম, আপনার যদি একশ প্রাণ থাকত আর সবগুলো একের পর এক বের হয়ে যেত, তবু আমি আমার দ্বীনে অটল থাকতাম। আপনার ইচ্ছে হলে খাবেন আর না হয় খাবেন না। (মুসলিমে-১৭৪৮)। সাহাবিদের একটি গুণ ছিল তারা আল্লাহ ও রাসুলের মহব্বতের কাছে দুনিয়ার সমস্ত ভালোবাসাকে তুচ্ছ মনে করতেন। হাদিসেও এসেছে ঈমানের স্বাদ পাওয়ার তিনটি গুণ আছে। এর একটি হলো ‘সবকিছু থেকে আল্লাহ ও তার রাসুলকে বেশি ভালোবাসা’। হজরত সাদ (রা.) সেই দৃষ্টান্তই পেশ করেছেন।

৬. হজরত খাব্বাব ইবনে আরাত (রা.) : জাহেলি যুগে তিনি কর্মকার ছিলেন। একবার খাব্বাব (রা.) আস ইবনে ওয়াইলের কাছে তাঁর কিছু পাওনা দিরহাম চাইতে গেলে আস বলল: আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদের সঙ্গে কুফরি না করলে আমি তোমার পাওনা পরিশোধ করব না। তখন খাব্বাব (রা.) বললেন : আল্লাহর কসম! তুমি যদি মারা যাও তারপর পুনরায় জীবিতও হও, তবুও আমি মুহাম্মাদ (সা.)-এর সঙ্গে কুফরি করব না। (সহিহ বোখারি : ২৪২৫)। এভাবে দিন রাতের পালা বদলে পৃথিবীর দিক-দিগন্তে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ল। যে আলো ছড়িয়ে দিতে সাহাবিগণ তাদের সর্বস্ব ত্যাগ করলেন এবং বিনিময়ে জান্নাত ক্রয় করলেন। যাদের নাম সোনালি যুগের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমাদেরও উচিত সাহাবাদের অনুসরণে দ্বীনের জন্য আত্মত্যাগী হওয়া। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন।

লেখক : শিক্ষার্থী, মাদরাসাতুদ দাওয়াহ্ আল-ইসলামিয়া, রায়পুর, লক্ষ্মীপুর

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত