যুগে যুগে জুলুম ও জালিমের পরিণতি
মুফতি ইবরাহীম আল খলীল
প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
জুলুমমহাপাপ। মারাত্মক কবিরা গোনাহ। যার পরিণতি জাহান্নাম। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৃথিবীজুড়ে চলছে আজ জুলুমের ভয়ংকর প্রতিযোগিতা। চারদিকে প্রকাশ পাচ্ছে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার। ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠী, গোষ্ঠী থেকে রাষ্টযন্ত্র আজ এই জুলুমে লিপ্ত। জুলুমের ওপর দাঁড়িয়েই তাদের ক্ষমতাকে পাকাপুক্ত করছে। যার পরিণতি খুবই মন্দ ও ভয়াবহ। অন্যের ওপর অন্যায়-অবিচার করে নিজের পতন ও ধ্বংস ডেকে আনে জালিমরা। যেমনটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। মানুষের বিভিন্ন বিপদণ্ডআপদে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ জুলুম। যার যা প্রাপ্য তাকে সেই প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার নাম জুলুম। কারো অধিকার হরণ, বিনা অপরাধে নির্যাতন, আর্থিক, দৈহিক ও মর্যাদার ক্ষতিসাধন, মানহানিকর অপবাদ দেওয়া, দুর্বলের উপর নৃশংসতা চালানো, নির্যাতন করা, অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ হরণ, অশ্লীল ভাষায় গালাগাল, উৎপীড়ন বা যন্ত্রণা দান ইত্যাদি কাজ জুলুমের অন্তর্ভুক্ত। মানুষের সঙ্গে কারণে হোক আর অকারণে, কোনোভাবেই অন্যায়-আচরণ বা জুলুম করা যাবে না। মানুষের প্রতি জুলুম সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধ। এ কারণেই অত্যাচারিত ব্যক্তির আবেদন-নিবেদন আল্লাহতায়ালার দরবারে সরাসরি পৌঁছে যায়। আল্লাহতায়ালা মাজলুমের দোয়া খুবই দ্রুততার সঙ্গে কবুল করে থাকেন। মানুষের উচিত দুনিয়ার কোনো সৃষ্টির প্রতি জুলুম না করা।
দুনিয়াতে খুব কম জালিমই নিজেকে জালিম মনে করে। আবার জালিম যখন মাজলুম এবং দুর্বলের প্রতি অত্যাচার চালায়, তখন সে নিজেকে মনে করে অনেক ক্ষমতাবান। ভাবে তার অর্থবিত্ত, শক্তি ও ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী। মনে করে তার সহযোগী অনেক। কিন্তু সে ভুলে যায়, ওই অসহায় লোকটির পক্ষে কেউ না থাকলেও মহান আল্লাহতায়ালা তার সঙ্গে আছেন। তিনি সবই দেখেন ও হিসাব রাখেন। পৃথিবীতে জালিমের অন্যায়-অত্যাচার আর অবৈধ শক্তির ভয়ে মানুষ আতঙ্কিত ও ভীত থাকে। অনেক অসহায় প্রাণ দুই হাত তুলে জালিমের ধ্বংস প্রার্থনা করে। আর মজলুমের বদ দোয়া আল্লাহ কখনো ফিরিয়ে দেন না। আজ যে জালিম নিজেকে শক্তিশালী অনুভব করে এবং শক্তির দাপটে দুর্বলের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না, কাল কেয়ামতের দিন সে নিজেকে মারাত্মক দুর্বল ও দরিদ্র অনুভব করবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, জালিমদের কোনো বন্ধু নেই এবং সুপারিশকারীও নেই, যার সুপারিশ গ্রাহ্য হবে। (সুরা মুমিন, আয়াত : ১৮)।
