রাসুল (সা.) এর সাদাসিধে জীবন
মুফতি ইবরাহীম আল খলীল
প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী। চিরস্থায়ী নয়। এ ক্ষণস্থায়ী জীবনকে সহজ-সরলভাবে নির্বাহ করা। সাদাসিধেভাবে চলা। সৎচিন্তা ও সৎকর্মের দ্বারা পরিচালনা করা। মানবজীবনের সার্থকতা এখানেই নিহিত। একজন সত্যনিষ্ঠ, প্রজ্ঞাবান ও কঠোর সংযমী মানুষের কাছে পার্থিব জীবনে বিলাসিতা ও ঐশ্বর্যতা আকর্ষণীয় হতে পারে না। দুনিয়ার জীবনে জীবিকা নির্বাহের জন্য যতটুকু প্রয়োজন, তার অতিরিক্ত সবটুকু অন্যের প্রয়োজন পূরণে দান করে দেয়ার নির্দেশ ইসলামে রয়েছে। ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ জাকাত দ্বারা বিত্তবানদের ধনসম্পদ বিত্তহীন, সর্বহারা ও অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়ার বিধান দেয়া হয়েছে। এ আদেশের মধ্যদিয়ে গরিব-মিসকিনের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। আর এসব বিষয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু উম্মতকে বলে যাননি, বরং নিজের জীবনেও তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে গেছেন।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন ছিল অনাড়ম্বর ও সাদাসিধে। তিনি জাঁকজমকহীন জীবনযাপন করা পছন্দ করতেন। রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করে তিনি বিরল নজির স্থাপন করেছেন। তিনি বসবাস করতেন খুব সাধারণ ছোট একটি গৃহে। তার গৃহে ছিল না কোনো দামি আসবাবপত্র। শয়ন করতেন চাটাইয়ে। যার ফলে দেহ মোবারকে চাটাইয়ের দাগ পড়ে যেত। বর্ণিত আছে, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) একদা এ দাগ দেখে কেঁদে দিলেন এবং বললেন, দুনিয়ার রাজা-বাদশাহরা কত সুখ-শান্তিতে জীবনযাপন করে, আর আপনার এ অবস্থা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমাদের সুখ-শান্তি পরকালে আর তাদের সুখ-শান্তি ইহকালে। (শামায়েলে তিরমিজি)।
জীবনযাপনে নববি নির্দেশনা : ইসলাম সাদাসিধে জীবনযাপনে উৎসাহ দেয়। কারণ বিলাসিতা কিংবা জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাপন ইসলামি বিধিবিধান পালনে অনেক সময় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতে পছন্দ করতেন। তার জীবন ছিল নিতান্তই সাদাসিধে। ভীষণ খাদ্যকষ্টেও তিনি দিনাতিপাত করেছেন। শুধু নিজে না, বরং বিলাসী জীবন পরিহার করতে তিনি সাহাবায়ে কেরামকে আদেশ করেছেন। বর্ণিত আছে, তিনি যখন মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.)-কে শাসনভার অর্পণ করে ইয়েমেনে পাঠাচ্ছিলেন, তখন তাকে কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম উপদেশ ছিল, ‘হে মুয়াজ, নিজেকে বিলাসিতা থেকে বাঁচিয়ে রেখো। কেননা আল্লাহর খাস বান্দারা বিলাসী জীবনযাপন করে না।’ (শুআবুল ইমান, হাদিস : ৫৭৬৬)।
প্রকৃত মোমেন বান্দা জান্নাতের সুখ-শান্তির জন্যই সব পার্থিব আরামণ্ডআয়েশ বিসর্জন দিয়ে থাকে। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা, যদি তুমি (ইহকাল ও পরকালে) আমার সান্নিধ্য লাভের ইচ্ছা রাখো, তবে দুনিয়ার সম্পদ থেকে এ পরিমাণই নিজের জন্য যথেষ্ট মনে করো, যে পরিমাণ একজন মুসাফিরের পাথেয় হিসেবে যথেষ্ট হয় এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সাহচর্য হতে বেঁচে থাকো। আর তালি না লাগানো পর্যন্ত কোনো কাপড়কে পুরোনো মনে কোরো না। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ১৭৮)।
