আল্লাহতায়ালা স্বীয় সৃষ্টিজীবকে ভালোবাসেন। সৃষ্টিজীবের প্রতি অত্যাচারকে তিনি সহ্য করেন না। তিনি জুলুম, জালিম উভয়কে ঘৃণা করেন। নবীজি বলেছেন, তোমরা জুলুম-অত্যাচার থেকে বিরত থাক। কেন না, জুলুম কেয়ামতে অন্ধকারে থাকবে (মুসান্নাফে ইবনে আবি-শায়বা : ৩৭৯৭৮)। জুলুম যখন দেশের শাসক কর্তৃক প্রজা-সাধারণের ওপর হয়, তখন তা অত্যাচারের সব সীমা ছাড়িয়ে যায়। জালেম শাসক এবং তাদের দোসরদের জন্য অপেক্ষা করছে দুনিয়া এবং আখেরাতে ভয়াবহ পরিণাম।
আল্লাহ নিজের প্রতিও অত্যাচারকে হারাম করেছেন : আল্লাহ, যিনি সব সৃষ্টিকুলের স্রষ্টা এবং একমাত্র মালিক। মালিক স্বীয় মালিকানাধীন বস্তু নিজের ইচ্ছামত হস্তক্ষেপ করতে পারেন। সেটা তার জন্য সিদ্ধ বিষয়। তা সত্ত্বেও আল্লাহতায়ালা নিজের ওপর সৃষ্টিজীবের প্রতি জুলুম, অত্যাচারকে হারাম করে নিয়েছেন। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহতায়ালা বলেছেন, হে আমার বান্দারা! নিশ্চয়ই আমি নিজের ওপর জুলুমকে হারাম করে নিয়েছি এবং তোমাদের পর¯পরের মাঝেও হারাম করে দিয়েছি। অতএব, তোমরা পর¯পরের প্রতি জুলুম করো না (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক : ২১৩৪৩)।
কেয়ামতে শাসকগণ শৃংখলিত অবস্থায় উত্থিত হবেন : কেয়ামত ভয়ংকর এক বিভীষিকার নাম। যার সম্মুখীন প্রতি মানুষকে হতে হবে। সেদিনের লাঞ্ছনা আর অপদস্ততা হবে চূড়ান্ত পর্যায়ের। শাসক শ্রেণির জন্য এ দিনটি হবে বড্ড ভয়ানক। শাসক মাত্রই সেদিন গর্দানে হাত-মোড়ানো অবস্থায় উত্থিত হবেন। বিচারের পর হয়তো মুক্তি পাবেন নয়তো মর্মান্তুদ শাস্তিতে পতিত হবেন। হাদিসে এসেছে, নবীজি বলেছেন, যে ব্যক্তি ১০ জন মানুষেরও (এটি বলা হয়েছে অল্প সংখ্যক বোঝানোর জন্য) শাসক বানানো হয়েছে। কেয়ামতে সে শৃঙ্খলিত অবস্থায় উত্থিত হবেন। অতঃপর তার ন্যায়পরায়ণতা তাকে রক্ষা করবে অথবা তার জুলুম তাকে ধ্বংস করবে (বায়হাকি :৫৫৫১।
শাসক-নেতারা আল্লাহর ক্রোধের শিকার হবেন : যার ব্যাপারে আল্লাহর ক্রোধের বর্ণনা এসেছে, তার ধ্বংস অনিস্বীকার্য। জাহান্নামের আজাব হতে পরিত্রাণ পাওয়া খুবই কঠিন। সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, নবীজি বলেছেন, চার শ্রেণির মানুষের প্রতি আল্লাহতায়ালা ক্রোধান্বিত। কসমের মাধ্যমে বিক্রয়কারী।
অহংকারী ফকির। বৃদ্ধ ব্যভিচারী এবং অত্যাচারী শাসক (নাসাঈ : ২৫৭৬)। আল্লাহর ক্রোধ এবং গোস্বা থেকে রেহাই পেতে নেতাদের উচিত প্রজা-সাধারণের ওপর অত্যাচারের পথ পরিহার করা। চাই নেতা যে স্তরেরই হোক। সামাজিক বা রাষ্ট্রিক যে পর্যায়েরই হোক। নেতার উচিত, তার অধীনের ওপর সর্ব প্রকার জুলুম করা থেকে বিরত থাকা। সবার সঙ্গে মানবিক ও কর্তব্যসুলভ আচরণ করা। দায়সারা মনোভাবাপন্ন কিংবা ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থাণে¦ষী না হওয়া। নেতার মাঝে এ গুণ না থাকলে সে কখনো আল্লাহর ক্রোধ ও গোস্বা থেকে নিস্তার পাবে না।