আল্লাহ জালিমদের ব্যাপারে উদাসীন নন : জুলুম এক অমার্জনীয় অপরাধ। এর শাস্তি অনিবার্য ও ভয়াবহ। জালিমদের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা উদাসীন নন। বরং সার্বক্ষণিক তিনি সবকিছু দেখছেন। জালিম যত কৌশলীই হোক না কেন আল্লাহর চোখকে ফাঁকি দেয়ার সযোগ নেই। মহান আল্লাহ বলেন, তুমি কখনো মনে করো না যে, জালিমরা যা করছে সে বিষয়ে মহান আল্লাহ উদাসীন। আসলে তিনি সেদিন পর্যন্ত তাদের অবকাশ দেন, যেদিন সব চক্ষু স্থির হয়ে যাবে। ভীত-বিহ্বল চিত্তে আকাশের দিকে চেয়ে তারা ছোটাছুটি করবে, আতঙ্কে তাদের নিজেদের দিকেও ফিরবে না এবং তাদের অন্তর হবে (ভয়ানক) উদাস। সেদিন সম্পর্কে তুমি মানুষকে সতর্ক করো, যেদিন তাদের শাস্তি আসবে, যেদিন জালিমরা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের কিছু কালের জন্য অবকাশ দাও, আমরা তোমার আহ্বানে সাড়া দেব এবং রাসুলদের অনুসরণ করব। (তখন তাদের বলা হবে,) তোমরা কি আগে শপথ করে বলতে না যে, তোমাদের কোনো পতন নেই? (সুরা ইবরাহিম, আয়াত : ৪২-৪৪)। পবিত্র কোরআনের অন্যত্র এরশাদ হয়েছে, আমি জালিমদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছি অগ্নি। যার বেষ্টনী তাদের পরিবেষ্টন করে রাখবে। তারা পানীয় চাইলে তাদের দেয়া হবে গলিত ধাতুর মতো পানীয়, যা তাদের মুখমণ্ডল দগ্ধ করবে। এটি কত নিকৃষ্ট পানীয়। জাহান্নাম কতই না নিকৃষ্ট আশ্রয়। (সুরা কাহফ, আয়াত : ২৯)।
কোরআনের অনেক আয়াত রয়েছে, যাতে জালিমের কঠিন শাস্তির কথা আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ জালিমকে ছাড় দেন। কিন্তু ছেড়ে দেন না। জালিমকে তার জুলুমের শাস্তি অবশ্যই ভোগ করতে হবে। মাজলুমের কাছে মাফ চেয়ে ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়া ছাড়া এ শাস্তি থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। কারণ তা বান্দার হক এর অন্তর্ভুক্ত।
মাজলুমের অভিশাপে জালিমের পতন হয় : মাজলুমের অশ্রুফোঁটা ও অন্তরের অভিশাপ জালিমের পতনের অন্যতম কারণ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, তিন ব্যক্তির দোয়া আল্লাহর কাছ থেকে ফেরত আসে না। এক. ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া। দুই. ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া। তিন. মাজলুমের দোয়া। আল্লাহতায়ালা তাদের দোয়া মেঘমালার ওপরে তুলে নেন এবং তার জন্য আসমানের দরজাগুলো খুলে দেন। মহান রব বলেন, আমার সম্মানের শপথ, কিছুটা বিলম্ব হলেও আমি তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করব। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৯৮)। অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, মাজলুমের বদ দোয়াকে ভয় করো। কেন না, মাজলুমের বদ দোয়া ও আল্লাহর মধ্যে কোনো অন্তরাল নেই। অর্থাৎ মাজলুমের দোয়া সরাসরি আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। (বোখারি : ২২৮৬)।
শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ জীবনের জন্য ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত থাকা শর্ত। যে ব্যক্তি অন্যের প্রতি জুলুম করে সে শুধু অন্যেরই ক্ষতি করে না, নিজ জীবনের নিরাপত্তাকেও ঝুঁকিতে ফেলে। আর সমাজের অধিকাংশ লোকেরই যখন চরিত্র হয় জুলুমবাজি অর্থাৎ যারা পারস্পরিক হক আদায়ের কোনো তোয়াক্কা করে না, সেই সমাজ দুর্যোগকবলিত হবেই। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, তোমরা আমার (নবীর) কথা শোনো, তা হলে বেঁচে থাকতে পারবে। সাবধান! তোমরা জুলুম করো না। সাবধান তোমরা জুলুম করো না। সাবধান তোমরা জুলুম করো না! (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২০৬৯৫)।