রাসুল (সা.)-এর ছিল না রসনা-বিলাস : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাবার-দাবারের ব্যাপারে অল্পে তুষ্ট ছিলেন। স্বাভাবিক চলা যায় এমন খাবারকেই তিনি যথেষ্ট মনে করতেন। হজরত উরউয়াহ (রা.) বলেন, একবার হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রা. আমাকে বলেন, হে ভাগ্নে! আমরা দুমাসে তিনটি নতুন চাঁদ দেখতাম। কিন্তু (এর মধ্যে) আল্লাহর রাসুলের বাড়ির চুলাগুলোতে আগুন জ্বলত না। আমি বললাম, আপনারা কীভাবে দিনাতিপাত করতেন? তিনি বলেন, দুটি কালো বস্তু ; খেজুর ও পানি খেয়ে। (বোখারি:৬৪৫৯)।
অন্য এক বর্ণনায় হজরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় আসার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার পরিবারের লোকেরা একনাগাড়ে তিন রাত গমের রুটি পেট পুরে খাননি। (বোখারি: ৫৪১৬)।
আবু কাতাদাহ (রহ.) বলেন, আমরা একবার আনাস বিন মালেক (রা.) এর দাওয়াতে হাজির হলাম। খাওয়ার শুরুতে তিনি আমাদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা খান! আমার জানা নেই, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যুর সময় পর্যন্ত পাতলা রুটি দেখেছেন কি না। আর তিনি কখনো ভুনা বকরির গোশত চোখে দেখেননি। (বোখারি: ৫৪২১)। মিকদাম ইবন মাদিকারাব (রা.) বলেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, পেটের চেয়ে মন্দ কোনো পাত্র মানুষ ভরাট করে না। পিঠের দাঁড়া সোজা রাখার মতো কয়েক লোকমা খাবারই আদম সন্তানের জন্য যথেষ্ট। আর বেশি খাবার ছাড়া যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে পেটের এক তৃতীয়াংশ খাবারের জন্য, এক তৃতীয়াংশ পানির জন্য আর বাকি এক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে (জামে তিরমিজি : ২৩৮৩)।
খাবারের দোষ ধরতেন না : খাবার রান্না করলে সুস্বাদু হয় কিংবা বিস্বাদ হয়। খেতে ভালো লাগে কিংবা মুখ রুচে না। যেমনই হোক খাবার, রাসুল (সা.) কখনো খাবারের দোষ ধরতেন না।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো খাবারের দোষ-ত্রুটি ধরতেন না। তার পছন্দ হলে খেতেন আর অপছন্দ হলে পরিত্যাগ করতেন। (বোখারি : ৫১৯৮)। সুস্থ-সবল শরীরে আল্লাহর ইবাদত করার উদ্দেশে সাধ্যমতো উত্তম ও সুস্বাদু খাবার গ্রহণে ইসলামের কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ ও অপচয় করা থেকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু খাওয়া, তার বেশি নয়। অল্পে তুষ্ট থাকা মোমেনের অন্যতম গুণ। তাই মোমেন ব্যক্তি নানান পদের বাহারি খাবারের আয়োজন না করে প্রয়োজনমাফিক সাধারণ খাবারে তুষ্ট থাকা বাঞ্ছনীয়।
রাসুল (সা.) এর জাঁকজমকহীন পোশাক পরিধান : আড়ম্বরতা এড়িয়ে চলা এবং সাদাসিধে পোশাক পরা ঈমানের পরিচায়ক। এটি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত। তিনি জৌলুশ ও চাকচিক্য পছন্দ করতেন না। নিতান্ত সাদাসিধে পোশাক পড়তেন। তিনি এক হাদিসে এরশাদ করেন, সাদাসিধে হওয়া ঈমানের পরিচায়ক। বর্ণনাকারী বলেন, আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোন ক্ষেত্রে সাদাসিধে? তিনি বলেন, পোশাকের ক্ষেত্রে। (কিতাবুয যুহুদ) অন্য এক হাদিসে এসেছে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, মোমেন ভদ্র ও সাদাসিধে হয় আর পাপী গালিবাজ ও প্রতারক হয়। (জামে তিরমিজি)। মনে রাখতে হবে, সাদাসিধের অর্থ মোটেও নোংরামি, অপরিচ্ছন্নতা ও অসৌন্দর্য নয়। মোমেনের পরিহিত পোশাক সব সময় সুন্দর ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবে। ইসলামি