অত্যাচারী শাসক নবীজির সুপারিশ পাবে না : প্রিয়নবী মুহাম্মাদ (সা.), যিনি উম্মতের মুক্তির জন্য কাতরপ্রাণ। উম্মতের মুক্তির জন্য সারাটা জীবন যিনি কেঁদেছেন। হাশরেও যিনি হায়! আমার উম্মত! হায়! আমার উম্মত! বলে কান্না করবেন। সেজদায় পড়ে রবের কাছে তাদের মুক্তির প্রার্থনা করবেন। এমন দয়ালু মানুষটিও অত্যাচারী শাসকের মুক্তির জন্য রবের দরবারে কেয়ামতের দিন সুপারিশ করবেন না। সাহাবি মা’কাল (রা.) বলেন, নবীজি বলেছেন, আমার উম্মতের দুই শ্রেণির লোক আমার সুপারিশ পাবেন না। অত্যাচারী শাসক এবং ধর্মে প্রতারণাকারী ব্যক্তি। (মাশায়খাতুল-কুবরা :২৬১)।
জাহান্নামের শাস্তি অবধারিত : পৃথিবীতে যারা মানুষকে অন্যায়ভাবে শাস্তি দেবে, কেয়ামতে তাদের জন্য সুনিশ্চিতভাবে শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে। শাসক কিংবা তার আজ্ঞাবহ কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টি; যারাই মানুষকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেবেন, কবরে, হাশরে আল্লাহতায়ালা তাদের শাস্তির সম্মুখীন করবেন।
বর্ণিত আছে, হিশাম ইবনে হাকিম ইবনে হিজাম শামে ওমর ইবনুল খাত্তাবের কর্মকর্তার কাছে এলেন। যিনি জিজইয়া-কর না দেওয়ার কারণে কিছু লোককে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার আদেশ দিয়েছিলেন। তিনি সেই কর্মকর্তার কাছে এসে বললেন, আমি নবীজিকে বলতে শুনেছি, নিশ্চয়ই আল্লাহ কেয়ামতে সেই ব্যক্তিকে শাস্তি দেবেন, যে দুনিয়াতে মানুষকে শাস্তি দেবেন (আস-সানি মিনাল-মেসবাহ :১০)।
অপকর্মের দায় নিজের ওপরই বর্তায় : যারা শাসকের অধীনে কর্মরত থেকে শাসকের অনুমতিতে প্রজা-সাধারণের প্রতি অন্যায়, জুলুম, অত্যাচার করে থাকে। তারা এই অত্যাচারের পরিণাম নিজেরাই ভোগ করবে। কারণ আখেরাতে একজনের কর্মের দায় আরেকজন নিবে না। নেতা, শাসক কিংবা ঊর্ধ্বতন কর্মকতার আদেশ পালনে নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও কৃত অপরাধের জন্য কেয়ামতের দিন লজ্জিত হতে হবে। আল্লাহ বলেন, আর কোনো বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না (সুরা ফাতির : ১৮)। সেদিন আল্লাহ কারো কাজের বোঝা, পাপের বোঝা অন্যের অপর বর্তাবেন না। তাই সদা নিজেকে পাপমুক্ত ও অন্যায়মুক্ত রাখা একজন মোমেন বান্দার অন্যতম নৈতিক কর্তব্য।
লেখক : খতিব, বাইতুল আজিম জামে মসজিদ রংপুর