আল্লাহতায়ালা নিজের জন্য জুলুম হারাম করেছেন, তেমনি বান্দাদের জন্য জুলুমকে হারাম করেছেন। হাদিসে কুদসিতে ইরশাদ হয়েছে, হে আমার বান্দারা! আমি জুলুম করাকে নিজের প্রতি হারাম করেছি এবং তাকে তোমাদের মধ্যেও হারাম করে দিয়েছি। সুতরাং পরস্পর পরস্পরের প্রতি জুলুম করো না। (মুসলিম : ২৫৭৭)। মাজলুম বা নিপীড়িতের দোয়া কখনো ব্যর্থ হয় না। মাজলুমের আর্তনাদের ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে জালিমদের ওপর নেমে আসে কঠিন আজাব। তাদের অধঃপতন ত্বরান্বিত হয়।
কোনো জালিমকে আল্লাহ ছেড়ে দেননি : যারা জুলুম করে এমন কাউকে মহান আল্লাহ অতীতে ছেড়ে দেননি। তার শেকড় যতই শক্ত হোক। ফেরাউন ও নমরুদ তাদের শক্তির দাম্ভিকতায় নিজেদের রব বলে দাবি করেছে। স্বীয় ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য এবং তার পথের কাঁটা সরিয়ে দেওয়ার জন্য দেশের সব নবজাতক ছেলেসন্তানদের হত্যা করেছে। তারা নিজেদের সর্ব ক্ষমতার অধিকারী ভেবেছিল। ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিল। জুলুম করেছিল। কিন্তু এতকিছুর পরও তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। বিশ্ববাসীর জন্য আল্লাহ তাদের দৃষ্টান্ত স্বরূপ পেশ করেছেন। যাতে পরবর্তীগণ তা থেকে শিক্ষা লাভ করতে পারে।
আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি কারূন, ফেরাউন ও হামানকে ধ্বংস করেছিলাম। মুসা তাদের কাছে উজ্জ্বল নিদর্শন নিয়ে এসেছিল, কিন্তু তারা পৃথিবীতে দম্ভ করল। তারা আমার শাস্তি এড়াতে পারেনি। তাদের প্রত্যেককেই আমি তার পাপের কারণে পাকড়াও করেছিলাম; তাদের কারো প্রতি প্রেরণ করেছি প্রস্তরসহ প্রচণ্ড ঝটিকা। কাউকে আঘাত করেছিল মহানাদ। কাউকে আমি ধসিয়ে দিয়েছিলাম ভূগর্ভে এবং কাউকে করেছিলাম নিমজ্জিত। আল্লাহ তাদের প্রতি কোনো জুলুম করেননি; তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল। ...আমি মানুষের কল্যাণার্থে এসব দৃষ্টান্ত দিয়ে থাকি, কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তিরাই শুধু তা বুঝে। (সুরা আনকাবুত আয়াত : ৩৯-৪০, ৪৩)।
ফেরাউনের সীমালঙ্ঘন ও তার পরিণতি : ক্ষমতার জোরে ফেরাউন দেশের জনগণের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছিল। নিজেকে রব বলেও দাবি করেছিল। মনে করেছিল নিজেকে চিরস্থায়ী ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু না, তা আর হয়নি। তার সব অহমিকা আর দাপট মুহূর্তের মধ্যেই ধুলোয় মিশে যায়। আল্লাহ বলেন, ফেরাউন জমিনে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল এবং সে তার অধিবাসীদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করেছিল। তাদের একটি শ্রেণিকে সে অত্যন্ত দুর্বল করে রেখেছিল, যাদের