শরিয়তে নামাজসহ অসংখ্য ইবাদতের জন্য পোশাকের পবিত্রতা আবশ্যক করা হয়েছে। তবে অহংকার সৃষ্টি হয় এমন পোশাক পরতে নিষেধ করেছেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি বলেন, যার হৃদয়ে অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, কিছু মানুষ তো তাদের কাপড় ও জুতো সুন্দর হওয়া পছন্দ করে। তখন তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন। আর অহংকার সত্য বিলুপ্ত করে এবং মানুষের অসম্মান করে। (সহিহ মুসলিম)।
রাসুল (সা.) এর অনাড়ম্বর বিছানা : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আখিরাতমুখী সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। দুনিয়ার যৎসামান্য আসবাবপত্রে তার অল্পে তুষ্টির নমুনা তুলনাহীন। পৃথিবীর আর কারো ক্ষেত্রে এরকম দেখা যায় না। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি খেজুরপাতার মাদুরে শুয়েছিলেন। তার দেহের চামড়ায় (মাদুরের) দাগ বসে গেল। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমার মা-বাবা আপনার জন্য উৎসর্গিত হোক। আপনি আমাদের অনুমতি দিলে আমরা আপনার জন্য মাদুরের ওপর কিছু (তোশক) বিছিয়ে দিতাম। তাহলে তা আপনাকে দাগ লাগা থেকে বাঁচিয়ে রাখত। র
াসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, দুনিয়ার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? আমি দুনিয়ায় এমন এক মুসাফির ছাড়া তো কিছু নই, যে একটি গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিল। অতপর তা ত্যাগ করে গন্তব্যের দিকে চলে গেল। (জামে তিরমিজি : ২৩৩৭)। আম্মাজান হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিছানা ছিল চামড়ার তৈরি এবং তার ভেতরে ছিল খেজুরপাতার আঁশ। (বোখারি : ৬৪৫৬)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তার ব্যবহৃত বালিশও ছিল চামড়ার তৈরি, যার ভেতরে ছিল খেজুরগাছের ছাল। (সুনানে আবু দাউদ : ৪১৪৬)। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) এর বর্ণনায়ও রালুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘরের আসবাবপত্রের বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, রালুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি চাটাইয়ের ওপর শুয়ে ছিলেন। চাটাইয়ের ওপর কিছুই ছিল না। তার মাথার নিচে ছিল খেজুরের ছালভর্তি চামড়ার বালিশ। আমি তার শরীরে চাটাইয়ের দাগ দেখে কেঁদে ফেললাম। তিনি বলেন, কাঁদছ কেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! কায়সার ও কিসরা ভোগ-বিলাসে মত্ত অথচ আপনি আল্লাহর রাসুল! তিনি বললেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তাদের জন্য পার্থিব জীবন ও আমাদের জন্য পরকাল। (বোখারি : ৪৯১৩)।
যেমন হবে মোমেন বান্দা : একজন মোমেনের জীবনের বাস্তব নমুনা হবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার সাহাবিগণের আদর্শে সজ্জিত জীবন। সাহাবিরা দুনিয়াকে হাতের নাগালে পেয়েও লাথি মেরে পেছনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হয়েও কখনো বিলাসিতার ধারেকাছেও যাননি। কখনো তিনি মিহি আটার রুটি খাননি। তার ঘরে কখনো লাগাতার তিন দিন পেটভরে খাবারের আয়োজন হয়নি। আরামদায়ক বিছানায় শোয়ার সুযোগ হয়নি। খেজুরের পাতার বিছানায় ঘুমাতেন। যার ফলে পিঠে দাগ পড়ে যেত। আরো কত কত কষ্ট করেছেন তিনি। অথচ আমরা আজ কোথায়? একবারও কি কল্পনা করেছি নিজেকে নিয়ে? নিজেকে একটু মিলিয়ে দেখেছি?
ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, পৃথিবীতে এমনভাবে জীবনযাপন করো, যেন তুমি একজন প্রবাসী অথবা পথচারী মুসাফির। আর নিজেকে কবরবাসী মনে করবে। মুজাহিদ (রহ.) বলেন, ইবনে ওমর (রা.) আমাকে বললেন, তুমি সকালে উপনীত হলে বিকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকবে মনে করো না এবং বিকালে উপনীত হলে সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকবে মনে করো না। অসুস্থ হওয়ার পূর্বে সুস্থতাকে কাজে লাগাও, মৃত্যু আসার আগেই জীবনের সুযোগকে কাজে লাগাও। কেননা, হে আল্লাহর বান্দা! তুমি তো জান না, আগামীকাল তুমি কী নামে অভিহিত হবে (স্বনামে নাকি লাশ নামে)। (জামে তিরমিজি: ২৩৩৩)। আরেক হাদিসে এসেছে, আবু উমামা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন সাহাবিরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে দুনিয়ার ব্যাপারে আলোচনা করল। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা কি শুনতে পাওনা! তোমরা কি শুনতে পাওনা যে, সাদাসিধা জীবন-যাপন করাই হলো ঈমানের অংশ, সাদাসিধা জীবনযাপন করাই হলো ঈমানের অংশ। (সুনানে আবু দাউদ: ৪১৬১)। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেশভূষা ও চলাফেরায় খুবই সাদামাটা ভাব পছন্দ করতেন। পছন্দ করতেন একেবারে সাদাসিধে জীবন। এতেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। কারণ সাদামাটা জীবনই হলো সুন্দর ও শান্তির জীবন। একজন সাদামাটা জীবন-যাপনকারী মানুষকে নিত্যদিনের অতোটা ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয় না। সাদামাটা জীবনের মাধুর্য অসাধারণ। এর মধ্যে লুকিয়ে থাকে সুখের সোনালি আভা। প্রকৃত শান্তি বড় বড় স্বপ্নের মাঝে নয়, সাদামাটা জীবনের ছোট ছোট আনন্দেই পাওয়া যায় প্রকৃত সুখ। জীবন যখন সাদামাটা হয়, তখনই বোঝা যায় সুখের প্রকৃত অর্থ। সাদামাটা জীবনই সুন্দর। যেখানে অহংকারের থাকে না কোনো লেশ।
সম্পদের আধিক্য নিয়ে গর্ব করা বারণ : জীবনটা ক্ষণিকের। ক্ষণিকের দুনিয়ার মিছে চাকচিক্যের পেছনে পড়ে আসল বাড়ির কথা ভুলে যাওয়া কোনো বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। কিন্তু জীবনভর এই অনর্থক কাজই করে চলেছি আমরা। দুনিয়া নিয়ে আমাদের ব্যস্ততা দেখলে মনে হয় যেন দুনিয়াই সব। আখিরাত বলে কিছু নেই। বাল্যকাল থেকে যৌবনকাল, যৌবনকাল থেকে বার্ধক্য পুরোটা সময় শুধু দুনিয়া নিয়েই ব্যস্ত আমরা। কীভাবে আরো বেশি সম্পদের মালিক হব, কীভাবে আরো সুন্দর বাড়ি বানাব, কীভাবে আরো দামি গাড়ির মালিক হব এসব চিন্তাই ঘিরে রাখে আমাদের সব সময়। অথচ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধন-সম্পদকে এই উম্মতের জন্য ফিতনা সাব্যস্ত করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) প্রাচুর্য্যরে অধিকারী হওয়াকে নেক আমলের প্রতিদান নষ্টের কারণ বলে মনে করতেন। হাদিসে এসেছে, ইবরাহিম (রহ.) হতে বর্ণিত, একবার আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) রোজাদার ছিলেন, ইফতারের সময় তার সামনে খাদ্য পরিবেশন করা হলো। তখন তিনি বললেন, মুসআব ইবনে উমায়ের (রা.) শহিদ হলেন। তিনি ছিলেন আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। অথচ তাকে এমন একটি চাদর দিয়ে কাফন দেয়া হলো যা দ্বারা তার মাথা ঢাকলে পা খুলে যায় আর পা ঢাকলে মাথা খুলে যায়। (বর্ণনাকারী বলেন) আমার মনে পড়ে, তিনি আরো বলেছিলেন, হামযাহ (রা.) শহিদ হলেন। তিনিও ছিলেন আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এরপর দুনিয়াতে আমাদের অনেক প্রাচুর্য্য দেয়া হলো। আমার আশঙ্কা হয়, না জানি (এসব প্রাচুর্য্যরে মাধ্যমে) আমাদের নেক আমলের প্রতিদান (দুনিয়াতেই) আগেভাগে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। একথা বলে তিনি কান্না করতে লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে খাবার খাওয়া ছেড়ে দিলেন। (বোখারি : ১২৭৫)। এই ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবিদের অনাড়ম্বর জীবন-যাপনের দৃশ্য। মৃত্যু পর্যন্ত পুরো জীবনটাই এভাবে অতিবাহিত করেছেন তারা। অবশ্য কিছু সাহাবি খুব ধনাঢ্য ছিলেন। প্রচুর সম্পদের মালিক ছিলেন। কিন্তু তাদের অন্তরে সম্পদের মোহ ছিল না। তারা সম্পদকে আল্লাহর পথে ব্যয় করতেন। এবং এত ভীষণ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তাই রাসুল (সা.) ও তার সাহাবিদের জীবনাদর্শে আমাদের জন্য শিক্ষা রয়েছে। রয়েছে আমাদের ইহকাল ও পরকালের সফলতার পাথেয়। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এর মতো সাদাসিধে ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করে দুনিয়া ও আখেরাতে সফল ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষক, মাদ্রাসা আশরাফুল মাদারিস, তেজগাঁও, ঢাকা