পুত্রদের সে যবাই করত ও নারীদের জীবিত রাখত। প্রকৃতপক্ষে সে ছিল বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। (সুরা কাসাস, আয়াত : ৪)। অন্যত্র এরশাদ হয়েছে, ফেরাউন সম্প্রদায়ের নেতৃবর্গ (ফেরাউনকে) বলল, আপনি কি মুসা ও তার সম্প্রদায়কে মুক্ত ছেড়ে দেবেন, যাতে তারা (অবাধে) পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে এবং আপনাকে ও আপনার উপাস্যদের বর্জন করতে পারে? সে বলল, আমরা তাদের পুত্রদের হত্যা করব এবং তাদের নারীদের জীবিত রাখব। আর তাদের ওপর আমাদের পরিপূর্ণ ক্ষমতা আছে। (সুরা আরাফ, আয়াত : ১২৭)।
ফেরাউনের এ ছেলে হত্যার মূল কারণ ছিল মুসা নবীর আগমনের ভয়। তাই কোনো ছেলেকেই সে জীবিত রাখত না, যাতে তার থেকে কখনো কেউ ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে না পারে, সে হিসেবে শিশুহত্যা ছিল মূর্খতা ও বর্বরতাসুলভ একটি পদক্ষেপ। আল্লাহ আরো বলেন, ফেরাউন বলল, কী! আমি অনুমতি দেওয়ার আগেই তোমরা এই ব্যক্তির প্রতি ঈমান আনলে? নিশ্চয় এটা কোনো চক্রান্ত। তোমরা এই শহরে পারস্পরিক যোগসাজশে এই চক্রান্ত করেছ, যাতে তোমরা এর বাসিন্দাদের এখান থেকে বহিষ্কার করতে পার। আচ্ছা, তোমরা শিগগিরই এর পরিণাম জানতে পারবে। আমি তোমাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলব, তারপর তোমাদের সকলকে শূলে চড়াব। (সুরা আরাফ, আয়াত : ১২৩-১২৪)। মুসা নবীর নেতৃত্ব মেনে নেওয়ায় বনি ইসরাইলকে ফেরাউন এ হুমকি দিয়েছিল।
আল্লাহ অন্যত্র বলেন, ফেরাউন ও তার বাহিনী জমিনে অন্যায় আর অহমিকা প্রদর্শন করেছিল। তারা মনে করেছিল তাদের আমার কাছে ফিরে আসতে হবে না। সুতরাং আমি তাকে ও তার সৈন্যদের পাকড়াও করলাম এবং সাগরে নিক্ষেপ করলাম। এবার দেখ, জালিমদের পরিণতি কী হয়ে থাকে! (সুরা কাসাস, আয়াত : ৩৯-৪০)।
জালিমদের শেষ পরিণতি দেখে মানুষ যাতে শিক্ষা নেয়, এজন্য তাদের কিছু নিদর্শন আল্লাহ দুনিয়াতে বাকি রাখেন। তারা যেন তাদের পরিণতি দেখে। পরবর্তীতে তারা যেন এমন ক্ষমতার দাপট ও ঔদ্ধত্য প্রদর্শন না করে। যেমনটা আল্লাহতায়ালা ফেরাউনের ক্ষেত্রে করেছেন। তার সেই জুলুমে ভরপুর শরীরকে আজও মানুষের সামনে রেখেছেন। যেন মানুষ তার থেকে শিক্ষা নেয়। পরস্পর যেন পরস্পরের ওপর জুলুমণ্ডনির্যাতন না করে। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি বনী ইসরাঈলকে সাগর পার করিয়ে দিলাম। তখন ফেরাউন ও তার বাহিনী জুলুম ও সীমালংঘনের উদ্দেশ্যে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল।
পরিশেষে, যখন সে ডুবে মরার সম্মুখীন হলো, তখন বলতে লাগল, আমি স্বীকার করলাম, বনী ইসরাঈল যেই আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আমিও অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত। (উত্তর দেয়া হলো) এখন ঈমান আনছো? অথচ এর আগে তো তুমি অবাধ্যতা করেছ এবং তুমি অশান্তি সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে। সুতরাং আজ আমি তোমার দেহটি রক্ষা করব, যাতে তুমি তোমার পরবর্তী কালের মানুষের জন্য নিদর্শন হয়ে থাক। (কেন না) আমার নিদর্শন সম্পর্কে বহু লোক গাফেল হয়ে আছে। (সুরা ইউনুস, আয়াত : ৯০-৯২)।
নমরূদ ও তার পরিণতি : নমরূদও এক সময় সাধারণ জনগণের ওপর জুলুমণ্ডনিপীড়ন চালিয়েছিল। কিন্তু সেও টিকতে পারেনি। সময়ের ব্যবধানে সবকিছু চুরমার হয়ে যায়। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, তুমি কি ওই ব্যক্তির অবস্থা চিন্তা করনি, যাকে আল্লাহ রাজত্ব দান করার কারণে সে নিজ প্রতিপালকের (অস্তিত্ব) সম্পর্কে ইবরাহিমের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হয়? যখন ইবরাহিম বলল, তিনি আমার প্রতিপালক যিনি জীবনও দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। তখন সে বলল, আমিও তো জীবন দান করি ও মৃত্যু ঘটাই। ইবরাহিম বলল, আচ্ছা, আল্লাহ তো সূর্যকে পূর্ব থেকে উদিত করেন, তুমি তা পশ্চিম থেকে উদিত কর তো! এ কথায় সে কাফের নিরুত্তর হয়ে গেল। আর আল্লাহ এরূপ জালিমদের হেদায়াত দান করেন না। (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৫৮)।
পৃথিবীতে প্রথম ঔদ্ধত্য প্রদর্শনকারী ছিল নমরূদ। সে-ই আসমান অভিমুখে টাওয়ার নির্মাণ করেছিল। আল্লাহ তাকে শায়েস্তা করার জন্য একটি মশা পাঠান। সেটি তার নাকে প্রবেশ করে। মশার জ্বালা থেকে বাঁচার জন্য তার মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হত। তার রাজত্ব ছিল চারশত বছর। সে যেমন চারশত বছর পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল তেমনি আল্লাহ তাকে চারশত বছর এই আজাবে রাখেন। অতঃপর সে মৃত্যুবরণ করে। (তাফসিরে ইবনে কাসীর ২/৮৭৮)।
যুগে যুগে বহু জালিমের জন্ম হয়েছে। দুনিয়াতে তারা অনেক নিরিহ মানুষের উপর জুলুম আর নির্যাতন চালিযেছিল। কিন্তু আল্লাহতায়ালা কোনো জালিমকেই ছাড় দেননি। তাদের পাকড়াও করেছেন কঠিনভাবে। চরমভাবে অপমান করেছেন। পরবর্তীরা যাতে শিক্ষা নিতে পারে, এজন্য পরবর্তীদের মধ্যে তাদের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। উল্লেখ, করেছেন তাদের জুলুম আর নির্যাতনের বিবরণ। যা আজো মানুষ ঘৃণা ভরে স্মরণ করে।
জালিম এর শাস্তি অবধারিত : মানুষকে তার প্রতিটি কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। এটি সুনিশ্চিত। পরকালীন জীবনে কোন আদম সন্তানই জবাবদিহি ছাড়া এক কদমও নড়তে পারবে না। ইসলামে সব ধরনের জুলুম বা অত্যাচার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ও হারাম। শুধু জুলুম নয়, জুলুমের সহযোগিতা করা এবং জালিমদের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা রক্ষা করাও হারাম। আর এ বিধান শুধু মুসলমান নয়, কোনো অমুসলিমের ওপর জুলুম করলেও তার জন্য এ হুকুম। ইসলাম মতে, মানুষের ওপর জুলুম এক ভয়াবহ গোনাহ। এ কারণে পরকালে দোজখে প্রবেশ করতে হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়ন এমন এক অপরাধ যা সাধারণত আল্লাহ মাফ করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত ওই মজলুম ব্যক্তি (যার প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে) জালিমকে (অত্যাচারী ব্যক্তিকে) মাফ না করেন।
জুলুমের পরিণাম : জুলুমের পরিণাম খুবই ভয়াবহ। জুলুম এমন একটি অন্যায় কাজ, যার শাস্তি আল্লাহতায়ালা ইহকালেও দিয়ে থাকেন। জালিমের বিচার শুধু কেয়ামতের দিবসেই হবে না, বরং দুনিয়া থেকেই আল্লাহতায়ালা তাদের জুলুমের প্রতিদান দেওয়া শুরু করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দুটি পাপের শাস্তি আল্লাহতায়ালা আখিরাতের পাশাপাশি দুনিয়ায়ও দিয়ে থাকেন। তা হলো, জুলুম ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার শাস্তি (তিরমিজি : ২৫১১)।
জালিমকে সাহায্য না করা : কোরআনে আল্লাহ বলেন, আর তোমরা জালেমদের প্রতি ঝুঁকে পড়বে না, জালেমদের সহযোগী হবে না, তাহলে (জাহান্নামের) আগুন তোমাদেরও স্পর্শ করবে (সুরা হুদ, আয়াত : ১১৩)।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহতায়ালা জালিমকে দীর্ঘসময় পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন পাকড়াও করেন, তখন তাকে আর রেহাই দেন না। অতঃপর তিনি এই আয়াত পাঠ করেন, তোমার প্রভুর পাকড়াও এ রকমই হয়ে থাকে, যখন তিনি জুলুমরত জনপদগুলোকে পাকড়াও করেন। তার পাকড়াও অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক, অপ্রতিরোধ্য। (বোখারি ও মুসলিম)।
মানুষের অধিকার হরণ করা ও তাদের ধন-সম্পদ আত্মসাৎ করা অনেক বড় জুলুম। এই ধরনের জুলুমের কারণে পুরো পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। শান্তি ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হচ্ছে। বিত্তবানরা দারিদ্র্য শ্রেণিকে ও ক্ষমতাবানরা সাধারণ লোকের প্রতি হিংসার বশবর্তী হয়ে নির্যাতন আর নিপীড়ন করে। ফলে একসময় জালিম বা অন্যায়কারীর জীবনে নেমে আসে নানা বিপদণ্ডআপদ। যারা মানুষের ওপর জুলুম করে এবং প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তাদের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয়ই যারা মানুষকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়, আল্লাহতায়ালা তাদের শাস্তি প্রদান করবেন (মুসলিম, হাদিস : ২৬১৩)।
যুগে যুগে নবী-রাসুল আগমনের উদ্দেশ্য : দুনিয়ায় যুগে যুগে নবী-রাসুল প্রেরণের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হচ্ছে, পৃথিবী থেকে যাবতীয় জুলুমণ্ডঅত্যাচারের পরিসমাপ্তি ঘটানো। মানবজাতির জীপনযাত্রার প্রতিটি শাখা-প্রশাখা ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক নিয়মনীতির ওপর প্রতিষ্ঠা করা। এ জন্য ইসলাম সবক্ষেত্রে জুলুমণ্ডঅবিচার থেকে দূরে থাকার জন্য গুরুত্বারোপ করেছে।
জুলুম বিপর্যয়ের কারণ : সমাজে বিরাজমান অত্যাচার-অনাচার ও বিশৃঙ্খলা-অস্থিরতার মূল কারণ হলো জুলুম। একে অপরের ওপর নানা রকম অবিচারের ফলে আল্লাহতায়ালা মানুষের ওপর এ বিশৃঙ্খলা চাপিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, জল ও স্থলভাগে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে তা মানুষের কর্মের ফলস্বরূপ (সুরা রুম, আয়াত ৪১)। পরিশেষে, মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন জালিমদের অত্যাচার-নিপীড়ন থেকে আমাদের রক্ষা করেন এবং মাজলুমের অভিসম্পাত থেকে বাঁচিয়ে রাখেন। আমিন।
লেখক: শিক্ষক, মাদ্রাসা আশরাফুল মাদারিস, তেজগাঁও ঢাকা